Naya Diganta

ফিস্টুলা নারীকে অবহেলা নয়

ফিস্টুলা নারীকে অবহেলা নয়

বেশ কিছু বছর আগে আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করি। গাইনি বিভাগে কাজ করার সময় দেখলাম আলাদা একটা ওয়ার্ড, নাম ফিস্টুলা ওয়ার্ড। এখানের রোগীরা বেশির ভাগই কম বয়স্ক, ২০-৩০ বছরের। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীই শারীরিকভাবে দেখে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। তবে মানসিকভাবে তারা খুবই বিষণœ থাকেন। প্রায় চার মাস কাজ করার কোনো দিন এ ওয়ার্ডের কোনো রোগীকে হাসতে দেখিনি কোনো দিন। একদিন কাজ করছি, একটি মেয়ের বয়স ১৮ বছর বা তারও কম হবে, তার কান্না আমাকে বিচলিত করল। নিজে থেকে তার সম্বন্ধে জানতে বেশ আগ্রহ বোধ করলাম। যা শুনলাম তাতে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে খুব বেগ পেতে হলো। এ মেয়েটি একটি স্কুলের মেধাবী ছাত্রী ছিল, মনে করি ওর নাম আশালতা। গ্রাম্য এ মেয়েটি ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তার মা-বাবা জোর করে তার বিয়ে দেয় তার চেয়ে ১৫ বছরের ছেলের সাথে। খালার বাড়িতে পালিয়ে গিয়েও রক্ষা হয়নি আশালতার। বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বছর ঘুরতেই গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে আশালতা। কিন্তু গর্ভাবস্থায় একবারও চিকিৎসককে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। প্রসববেদনা উঠলে গ্রামের অশিক্ষিত দাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রসব ব্যথা পুরো একদিন থাকলেও সন্তান প্রসবের নামগন্ধ নেই। দাইও ছাড়ার পাত্র নয়। ঝাড়ফুঁক থেকে শুরু করে তাবিজ সব শেষ হলে হাসপাতালে নিতে বলে আশাকে। স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক জানান, অপারেশন ছাড়া কোনোভাবেই শিশু বের করা সম্ভব নয়। তারা আরো জানান, তার ও তার শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। অবশেষে অপারেশন করে মৃতপ্রায় শিশুকে ভূমিষ্ট করা হয়। যদিও বাঁচানো যায়নি তাকে। এ যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও আশার সামনে অপেক্ষা করে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। কয়েক দিন পর দেখা যায়, তার যোনিপথে প্রস্রাব ঝরছে। প্রথমে একটু একটু হলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। লজ্জায় মেয়েটি চেপে রাখে তার সমস্যা। শরীরে তার দুর্গন্ধও থাকে। এদিকে স্বামীধন যৌনমিলনে তৃপ্তি পান না। সংসারে শুরু হয় অশান্তি। কী করবে ভেবে দিশা পায় না আশা।
সমস্যা আরো বেড়েই চলে। স্বামী বিরক্ত হয়, মারধর করে। শেষে স্বামী তার মাকে জানায়। শাশুড়ি জানায়, আশা চরিত্রহীন বলে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। মারধর করে স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় আশাকে। স্বামী কয়েক মাসের মাথায় নতুন বউ ঘরে আনে। এদিকে বাবার বাড়িতে কষ্টের সীমা নেই তার। দুর্গন্ধে তার কাছে কেউ আসে না। কারো সাথে মিশতেও পারে না সে। ধীরে ধীরে একাকিত্ব তাকে পেয়ে বসে। একবার আত্মহত্যাও করতে যায়। পরে এক স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারে এ রোগের চিকিৎসা আছে। তার পরামর্শে সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। আশালতার কথা আমি ভুলতে পারি না। সে বলেছিল, দাদা আমার খুব স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু আমার জীবনটা শেষ করে দিল অল্প বয়সে বিয়ে। এখন এ জীবন রেখে কি লাভ? তাকে বুঝালাম, চিকিৎসা করলে তুমি সুস্থ হবে। আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। অপারেশনের পর আশালতা তার শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেলেও সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছে কি না জানা হয়নি আর।
আশালতা যে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিল সেটির নাম ফিস্টুলা, প্রসবজনিত ফিস্টুলা। বিলম্বিত প্রসবের কারণে যদি শিশুর মাথা ৩-১২ ঘণ্টা যোনিপথে আটকে থাকে তাহলে যোনিপথের আশেপাশের মাংসল অঙ্গ যেমন মুত্রথলি বা পায়ুপথে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মাংসপেশীতে পচন ধরে। শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর সেখানে ছিদ্র হয়। এ কারণে মাসিকের রাস্তায় অনবরত মূত্র বা মল ঝরা শুরু হয়। এটিকেই বলে প্রসবজনিত ফিস্টুলা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর ৫০ হাজার থেকে এক লাখ নারী এ সমস্যায় আক্রান্ত হন। এদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের দেশের। বেশির ভাগ রোগীই ৩০ বছরের কম বয়সী। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ লাখ নারী এ সমস্যায় জর্জরিত।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার অন্যতম কারণগুলো হলো : বাল্যবিয়ে, কিশোরী মা, অপুষ্টি, জরুরি প্রসূতি সেবার অভাব, দক্ষ দাইয়ের অভাব, বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসবসম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন, প্রসবপরবর্তী চিকিৎসা অপ্রতুলতা, রোগকে গোপন করে রাখা, আধুনিক চিকিৎসার ওপর নির্ভর না করা, অশিক্ষা ইত্যাদি। অনেকে মনে করেন চিকিৎসকের কাছে গেলে অপারেশন করতে বলবেন। এটা ভ্রান্ত ধারণা। আবার চিকিৎসক সিজারিয়ান অপারেশন করতে বললেও অনেকে তা না করে শুধু সময় নষ্ট করেন। যদি প্রসব বিলম্বিত হয় তাহলে সিজারিয়ান অপারেশন না করলে তা যেমন প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ হতে পারে তেমনি তা মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অনেকে মনে করেন দুশ্চরিত্রা মেয়েদের এ রোগ হয়। এটি একেবারে ভুল ধারণা।
এ রোগটির আধুনিক চিকিৎসা আছে। ১০টি সরকারি হাসপাতালে এর বিনামূল্যে চিকিৎসা হয়। হাসপাতালগুলো হলো : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ সিলেট ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চিকিৎসা করালে এ রোগ পুরোপুরি সেরে যায়। শরীরে দুর্গন্ধ থাকে না। প্রসাব বা মল ঝরা পুরোপুরি বন্ধ হয়। রোগাক্রান্ত অবস্থায় যৌনমিলনে কষ্ট হলেও চিকিৎসায় তা পুরোপুরি সেরে যায়। অনেকে মনে করেন এ নারীরা সন্তান ধারণে অক্ষম হন। এটি কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়।
এ নারীদের অবহেলা করা উচিত নয়। তাদের পরিবার থেকে বের করে দেয়াও ঠিক নয়। এটা অন্যান্য রোগের মতোই একটি রোগ। চিকিৎসা করালে এ রোগ পুরোপুরি সেরে যায়।
এ রোগ প্রতিরোধে মেয়েদের বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। কিশোরী মা প্রতিরোধ করতে হবে। মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়া যাবে না। বিশের আগে সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কমপক্ষে চারবার। প্রসব করাতে হবে দক্ষ দাই দিয়ে। ঘন ঘন সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সচেতন হলেই রক্ষা পাবে নারী, মা, মেয়ে।