Naya Diganta
অ নু গ ল্প

সহায়হীনা

অ নু গ ল্প
সহায়হীনা

‘আম্মা, ইলিশ মাছ খাইতে কেমন?
সাত বছরের ছেলের মুখে কথাটা শুনে চকিত তাকালেন আয়না বেগম। চায়ের কচি পাতার মতো ঘুমে নেতিয়ে পড়া মেয়ে শিশুটিকে সামনে ওড়না দিয়ে বাঁধতে গিয়ে থেমে গেলেন।
আবারও একটা সদুত্তরের আশায় প্রশ্ন এলো, ‘ও আম্মা, কও না কেন? ইলিশ মাছ খাইতে কেমন?’
‘আচমকা এই কথা কেন, বাজান?’
‘আমি যেই ইশকুলে পড়ি, ওইখানকার একটা পোলা আমারে কইছে ইলিশ মাছের নাকি মেলা দাম! তাই জিজ্ঞাস করছি স্বাদটা কেমন!’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আয়না, ‘আমিও খাই নাই কহনও।’ মেয়ে শিশুকে ওড়না দিয়ে বুকে বেঁধে নিলেন। পিঠে বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে তৈরি বড় ঝুড়িটা পিঠে বেঁধে বললেন, ‘এই মাসেরও বেতনটা দিতে পারমু না রে বাপ। মাস্টাররে বুঝাইয়া কইস। নইলে লগের ইশকুলটাতেই পড়িস।’
‘কী কও, আম্মা?’ ছোট্ট কণ্ঠে প্রতিবাদের ঢেউ। ‘তুমি না কও আমার ডাক্টার অইতে ইব? ওই ইশকুলে তো পড়ালেহা হয় না।’
কোনো উত্তর না করে চোখের কোণে চিকচিক করা অশ্রু নিয়ে চা পাতা তুলতে বেরিয়ে পড়লেন আয়না। আজ কেউ যাবে না। চা শ্রমিকরা সবাই অবরোধ করেছে। সারা দিন ঘাটুনি করে ১২০ টাকায় ঠিক পোষায় না। কিন্তু আয়না পারেনি। একাই এসেছেন চা পাতা তুলতে। হাহাকারে মুষড়ে পড়া একজন বাংলাদেশী চা শ্রমিক তিনি। স্বামী পাগল, বেকার। কিচ্ছু করে না। সারা দিন পথেঘাটে পড়ে থাকে। তাই এই ১২০ টাকাই তার সম্বল। অন্যদের মতো অবরোধ করলে বাকি দিনগুলো না খেয়ে কাটাতে হবে। পান্তার সাথে মরিচ কেনারও যে সম্বল নেই তার!
চা বাগান বিষাক্ত জিনিসে ভরপুর। সাপ, পোকামাকড় কী নেই এখানে! এত কষ্ট, এত ভয়ে ভয়ে সারা দিন কাজ করে মাত্র ১২০ টাকা। চা শ্রমিকরা বুঝি মানুষ নয়?
এতসব ভাবতে ভাবতে চা পাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আয়না। দেখতেও পান না পাশেই ফণা তুলে থাকা বিষাক্ত সাপকে!
আয়নার অজান্তেই ছোবল মারে সাপটা। হঠাৎই এমন পরিস্থিতে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন তিনি। বিষের ভারে নুয়ে পড়েন। যন্ত্রণায় চিৎকার করেন। কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। মুখ থুবড়ে পড়েন তিনি। বুকে বাঁধা থাকা তিন মাসের কন্যা গড়িয়ে পড়ে। নিঃশব্দের বুক ফুঁড়ে কেঁদে ওঠে শিশুটি। অজানা আশঙ্কা নিয়ে শেষবারের মতো কন্যার দিকে তাকান আয়না। কিছুক্ষণ পরেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। থেমে যায় এক নিম্নবিত্ত মায়ের ছেলেকে ডাক্তার বানানোর মহান লক্ষ্য।