Naya Diganta

এক নজরে শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি

শায়খ ড. আল্লামা ইউসুফ আল কারাজাভি

অবতরণিকা
যিনিই গড়ে উঠেছেন, আপন কীর্তি ও কর্মে প্রোজ্জ্বল হয়েছেন, আর কিছু নয়, নিজের চেষ্টা-সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই হয়েছেন। এমনই আপন কর্মে প্রোজ্জ্বল ও একজন সফল ব্যক্তিত্ব হলেন- মিসরীয় বংশোদ্ভূত আলেম শায়খ ড. আল্লামা ইউসুফ আল কারাজাভি। তিনি আজ কাতারের রাজধানী দোহায় ইন্তেকাল করেছেন। মিসরের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদার হুড) সাবেক এ উপদেষ্টার বর্ণাঢ্য জীবনী সংক্ষিপে তুলে ধরা হলো :

আরো পড়ুনবিশ্বখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভির ইন্তেকাল

জন্ম ও শৈশব
মহান মনীষী শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মিসরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দুই বছর বয়সে তার বাবা ইন্তেকাল করেন। ফলে তার লালন-পালনের দায়িত্ব পড়ে চাচার ওপর। শৈশব মিসরেই কাটান।

শিক্ষা
মাত্র ১০ বছর বয়সে শায়খ কারজাভি কুরআনে কারিমে হাফেজ হন। এরপর আল আজহার কারিকুলামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় হন। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন
মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন শায়খ কারজাভি। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘Board of Religious Affairs’-এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’। ১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council-এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন । ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন।

আন্তর্জাতিক খেদমত
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন শায়খ কারজাভি। মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের অভিজাত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্সের (International Union of Muslim scholars) সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

একইসাথে জর্ডানের রয়্যাল অ্যাকাডেমি ফর ইসলামিক কালচারাল অ্যান্ড রিচার্জ (Royal academy for Islamic culture and research), ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ডের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আয়ারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া অ্যান্ড রিচার্জের (European Council For Fatwa and Research) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

রচনা ও গ্রন্থনা
আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক শতাধিক গবেষণা-গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তার গ্রন্থগুলো প্রকাশের পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে জ্ঞানী, গবেষক, বোদ্ধামহল ও সাধারণ মানুষের কাছে সেগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। তার গ্রন্থ সংখ্যা অন্তত ১৭০টি। এইকসাথে নানা সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে দেয়া তার বয়ান-বক্তৃতার রেকর্ড মুসলিম উম্মাহর বিরাট পাথেয় হিসেবে উপকার করবে বহু দিন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
শায়খ ইউসুফ কারাজাভি ১৪১১ হিজরিতে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরস্কার লাভ করেন। ইসলামী শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৪১৩ হিজরিতে মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও তার বৈচিত্র্যময় পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নানা পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন।

তার অন্যতম কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার : এক. কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ। দুই. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পদক, মালয়েশিয়া। তিন. আন্তর্জাতিক পবিত্র কুরআন সম্মাননা পুরস্কার, দুবাই। চার. সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ সম্মাননা, ব্রুনাই। পাঁচ. আল-ওয়াইস পদক, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ছয়. জর্ডানের মেডেল অব ইন্ডিপেন্ডেন্স ইত্যাদি।

কারাবরণ
ইখওয়ানুল মুসমিমিনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তাকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। প্রথমবার ১৯৪৯ সালে রাজকীয় আমলে। এরপর প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের আমলে তিনবার। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবার। একই সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার। এবার তিনি ২০ মাস কারাগারে কাটান। শেষবার ১৯৬৩ সালে।

দেশত্যাগ ও কারাদণ্ডাদেশ
মিসরীয় জাতিসত্ত্বার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শেষ জীবনের বড় একটি অংশ শায়খ কারজাভি কাতারে বসবাস করেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেই দেশ ত্যাগে বাধ্য হন তিনি। ২০১৫ সালে মিসরের একটি আদালত শায়খের অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে। এর আগে ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম বারের মতো কাতারে পাড়ি জমান।

বিবাহ ও সন্তানাদি
শায়খ কারজাভি দুইটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী মিসরীয়। তার নাম ইসআদ আব্দুল জাওয়াদ (উম্মে মোহাম্মদ)। তাকে বিয়ে করেন ১৯৫৮ সালে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তার তিন মেয়ে (ইলহাম, সিহাম, উলা ও আসমা) ও চার ছেলে (মোহাম্মদ, আব্দুর রহমান ও ওসামা) জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আয়েশা। তিনি মরক্কান বংশোদ্ভূত।

ইন্তেকাল
শায়খ কারজাভি আজ সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর/২৯ সফর) দুপুরে কাতারের রাজধানী দোহায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

সূত্র : আলজাজিরা, আলআরাবিয়া, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য