Naya Diganta
জসীমুদ্দিন মাসুম

একজন গণমানুষের ঔপন্যাসিক

জসীমুদ্দিন মাসুম

কথাসাহিত্যিক জসীমুদ্দিন মাসুম প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে ভাবনা নিয়ে তার গল্প সাজাতে অভ্যস্ত। মানবিক মন ও নিষ্ঠুর অসাধ্যকে বশে আনতে যে টানাপড়েনে ভোগেন মধ্যবিত্ত মানুষ তাতে অপরিসীম স্পর্শকাতরতা থাকে। থাকে ব্যক্তিক ও অর্থনৈতিক পরাজয়। আর এসবই মানুষের অন্তরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। মানুষ নিজেকে অকুল শূন্যতায় ভাসতে দেখে ভীতু হয়ে পড়ে। বস্তুবাদি সাহিত্যে আবেগের পরাভব বা বেষ্টনী খুব একটা কার্যকর নয় বিধায় কথাসাহিত্যিক জসীমুদ্দিন মাসুম মনোদৈহিক আবেগের সুচারু চরিত্রয়ানে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সমাজের অগ্রসরতার প্রধান উপজীব্য হচ্ছে নারী। এই নারীকে লেখক মর্যাদার আসনে দেখতে চান। তাই নারীকে সংসার ও কর্মের পরিমণ্ডলে অনুকরণীয় অবস্থানে ধরে রেখে আবর্তিত হয়েছে ক্রান্তিকালের মতো বড় ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বোধসম্পন্ন উপন্যাস, যেখানে ধর্মীয় কুসংস্কার, দারিদ্র্য, পারিবারিক সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক গতিময় জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে। দারিদ্র্য মূল্যবোধকে সাহসী করেছে। তাই ক্রান্তিকাল উপন্যাসের হেনা নামের চরিত্রটি নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বিবেকের সবকটি জানালা।
২০২১ সালে প্রকাশিত ‘দুই পুরুষ’ উপন্যাসে লেখক আবার নারীর মনস্তাত্ত্বি¡ক ভাবনা নিয়ে লিখেছেন। সাংসারিকভাবে পিছিয়ে থাকা নারীর মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন মূলত দুই প্রজন্মের দুই পুরুষের জীবনভাবনার মধ্য দিয়ে। সংসার ভাবনার কাহিনীচিত্রে প্রভাব ফেলেছে এ উপন্যাস। এ ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি, অপসংস্কৃতি, পারিবারিক নেতিবাচক গঠন-পাঠনকে তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে।
অতিসম্প্রতি প্রকাশিত ‘চন্দ্রস্নান’ উপন্যাসটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক পরাভাব ও মানবিক হতাশার একটি তথ্যচিত্র। মিহিরের মানবিক মূল্যবোধ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক সম্পত্তির নিত্তিতে পরিমাপ করা হয়- এই যে নিগূঢ় বাস্তবতা চলে আসছে সমাজে, তা মেনে নিতে পারে না মিহির। সেভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্ক কেন সহজ হবে না, কেন মানুষ মানুষকে কাঁদাবে? বেছে নেয় চাঁদের আলোর মায়াবী প্রভাবে তার জীবনকে আবিষ্কার করার এক জাদুকরী পন্থা। হয়ে ওঠে এক নয়া আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
প্রতিটি ঘটনাই একটি নতুন অভিজ্ঞতা। অসহিষ্ণুতা, মূল্যবোধের ঘাটতি- একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে তুলে ধরে। সাহিত্যালঙ্কারের প্রধান উপজীব্য বিষয় হচ্ছে একটি কাহিনীকে একটি দক্ষ ও গতিশীল ধারায় প্রবাহিত করা। অর্থবহ ও সাবলীলভাবে তা লিখে যাওয়া। সেই নিরিখেই সুলেখক জসীমুদ্দিন মাসুম তার গল্পে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া বর্ণনার পাশাপাশি বিস্তারিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত তার নিজস্ব বর্ণনার ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। তার গল্প পড়লে কখনো মনে হয় না- পড়ছি; বরং মনে হয় একটি সচিত্র প্রতিবেদন চোখের সামনে ঝুলে আছে। চরিত্রগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মগজে। তার সব গল্পের চরিত্র সমাজের বাস্তব পরিকাঠামোর অনুগামী। কোনো অমিল নেই। গদ্য সাহিত্যে বিচরণের পাশাপাশি তার লেখা অসংখ্য কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকায়। বই আকারে ‘বাইরে কখনো বৃষ্টি হয়নি’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলেও তিনি মূলত অনলাইন-অফলাইন পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তার যুক্তিপূর্ণ লেখার শক্তি দিয়ে মোহাবিষ্ট করেছিলেন লেখককে। ব্যক্তি পছন্দের জায়গা থেকে সুনীল, সমরেশ ও আবুল হাসানের গদ্য প্রভাবিত করেছে লেখককে। হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটি আবেগি লেখার অসম্ভব প্রভাব রয়েছে লেখকের গদ্যে। এটিকে ঠিক অনুকরণ না বলে অনুসরণ বলা যেতে পারে। ব্যক্তিজীবনে যুক্তিতে বিশ্বাসী, এক সহজ-সাদা মনের জীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন ঔপন্যাসিক, যেখানে পেশা ও সাহিত্যচর্চার ভেতরে কোনো বিরোধ বিরাজমান নেই। ভালো প্রেক্ষিত নিয়ে লিখে যাওয়ার উদগ্র বাসনা পোষণ করেন তিনি।