Naya Diganta

‘মানুষ মুখ খুলতে ভয় পায়’

অপ্রিয় সত্য কথা বলতে নেই। প্রবাদের মতো মানুষ এটি মনে রাখে। সে সত্য কথা বলতে ভয় পায়। যারা সবসময় সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নেয় তারা সত্য বলতে পারে না। পাছে তার কিছু ঘটে! কিন্তু সমাজে সবকালে সব দেশে এমন সব মহৎ মানুষ ছিলেন যারা সত্য কথা বলতে কখনো ভয় পেতেন না। বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রে এই দুঃসময়ে অনেক মানুষ মুখ গুঁজে আছেন। কিন্তু আবার কিছু লোক আছেন যারা সুবিধা-অসুবিধা চিন্তা না করেই নিরেট ও নির্মম সত্য কথাটি বলে ফেলেন।
বাংলাদেশে গৌরব করার মতো এমন কিছু মানুষ আছেন যারা সবসময় সত্য কথাটি বলেছেন ও বলছেন। দেশের বর্ষীয়ান ও শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এদেরই একজন, যিনি গোটা জীবনে এর সাক্ষ্য দিয়ে চলেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, দেশে রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরাজ করছে। তিনি আরো বলেন, দেশে মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। তারা আত্মহত্যা করে। দুর্ঘটনায় মারা যায়। ধর্ষণ চলে। সর্বোপরি যে রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরাজ করছে, তার কারণে মানুষ মুখ খুলতে অত্যন্ত ভয় পায়। কী বললে কী হবে- সে আতঙ্কে থাকে। ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে একটি গবেষণাকেন্দ্রে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ওই সভার আয়োজন করা হয়। পুঁজিবাদ মানবসভ্যতার সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে মন্তব্য করে এই বুদ্ধিজীবী বলেন, বাংলাদেশে এমন একজনকে সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হলো, যিনি খুনের মামলার আসামি। ছেলে সুপারিশ করে তাকে পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। আগেরবার আরেক জনকে পুরস্কার দেয়া হলো তার নামই কেউ শুনেননি। এগুলো সবই হচ্ছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র সে প্রথম থেকেই একটি ভীতির রাজত্বে বাস করছে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালের কথা যদি উচ্চারণ করি তাহলে সেখানে লাল-নীল, সবুজ বাহিনীর ভীতির রাজত্ব লক্ষ করি। যিনি গণতন্ত্রের জন্য জীবনপাত করলেন তিনিই গণতন্ত্রের কবর দিলেন। ভীতির নিরঙ্কুশ রাজত্ব কায়েম করলেন- এটি ভাবতেই বেদনাহত হতে হয়। সংবিধানপ্রণেতারা ব্যক্তির অধিকারকে নিরঙ্কুশ করার জন্য সংবিধানে বাধ্যবাধকতা লিপিবদ্ধ করলেন। ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সবিস্তারে এসব মৌলিক স্বাধীনতার উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানটি নাগরিক অধিকার রক্ষার্থে একটি ভালো সংবিধান বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে বাস্তব তত্ত্বের দ্বন্দ্বে সংবিধানের প্রায়োগিক অবস্থান যে প্রায় শূন্যের কোঠায়, সচেতন নাগরিক মাত্রই তা অনুধাবন করেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার পর দু’বছর যেতে না যেতেই মূল সংবিধানের চেতনাবিরোধী দ্বিতীয় সংশোধনী-১৯৭৩ গৃহীত হয়। ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিঃআক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন গৃহীত হয়। এতে যে কাউকে অনির্দিষ্টকালীন সময়ের জন্য আটক রাখার বিধান করা হয়। অথচ এটি ছিল সংবিধান অনুচ্ছেদ-৩৩-এর হুবহু বিপরীত। ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল- ‘গ্রেফতার করতে কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্রই গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
অনুচ্ছেদ-৩৩-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে- ‘গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’ গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখা যাবে না। পরবর্তীকালে এসব বিধানাবলি অগ্রাহ্য করে কিভাবে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং অবশেষে বাকশাল কায়েম করা হয়- সে এক করুণ ইতিহাস। এই সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ছিল সবচেয়ে শক্ত ও প্রতিবাদী বিরোধী দল। এখনকার আনি, দুয়ানি ক্ষমতার অংশীদার হাসানুল হক ইনুরা দাবি করেছিলেন- ১৯৭২-৭৫ সময়কালে তাদের ৪০ হাজার কর্মীকে গুম অথবা হত্যা করা হয়।
সামরিক শাসন অবসানে গণতন্ত্র নামকাওয়াস্তে কায়েম হলেও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র কায়েম হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘সংসদীয় স্বৈরাচার’ বলে একটি প্রত্যয় রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা ভিন্নতর কিছু। গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরের সুনাম! একটি রাজনৈতিক দলের যেন একান্ত অঙ্গীকার। বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে কীরকম ভয় পায় তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৯১ সালের নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে এটি ছিল সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তারা ভেবেছিল জনগণ তাদের একচেটিয়া ভোট দিয়ে দেবে। তারা ছায়া মন্ত্রিসভাও গঠন করে ফেলেছিল। কিন্তু জনগণ তাদের কথিত সামরিক ছাউনি থেকে আসা দলটিকে ভোট দিয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারে সাধারণভাবে স্বাভাবিকভাবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসা তাদের জন্য একরকম অসম্ভব। ১৯৯৬ সালে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির বিভাজনের সুযোগে জাতিকে ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করে তারা ক্ষমতাসীন হয়।
২০০১ সালে আবারো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের আমলে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাকে নির্বাচন বাতিলের আবদার জানায়। তিনি সে আবদার রক্ষা না করায় তাকে বিশ^াসঘাতক বলে অভিহিত করে। তারা যখন বুঝতে পেরেছে, জনগণের ভোটে নয় অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো অবয়ব ছাড়া তাদের ক্ষমতা লাভের কোনো সুযোগ নেই, তখন তারা দেশী-বিদেশী শক্তির যৌথ ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে ভীতির নিকৃষ্ট মহড়া প্রদর্শিত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করে তোলা হয়। প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল সামরিক অবয়বে তাদেরই সরকার। ওই দু’বছরে ভীতির মহড়ার মধ্যেই দেশ অতিক্রম করে। ২০০৮ সালের শেষ দিনের পাতানো নির্বাচনের পর থেকে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত (২০২২ সাল) সে ভীতির রাজত্ব স্থায়ীভাবে কায়েম হয়। বিগত প্রায় ১৫ বছরে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, মামলা ও হামলার মাধ্যমে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।
বিগত দেড় দশকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অনিবার্য বিভাজন- আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে নিরেট একক ব্যক্তিত্বের অধীন করা হয়েছে। আইনসভা কার্যকারিতা ও মর্যাদা হারিয়েছে। নির্বাহী বিভাগ/আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। বিচার বিভাগকে অধীনস্থ করা হয়েছে। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অনেক অন্যায় করার পর যখন তাদের প্রতি অবাধ্য হলেন তখন তাকে অন্যায়ভাবে অপদস্থ করে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ একক নেতৃত্ব যে ভীতি সৃষ্টি করেছে তার প্রতিবাদ বা প্রতিস্থাপনের জন্য জাতীয় কোনো ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান আর কার্যকরী নেই। সব রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সিভিল সোসাইটি ও পেশাজীবী নেতারা একমত যে, সারা দেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্টটি এতটাই গুরুত্ব পেয়েছে যে, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচেলে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তিনি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিগত সময়ে এই সরকারের আমলের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা আমলে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সাম্প্রতিক ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার দলনের প্রতীকী প্রতিবাদ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের প্রায় ৫০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে এক হাজার ২০০ নেতাকর্মী। মামলা হয়েছে ৩৫ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে। অন্যান্য বিরোধী দলেরও অভিযোগ একই রকম। ২০২৩ সালের নির্বাচন যখন আসন্ন তখন নতুন করে তারা বিএনপি ও বিরোধী দল নিধন প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তার কার্যালয় ঘেরাও হলে তিনি তাদের চা-নাশতা খাওয়াবেন। তাদের দলের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, বিরোধী দলের আন্দোলনে তারা বাধা দেবেন না। অথচ কর্মসূচি শুরু করার পর সারা দেশে মারমুখী হয়েছে পুলিশ। ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিবর্ষণে ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন তিনজন বিএনপি নেতাকর্মী। সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, এসব হামলায় ১০০ জন গুলিবিদ্ধ ও ৩০০ জন আহত হয়েছেন। অথচ তারা প্রতিদিন বিএনপির গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন।
তারা বিএনপির প্রতিটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সহিংসতা আবিষ্কার করছেন। আজগুবি ও গায়েবি মামলা দিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জে যুবদলকর্মী শাওন হত্যার পর তার ভাইকে বাধ্য করেছেন বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা দিতে। অন্যায়ের কত রূপ আছে তা বর্ণনা করা কঠিন। ডিজিটাল আইন-২০১৮-এর বেপরোয়া প্রয়োগ চলছে। ঢাকায় বিরোধী দলের পাড়া-মহল্লøা নেতাদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। উদ্দেশ্য- আগামী নির্বাচন যেনতেন প্রকারে জয়লাভ। ক্ষমতাসীনদের কথা ও কাজের মিল নেই। যেমনটি বলছেন, করছেন তার বিপরীতটি।
তাদের সোনার ছেলেরা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে। সেখানে গেস্টরুমে যেতে দেরি হলেও নির্যাতন করা হয়। যেখানে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এসব ব্যাপারে সতর্ক করার কথা, তিনি উল্টো সাফাই গাইলেন। পুলিশকে তিনি আশকারা দিলেন। বললেন, তারা আক্রান্ত হলেও কি নিজেকে রক্ষার অধিকার থাকবে না। অথচ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ নিরীহ ও নিয়মতান্ত্রিক মিছিলের ওপর হামলা করেছে। একসময়ের বিশ্বস্ত জাতীয় পার্টির জি এম কাদের সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভালো কথা বলছেন। সে মৃদু সমালোচনাকেও ধারণ করতে পারছে না আওয়ামী লীগ। তার গাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। মোবাইল চুরি হয়েছে। তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। রওশন এরশাদকে ব্যবহার করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে। ভয় দেখিয়ে জয় করার নীতি প্রথম থেকেই অনুসরণ করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো নীতিনৈতিকতা ও ভদ্রতা-সৌজন্যের তোয়াক্কা করছেন না। বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে যে কথাগুলো তারা বলছেন, তা শালীনতা থেকে বহু দূরে।
এই সরকার ইসলামী দলগুলোর প্রতি ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট’ অর্থাৎ নির্যাতন ও সুবিধাদানের দু’মুখো নীতি অনুসরণ করছে। তাদের বাগে আনতে যেমন রক্ত ঝরেছে, তেমনি তাদের গণভবনে আমন্ত্রণ করতেও দ্বিধা করেনি। এখন ‘কওমি জননী’ তাদের ওপর নতুন করে খড়গহস্ত হয়েছেন। তাদের এক নেতার চরিত্রহনন হয়েছে। আলেম-ওলামারা অভিযোগ করছেন, তাদের প্রায় দুই হাজার লোক জেলে আছেন। মাদরাসাগুলোতে সরকারের নজরদারি চলছে। আলেম-ওলামারা ভীতির মধ্যে বসবাস করছেন বলে গণমাধ্যমে কথা আসছে।
এখনো জঙ্গিবাদের নামে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি যারা করেন তাদের পাকড়াও করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখানো কিংবা তাদের মারধর করার কাজটি এতদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একতরফা এখতিয়ারে ছিল। এখন এই কাজে সরকারি দলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশংসা ও প্রশস্তির প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ইদানীং তারা বিরোধী কর্মী ও সাংবাদিকদের পেটানোর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। উদ্দেশ্য- ঘরে-বাইরে সর্বত্রই একটি ভীতির রাজত্ব তৈরি করা।
সর্বশেষ প্রবণতা হচ্ছে ঘরে ঘরে আগুন দেয়া। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় এ ধরনের ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ ছাপা হয়েছে। আগে শুধু অফিস আক্রান্ত হতো, এখন বাসাবাড়িও নিরাপদ নয়। বিএনপির কার্যালয়গুলো নানা অজুহাতে দখল করা হচ্ছে। বিগত ১৫ বছরে বিএনপি নেতাদের সহায়-সম্পত্তি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাতে দখল করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরে এই প্রবণতা গ্রামগঞ্জে পৌঁছায়নি। এখন গ্রামগঞ্জ থেকেও অনুরূপ অসংখ্য অভিযোগ আসছে। বিরোধী বা সরকারি অথবা সংখ্যালঘুদের জমিজমা জবরদখল করে নিচ্ছে।
যারা আওয়ামী লীগ করে না এমনকি নিরপেক্ষ লোক- তারাও তাদের হামলা-মামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। যাকে তাদের পছন্দ হয় না বা বিরোধী মনে হয় তাকে অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক তকমা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হচ্ছে। নির্বাচনের কাজে যাতে কোনো আওয়ামী লীগবিরোধী লোকজন শরিক না হতে পারে সে জন্য তারা অনেক আগে নির্বাচন কমিশনে তালিকা দিয়েছিল। এখন খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজছে সরকারি গোয়েন্দারা। যাতে এসব লোক আওয়ামী লীগের নি-িদ্র নির্বাচনী কারসাজিতে কোনোরকম বাধা দিতে না পারে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণেও তারা ভীতির নীতি গ্রহণ করেছে। বিগত বছরগুলোতে তারা প্রতিবাদী চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বেআইনি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রকাশনায় বাধা দিয়েছে। দু-একটি কারসাজি করে দখলও করেছে। ব্যাংক ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কায়দা করে দখল করেছে। ইদানীং হাত বাড়িয়েছে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর দিকে। অজুহাতের শেষ নেই। একটি ভীতির সর্বগ্রাসী অবস্থা গোটা জাতির ওপর আপতিত হয়েছে।
আবারো ফিরে যাই বরেণ্য শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে। তার সেই বক্তৃতার অবশেষে তিনি বলেছিলেন, এই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রগতিশীল মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। সঙ্গতভাবেই প্রগতিশীল মানুষ সমাজ অগ্রগতির ধারক ও বাহক। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তার এই আহ্বান মূলত বাংলাদেশের সব মানুষের প্রতি। এই ভীতির অবস্থা অবসানের দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করা প্রয়োজন। সে প্রয়োজন ব্যক্তির নয়, দলের নয়; বরং গোটা জাতির। লেখক সংঘের এবারের সম্মেলনের স্লোগান ছিল- ‘ভয়ের মাঝে অভয় বাজাও, সাহসী প্রাণে চিত্ত জাগাও’। সেই হোক পুরো জাতির স্লোগান। হ
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com