
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব
- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০৬

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বুধবার দেশের সামরিক রিজার্ভের আংশিক সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমারা রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। একই সাথে তারা পূর্ব ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলে আগামী দিনে রাশিয়ার গণভোটের পরিকল্পনাকে আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এর মোকাবেলায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই নিষ্পত্তিতে সব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি ইউক্রেন সঙ্কট বৃদ্ধির সুস্পষ্ট লক্ষণ, বিশেষ করে যখন পশ্চিমা ব্লক চলমান জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদকে রাশিয়াবিরোধী মঞ্চে পরিণত করেছে, উত্তেজনা বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে এবং আলোচনা ও শান্তির সুযোগ আরো ম্লান করছে। পুতিন বুধবার জাতীয় টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সক্রিয় পরিষেবায় সামরিক রিজার্ভ জনবলকে তলব করার সুপারিশ করেছে। আর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এটি যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছে রুশ গণমাধ্যম আরটি। আরটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটি ইউক্রেনের পুরো পশ্চিমা সমরযন্ত্রের সাথে লড়াই করছে। আর পুতিন কিয়েভকে মস্কোর সাথে শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার জন্যও অভিযুক্ত করেছেন।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রিজার্ভ সমাবেশের ডিক্রির আওতায় ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য তিন লাখ অতিরিক্ত কর্মীকে ডাকা হবে। তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার জন্য যুদ্ধ করবে। রয়টার্স বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার প্রথম রিজার্ভ তলব। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এটিকে জাতির উদ্দেশে পুতিনের দেয়া একটি বিরল ভাষণ হিসেবে বর্ণনা করেছে, কারণ রাশিয়া ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দোনেস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া এবং খেরসনকে নিজ মানচিত্রভুক্ত করার জন্য ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর গণভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর পুতিন এই ভাষণ দেন। পুতিন বুধবার আরো বলেন, রাশিয়া ‘এই অঞ্চলে গণভোটের সুরক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।’ কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যদি চারটি অঞ্চলে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তবে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধ আরো জটিল হয়ে উঠবে। আর এই সঙ্ঘাতটি রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে নিয়ন্ত্রণবহিভর্‚ত সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শান্তি আলোচনার সুযোগ হারানোর কারণও হতে পারে। কারণ, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে একটি স্থায়ী ফাটল তৈরি হতে পারে এই পদক্ষেপে। এটি বিশ্বকে এক ট্র্যাজিক পরিস্থিতি ও অভূতপূর্ব একটি সঙ্কটের দিকে নিয়ে গেছে। পুতিনের রিজার্ভ তলবের আদেশে দেখা যায় যে, রাশিয়া বর্তমান অপারেশনগুলোতে এবং ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণে কৌশলগত সমন্বয় করেছে। এটি চিহ্নিত করে যে, সঙ্ঘাত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে দ্ব›দ্বটি প্রসারিত এবং দীর্ঘায়িত হবে। আর উভয়পক্ষই একটি নিরঙ্কুশ সুবিধা এবং এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে মরিয়া হয়ে উঠবে, আর আলোচনার সম্ভাবনা এতে কমে যাবে।
পুতিন তার বক্তব্যে পশ্চিমাদের সতর্ক করেছেন যে, তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে ‘ব্লাফ’ করছেন না, যদিও কিছু চীনা বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে, এটি ইউক্রেনকে আরো অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে পশ্চিমকে সতর্ক করার একটি কৌশল। তবে সঙ্ঘাত বাড়ার সাথে সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে বৃহত্তর প্রাণঘাতী অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ছে। এই সময়টাতে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের ঝুঁকি কমানোর জন্য দুই পক্ষের মধ্যে বিশেষ করে রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ, ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমের অস্ত্রের সমর্থনে তাদের পাল্টা আক্রমণে রুশ দখল থেকে অনেক ভূখণ্ড মুক্ত করেছে।
এখন এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যাতে দুই পক্ষ এক অসম্ভব যুদ্ধ জয় অর্জন করতে চাইছে। ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করতে মস্কোর সফল হওয়ার মানে হলো ইউরোপের দেশগুলো চূড়ান্তভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়া। এটি কোনোভাবেই তারা চাইবে না। অন্য দিকে রাশিয়ার ইউক্রেনের কাছে হেরে যাওয়ার অর্থ হবে রাশিয়ার পরাশক্তির ভাবমর্যাদা ভূ-লুণ্ঠিত হওয়া। পুতিনের মতো মানুষ দেশটির নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় এটি কল্পনা করা কঠিন। এই অবস্থায় চূড়ান্ত বিজয় মানে হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়া যেখানে একপক্ষে থাকবে রাশিয়া ও তার মিত্ররা আর অন্য দিকে থাকবে পুরো পশ্চিমা শক্তি। চীনের এই মুহূর্তে এই মহাযুদ্ধে সরাসরি পক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ধরনের একটি প্রলয়ঙ্করী অবস্থা থেকে সমঝোতার উদ্যোগই বিশ্বকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারে। এই সমঝোতার জন্য উদ্যোগী হতে পারে তুরস্ক ও চীন, যে উদ্যোগে যুক্ত থাকতে পারেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব।
mrkmmb@gmail.com