Naya Diganta

চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ট্রাস্টি বোর্ড বেসরকারি ভার্সিটিতে আতঙ্ক

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই সম্প্রতি ভেঙে দেয়া হয়েছে দু’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড। সেখানে নতুন করে গঠন করা হয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। তবে অভিযোগ উঠেছে, কী অপরাধে কিংবা কোন কারণে এই দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে তা এখনো অজানা। অনেকটা চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তেই পুনর্গঠন করা হচ্ছে ট্রাস্টি বোর্ড। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন আতঙ্কও বিরাজ করছে। অন্যদিকে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) বলছে, তারা নতুন এই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না।


অবশ্য অভিযোগের বিষয়ে গড়পড়তায় শুধু এতটুকুই বলা হয়েছে যে, সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ তদন্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সেখানে নতুন করে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠান দু’টির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ অবস্থায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত একমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে সরকার দু’টি বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পুনর্গঠন করেছে। প্রতিষ্ঠান দু’টির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গি অর্থায়নের মতো অভিযোগ আনা হলেও এসব অভিযোগের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ এখনো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। এমনও শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই আরো এক বা দু’টি প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডও অদল বদল করা হবে। এ খবরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সূত্রমতে সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এতে নর্থ সাউথের নতুন বোর্ডে আগের বোর্ডের বেশির ভাগ এবং মানারাতের বোর্ডের সব সদস্যকে বাদ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই কুমিল্লায় ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটির বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
এ দিকে গতকাল মঙ্গলবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যে প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে, তাতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের কাছে একটি ‘ভুল বার্তা’ যাচ্ছে। অনেকেই এখন রীতিমতো আতঙ্ক বোধ করছেন। তাদের দাবি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে বর্তমান ট্রাস্টিদের বাদ দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। খ্যাতিমান শিক্ষাবিদরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহ হারাবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানান, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আগে সেই অভিযোগ প্রকাশ করা হোক। তারপর অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েও যদি কোনো সদুত্তর না আসে তাহলে ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনের প্রশ্ন আসবে। কিন্তু এখন যা করা হচ্ছে এটা অনেকটা চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে। এমনটি করা ঠিক হবে না। কেননা এ ধরনের ঘটনায় অন্যরা (প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টিরা) আতঙ্কিত বোধ করবেন। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে সরকারকে অনুরোধ করব, যাতে এ ধরনের কাজ করার আগে আমাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা হয়। যাতে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে আমরা আগে শোধরানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারি।


চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মানারাতের বোর্ড
এ দিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পুরো ট্রাস্টি বোর্ড বাতিল করে সেখানে নতুন করে গঠন করা হয়েছে বোর্ড। নতুন এই ট্রাস্টি বোর্ডকে অনেকেই চাপিয়ে দেয়া বোর্ড বলেও অভিহিত করেছেন। পুনর্গঠিত ১৩ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে। এতে আগের কমিটির সবাইকে বাদ দেয়া হয়েছে। কেবল পদাধিকার বলে ভিসিকে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ তদন্তে যেসব অভিযোগের কথা বলে হয়েছে সেখানে কোনো অভিযোগের বিষয়েই সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ উল্লেখ করা হয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, যেসব অভিযোগে ট্রাস্টি বোর্ড ভাঙ্গা হয়েছে, সে রকম কোনো বিষয় আমাদের জানা নেই। শিক্ষার্থীদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রতিষ্ঠান গড়েছি। এর বাইরে আমার কোনো মন্তব্য নেই।


নর্থ সাউথেও বোর্ড বদল
এর আগে গত ১৬ আগস্ট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ভেঙে দিয়ে ১২ সদস্যের নতুন বোর্ড গঠন করে সরকার। পুরোনো ট্রস্টি বোর্ডের সাতজনকে নতুন বোর্ডে রাখা হয়নি। যাদের বাদ দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে চারজন আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলায় কারাগারে আছেন।
এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কয়েকজন সদস্য এবং অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িত বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, যা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ অবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টে অন্তর্ভুক্ত থাকা সমীচীন নয়।
ভেঙে দেয়া বোর্ডের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত আর্থিক খাতের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সাথে বিদায়ী বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ ও সদস্য এম কাশেমের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে নর্থ সাউথের বিষয়ে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা আরো বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে ওই ব্যবসায়ীর পরিবারের এক সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে আজিম উদ্দিন আহমেদ ও এম কাশেমের দ্বন্দ্বের শুরু। এর আগে থেকেই তাদের ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সাথে বিরোধ চলছিল। এসব থেকে গোলমালের সূত্রপাত। ওই সদস্যরা বলছেন, শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে বোর্ড পুনর্গঠন করা হলে বিষয়টি আইনসম্মত হতো। দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও সরকার যাদের নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক মনে করেনি, তাদের বাদ দিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাদ দেয়া হলে বিষয়টি আইনগত কারণে হয়েছে বলে মনে করা যেত।


ইউজিসিকে অন্ধকারে রাখার অভিযোগ
ইউজিসির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডে কারা থাকবেন, এ বিষয়ে ইউজিসির কোনো পরামর্শ বা মতামত নেয়নি সরকার। বিষয়গুলো নিয়ে ইউজিসিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। আর নর্থ সাউথের ট্রাস্টি বোর্ডে শিক্ষাবিদ হিসেবে ভিসিকে রাখা আইনসম্মত হয়নি। তবে সব কিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে বলে দাবি ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমের। তিনি বলেন, কোথাও আইনের ব্যত্যয় হয়নি। এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। এ জন্য সরকার ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তন করেছে।
দু’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন বিষয়ে শিক্ষাসচিব মো: আবু বকর ছিদ্দীক দাবি করেন, সব কিছু আইন অনুযায়ীই করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেকোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করতে পারেন। আর এ ঘটনায় কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টিরা আতঙ্কিত হবেন এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তারা যদি আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন, তাহলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।