Naya Diganta

সাফের শিরোপা নিয়েই কেন এত উন্মাদনা!

সাফের শিরোপা নিয়েই কেন এত উন্মাদনা!

এর আগেও নানা সময়ে নানান দল শিরোপা জিতেছে, দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। বিপরীতে তাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে, উদ্দীপনা বেড়েছে, পুরস্কার মিলেছে, সংবর্ধনাও দিয়েছে। কিন্তু এমন বিশাল আয়োজন করে কখনো কি কাউকে বরণ করে নেয়া হয়েছে? কেউ কি ছাদখোলা বাসের অভ্যর্থনা পেয়েছে? এতো এতো আলোচনা, এতো ভালোবাসা কি আর কারো কপালে জুটেছে!

শিরোপার ওজনে এর থেকেও বড় শিরোপা জয়ের কীর্তি আছে। আরো বড় মঞ্চ থেকে আরো বড় শিরোপা বাংলাদেশে এসেছে। সাফের থেকেও বড় জয়, বিজয়, কীর্তি আছে। এর থেকেও বড় গল্পগাঁথা ইতিহাসে লেখা আছে, এর থেকেও বড় সাফল্যগাঁথা বাংলাদেশের নামে মিশে আছে। সাফ জয়ের থেকেও বড় গৌরবময় অধ্যায় আছে, আছে এর থেকেও শিহরিত মুহূর্ত।

এখন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার খেলাধুলায় সব থেকে বড় অর্জন যুব বিশ্বকাপ জয়। ক্রিকেটে দুই-দুইবার এসিসি বিজয়, ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়সহ আছে আরো কতশত রঙিন মুহূর্ত। পুরুষ ফুটবল দলেরও আছে সাফজয়ের কৃতিত্ব। আছে আব্দুল্লাহ হিল বাকী কিংবা রুমান সানাদের স্বর্ণজয়ের গল্প, মাবিয়াদের মতো স্বর্ণকন্যারাও ছিলেন রঙিন আলোয় দীপ্ত। দলীয় নারী বিভাগেও বড় অর্জনটা ক্রিকেটে, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় ২০১৮ এশিয়া কাপ আসরে।

কিন্তু তবুও সাফজয়ী নারীদের ঘিরে এতো এতো আলোচনা, এতো উদ্দীপনা। ওরা দেশে ফিরেছে সপ্তাহখানেক হয়ে গেলেও, এখনো মিলছে পুরস্কার আর সংবর্ধনা। অথচ ওরা সাফ চ্যাম্পিয়ন। বিশ্ব স্বীকৃত কোনো টুর্নামেন্ট নয়, ইউরোপ-আমেরিকার সাথেও কোনো সংযোগ নয়, সংযোজন নেই এশিয়া কাপের সাথেও। এটা শুধুই দক্ষিণ এশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটা দেশেই যে শিরোপা ভাগ হয়।

বিপরীতে নারী ক্রিকেট দল গোটা এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন, আর যুব ক্রিকেটাররা তো বিশ্ব ক্রিকেটেরই শিরোপাজয়ী। সারা বাংলা জুড়ে আনন্দঘন পরিবেশ তারাও তৈরি করেছিলো, তাদেরকে ঘিরেও দেশজুড়ে সাজ সাজ রব উঠেছিলো। কিন্তু এতো পুরস্কার আর সংবর্ধনা জুটেনি তাদের কপালে, ছাদখোলা বাসও আসেনি তাদের বরণ করতে। এইতো, আজও নারী ক্রিকেট দল আইসিসি বাছাইপর্বের হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফিরেছে, ফিরেছে শিরোপা হাতে। কিন্তু তাদের বরণ করা হয়েছে শুধুই ফুল দিয়ে।

প্রশ্ন হতেই পারে, শিরোপা তো সবাই জিতেছে। তবুও এতো বৈষম্য, বৈপরীত্য, বৈচিত্র্য কেন? উত্তরটা আসলে পারফরম্যান্স আর শিরোপায় সীমাবদ্ধ নয়। উত্তরটা আসলে মিশে আছে এই মেয়েদের উঠে আসার লড়াইয়ে। তাদের জীবন গল্পে। তবে তিক্ত হলেও সত্য, তবুও এতো আয়োজন, এতো এতো সংবর্ধনা কপালে জুটতো না। এসবের পেছনে আছে আরো একজনের কৃতিত্ব। হয়তো ওদের ঘিরে আনন্দ, উল্লাস হতো, দেশটা মুখরিত হতো। কিন্তু এতো আয়োজন হতো না। যদি না একজন ফুটবলার পায়ের বদলে হাতের জাদু না দেখাতো।

দূর আকাশের মেঘে হারানো ম্যারাডোনাকে কি মনে পড়ে গেলো? না, ম্যারাডোনার মতো হাত দিয়ে মাঠে গোল করেনি কেউ। গোল করেছে, তবে তা নিজেদের পক্ষে। মাঠে নয়, মনের মন্দিরে; আবেগের কুঠুরিতে। ফেসবুকের নীল দুনিয়ায় আবেগ আর পুরনো ব্যথার কালো কালিতে হাতের গোলটি দিয়েছেন সানজিদা। যেই গোলে হাসেনি বাংলাদেশ, বরং কেঁদেছে আপনমনে। আবেগের ঢেউ উঠেছে ফাইনালের আগে সানজিদার লেখা ‘আমরা জিততে চাই’ বার্তাটিতে।

বড় সেই বার্তার ছোট্ট একটা অংশই মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। যেখানে সানজিদা লিখেছিলেন, ‘ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।’

হয়তো ভাবছেন, সানজিদার এই বার্তাটি শুধুই আবেগে লেখা? তবে ভুল হবেন আপনি, যখন জানবেন এর পেছনে আছে একমুঠো নিরব ব্যথা। ফাইনালে উঠার পর হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই দিনটা। ২০১৭ সালের সেইদিনে যে প্রথমবার সাফের ফাইনাল খেলে এসেও, রানার্সআপ স্বীকৃতি নিয়ে দেশে ফিরে, বিমানবন্দরে বরণ করতে পাশে পাননি কাউকে, সংবর্ধনা তো বহুদূর, পাননি কোনো প্রকার অভ্যর্থনাও।

সানজিদা জানতেন, এবারও হেরে গেলে তেমনই হবে। সান্ত্বনা আর সাব্বাশি দিতে পাশে পাওয়া যাবে না কাউকে। নিজেকে নিজেরই সান্ত্বনা দিতে হবে। যেভাবে দিয়েছেন ২০১৭ সালের সেই আসরে। এক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন সেবার, হয়তো আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলেই বিমানবন্দরে আসেনি কেউ। জিততে পারলে আসতো। তাই আমরা জিততে চাই। অতঃপর জিতেও গেলেন তারা। পরের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়।