Naya Diganta

বিএনপির ভবিষ্যৎ

এমন একটি সময় ছিল যখন বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেগম জিয়া অথবা তারেক রহমানের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তারা ছাড়াও বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন এবং অনাগত দিনে কী হবে ইত্যাদি হাজারও প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে তারা রীতিমতো পেরেশানিতে পড়ে যেতেন। তারা অঞ্চল ভেদে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে প্রায়ই আলোচনায় বসতেন এবং দলের দুরবস্থার জন্য এক অঞ্চলের নেতারা অন্য অঞ্চলের নেতাদের দায়ী করতেন। এ ছাড়াও তাদের মধ্যে আরো নানা বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক হতো। দলের প্রবীণ নেতৃত্ব বনাম নবীন নেতৃত্ব, মনোনয়ন বাণিজ্য, কমিটি গঠন নিয়ে বিভিন্ন আপত্তি-অভিযোগ ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাজনৈতিক জোটটির অন্য শরিকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও আক্ষেপের নিষ্পত্তি করতে গিয়েও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব রীতিমতো হিমশিম খেতেন।
বিএনপির উল্লিখিত অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি দলটিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের ঠাট্টা মশকারা, বহুবিধ কূটনৈতিক চাল, মামলা-হামলা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা, অর্থনৈতিকভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের ক্ষতিসাধন এবং চাকরি-বাকরি-ব্যবসায়-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিয়েশাদি-প্রেম-ভালোবাসা-আনন্দ-বিনোদনে বিষ ঢেলে দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দলের সব স্তরের নেতাকর্মীদের শেষ করে দেয়ার নীলনকশার কারণে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছিল। বিশেষ করে দেশ-বিদেশ কাঁপানো কিছু গুম-খুনের ঘটনা, গায়েবি মামলার তাণ্ডব, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাজানো মামলা, মিথ্যা ও আজগুবি মামলা ছাড়াও হাতুড়ি বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, লগি-বৈঠার সৈনিক- ইত্যাদি শিরোনাম সংবলিত মনুষ্য সৃষ্ট আজাব-গজবে বিএনপিকে নির্জীব-নিঃশেষ এবং দেউলিয়া বানানোর যে কৌশল তাদের রাজনৈতিক শত্রুরা নিয়েছিল তা দলটির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

উপরি উক্ত অবস্থায় বিএনপি আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রামের মুরোদ নিয়ে কটাক্ষ করতে করতে আওয়ামী লীগের লোকজন ক্লান্ত-বিধ্বস্তও হয়ে পড়ছিল। ঠিক তখনই অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিএনপি হঠাৎ করে ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এসে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াল তা নিয়ে সরকারি দলে হিসাব-নিকাশ অথবা আতঙ্ক-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। বিষয়টি বিএনপিবিরোধী লোকজনের ওপর কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তা বুঝানোর জন্য এরশাদ জমানার একটি জনপ্রিয় কৌতুক বর্ণনার লোভ সামলাতে পারছি না।
এরশাদ জমানার শেষ দিকে কৌতুকটি বেশ মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছিল। যদিও ঘটনাটি ছিল নিছক রূপক মাত্র। কিন্তু আশির দশকের আবহমান বাংলার সরলসোজা মানুষগুলো ওসব রূপক-ঠুপক বুঝত না- তারা ঘটনাটিকে সত্যি ভাবত। কারণ এরশাদ শাসনামলে একটি লং ড্রাইভের গল্পের পর একটি পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ এবং রাজপথে বিএনপির দুর্দান্ত অবস্থানের কারণে বিএনপি সম্পর্কে মানুষের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ছিল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে অনেক বেশি। ঠিক সেই সময়ে এরশাদের নাপিতসংক্রান্ত কৌতুকটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। কৌতুকটি বলা হতো এভাবে, এরশাদের নাপিত চুল কাটতে গিয়ে সব সময় বিএনপি সম্পর্কে নানান কথাবার্তা বলা আরম্ভ করেন। এরশাদ এক দিন মহা বিরক্ত হয়ে নাপিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, আরে মিয়া তুমি এত বিএনপি বিএনপি করো ক্যান। নাপিত বললেন-স্যার! বিএনপির নাম শুনলে আপনার চুলগুলো সব খাড়ায়া যায়! আর তখন চুল কাটা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।

উল্লিখিত কৌতুকটি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসে মনে হবার মূল কারণ হলো আওয়ামী লীগের লোকজনের মধ্যে ইদানীংকালে যে বিএনপি ভীতি লক্ষ করা যাচ্ছে তা এরশাদ জমানার সেই বিএনপি ভীতির সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করছে। আওয়ামী লীগের লোকজন যেভাবে সকাল সন্ধ্যায় তারেক রহমানকে গালাগাল দিয়ে দানাপানি গ্রহণ করে অথবা বিএনপির নাম শুনলে তাদের মুখ যেভাবে বিকৃত হয়ে যায় তা আমরা নিকট অতীতে কোনো দিন দেখিনি। বিশেষ করে কট্টর বিএনপিবিরোধী লোকজন যাদের বয়স সত্তর বছরের বেশি এবং যারা নিজেদের বার্ধক্য লুকানোর জন্য বাহারি থেরাপি নেন এবং চোখমুখে নানান মেকআপ ও রঙচঙ মাখেন তারা এখন বিএনপিকে নিয়ে মহাবিপদে আছেন। কারণ বহু টাকা খরচ করে যারা নিজেদের গলা ও গালের চামড়ার ঝুলে যাওয়া লুকানোর জন্য থেরাপি নেন এবং যেখানে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সেসব থেরাপির কার্যকারিতা থাকার কথা তা বিএনপির কারণে এক ঘণ্টার মধ্যে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জনসম্মুখে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রায়ই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান।
বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং শত্রুদের মনে হঠাৎ করে কেন এত বিএনপিভীতি শুরু হলো অথবা বিএনপির নাম শুনলে কেন তাদের চিত্তে চঞ্চলতা দেখা দেয় অথবা তাদের শরীর কেন অস্থিরতায় কাঁপতে থাকে তা নিয়ে আরেকটি রসঘন নিবন্ধ লেখার চেষ্টা করব।
আজকের নিবন্ধে আমি বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকারণ এবং আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির সাথে বেসামাল আচরণ করছে তার কিছু বাস্তব নমুনা পেশ করব যার মাধ্যমে আজকের শিরোনাম অর্থাৎ বিএনপির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে!
বিএনপির দুর্ভোগ দুর্দশা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সাল থেকে যখন ক্ষমতার আধিপত্য এবং গণতন্ত্রের সাধারণ সূত্রের মধ্যে বিএনপির তৎকালীন এমপি-মন্ত্রী আমলা-কামলারা সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে এক-এগারোর দুর্বিষহ ধাক্কা এবং ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি বিএনপি যে চতুর্মুখী ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়েছে তার সাথে কেবল মরুঝড় সাইমুমের ভয়াবহতার তুলনা করা যেতে পারে। এক-এগারোর সময়ে বেগম জিয়ার ওপর যে চতুর্মুখী চাপ এবং পরে মা-ভাই এবং প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর বোঝা মাথায় নিয়ে তার টিকে থাকা এবং আজ অবধি অবিচল থাকার কার্যকারণ না বুঝার কারণেই- বিএনপিবিরোধীরা বিএনপিকে নিয়ে ঠাট্টা মশকারা করেছে তা প্রাকৃতিক কারণেই এখন তাদের জন্য গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

বিএনপির দীর্ঘ দিনের ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে যদি আপনারা চিন্তাভাবনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, অতীতে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ তাদের তাড়া করত। তৃতীয়ত, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা সময় সুযোগ এবং বিভিন্ন দেশী-বিদেশী চক্রের সাহায্য-সহযোগিতার ওপর নির্ভর করত। এর বাইরে তারা ২০১৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে অহেতুক ভয় পাওয়ার পাশাপাশি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়। তারেক রহমান নাকি বেগম জিয়া কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী অথবা তারেক রহমানকে বিএনপির কাণ্ডারি হিসেবে মেনে নিতে দলের অনেক অনেক সিনিয়র নেতার মধ্যে সঙ্কোচ ছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য করে দলের রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল করে দিতেন। উল্লিখিত অবস্থার কারণে বিএনপি বারবার ভুল করেছে কখনো বা বিভ্রান্ত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতারিত হয়েছে বা ঠকেছে এবং একেকটি ব্যর্থতার হাত ধরে যখন দ্বিতীয় ব্যর্থতার দিকে এগিয়েছে তখন তাদের সেই করুণ অবস্থা দেখে প্রতিপক্ষরা ইচ্ছেমতো ঠাট্টা-মশকারা করার সুযোগ পেয়েছে। পরাজয় ও ব্যর্থতার ধারাবাহিক হ্যাটট্রিকের পর বিএনপি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে তা যদি বিশ্লেষণ করেন তবে আপনি নিম্নলিখিত সমীকরণ দেখতে পারেন।
প্রথমত, বিএনপি এখন ক্ষমতায় যাওয়া, নির্বাচন করা, ভোটাভুটি ইত্যাদি বাদ দিয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে সরকারের যাবতীয় কুকর্মের বিরুদ্ধে। ফলে তাদের গন্তব্য নিয়ে অতীতে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল বা ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে যে বহুমুখী দেশী-বিদেশী সমীকরণের সাথে সময় নষ্ট করার ইতিহাস ছিল এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় এসে নির্ধারিত হয়েছে। তারা ক্ষমতায় যাওয়া, নির্বাচন ইত্যাদি পরিহার করে যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় এবং আওয়ামী লীগের সব কুকর্মের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের বিষয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে ঠিক তখনই তাদের কর্মে এক অলৌকিক গতিময়তা যুক্ত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অহেতুক ভয়-দ্বিধা ও সঙ্কোচ তাদের ২০১৬ সাল থেকে যেভাবে তাড়া করছিল তা থেকেও তারা সাম্প্রতিক সময়ে বের হয়ে আসতে পেরেছে। এর ফলে ২০২২ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে তারা বহু বছর পর আবারো খণ্ডিতভাবে বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করেছে। তারা এখন মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং বঙ্গবন্ধুর ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে বেশ খোলামেলা বক্তব্য দেয়া আরম্ভ করেছে। তারা শেখ হাসিনা নাম থেকে শেখ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু হাসিনা বলে সম্বোধন শুরু করেছে এবং কেউ কেউ তাকে হাসিনা ওয়াজেদ বলে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় অভিহিত করছে। তারা শেখ হাসিনার নামের সাথে পারতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শব্দটি যোগ করছে না এবং ভোট চোর শব্দটিকে ব্রান্ডিং করার ক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে শুরু করেছে।

তৃতীয়ত, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিষয়ে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে তারা তারেক রহমানকেই সর্বোচ্চ নেতা নির্ধারণ করেছে এবং নজিরবিহীনভাবে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীরূপে তারেক রহমানের নাম বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমিতিতে বারবার উচ্চারণ করে চলছে। এ অবস্থায় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপির কর্মকাণ্ডে এক ধরনের গতিময়তা এসেছে। তাদের ভবিষ্যৎ টার্গেট থেকে যখন ক্ষমতায় যাওয়ার লোভটি বাদ পড়েছে তখন তাদের কর্মকাণ্ডে বিস্ময়কর এক শক্তি ভর করেছে, যা দেখার পর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রীতিমতো ভড়কে গেছে। বিএনপি এখন নির্ভার ও নির্বিকারচিত্তে বলতে পারছে যে, হাসিনাকে বিশ্বাস করি না- তার অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয় এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোট চুরির সাথে জড়িত সবারই বিচার করা হবে, তখন বিএনপিবিরোধী শিবিরে যে সুনামি আরম্ভ হয় তা ইতঃপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি।
উল্লিখিত অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় বিএনপির ভবিষ্যৎ কী, সে ক্ষেত্রে তারা একবাক্যে বলবেন যে, ভোট চোরদের কবল থেকে দেশ উদ্ধার এবং চোরদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করাই বিএনপির একমাত্র ভবিষ্যৎ।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য