Naya Diganta

দিল্লি সফরের তাৎপর্য

দিল্লি সফরের তাৎপর্য

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের তাৎপর্য নিয়ে তার সফরের আগে ও পরে বেশ আলোচনা হয়েছে। এই সফরের অর্জন কী তা নিয়েও কম বেশি কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে উচ্ছ্বাস অথবা নির্দয় সমালোচনা যতটা হয়েছে ততটা গভীর বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক আর টানাপড়েন দুটোই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। দু’দেশের নির্ভরতা এবং খানিকটা প্রতিযোগিতাও রয়েছে নানা ক্ষেত্রে। এক দেশকে তার ন্যায্য অধিকার দিতে গেলে অন্য দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবার বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। সাধারণভাবে এ ধরনের স্বার্থ সঙ্ঘাতের নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিবিধান থাকে। কিন্তু শক্তিমান দেশগুলো দুর্বল দেশের ক্ষেত্রে সে আইন বা বিধান মানতে চায় না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরের সময় সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, মহাকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সম্প্রচার এবং দুই দেশের রেল ও বিচার বিভাগীয় কর্মীদের মধ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। তবে দুই দেশের শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরের জন্য এতটা গুরুত্ব হয়তো রাখে না এসব বিষয়। সফর শেষে প্রকাশ হওয়া যৌথ বিবৃতিতে দুই নেতা ঐতিহাসিক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বন্ধন এবং গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের শেয়ার্ড মূল্যবোধের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক এবং জনগণের মধ্যকার সম্পর্কসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ধারা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, আইসিটি, মহাকাশ প্রযুক্তি, সবুজ শক্তি এবং নীল অর্থনীতির মতো সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতায় সম্মত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের একবারে শেকড়ে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, নয়াদিল্লি ঢাকার সাথে সম্পর্কের বিষয়টিকে দেখে এই ভূখণ্ডটি যাতে সব সময় তাদের রাডারের মধ্যে থাকে। শত্রু কোনো দেশ যেন এখানে প্রভাব বিস্তার করে ভারতের জন্য ক্ষতিকর কিছু না করতে পারে আর দেশটির প্রতিরক্ষা জ্বালানি-বিদ্যুৎ এবং অর্থনীতি-বাণিজ্যের মতো মৌলিক বিষয়ে এমন কিছু নির্ভরতা তৈরি হয় যাতে বাংলাদেশ এই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির প্রভাব বলয়ের বাইরে যেতে না পারে। অন্য দিকে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে দেশের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এমনভাবে একক কোনো দেশের সাথে সম্পর্কে না জড়িয়ে বৃহৎ শক্তিসমূহের সাথে যথাসম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। অভিন্ন নদী ও পানিসম্পদের ন্যায়ানুগ অংশ পাওয়া, বাণিজ্য ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার মতো অবকাঠামো নির্মাণে পরস্পর সহযোগিতা করা।

এই মৌলিক বিষয়কে সামনে রাখা হলে ভারতের সাম্প্রতিক আনুষ্ঠানিক এজেন্ডার মূল অংশজুড়ে আমরা দেখতে পাই ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়টি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট ও বড় দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার বলতে কৌশলগত সমরাস্ত্র সংগ্রহ, প্রতিরক্ষা কৌশল ও প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ প্রস্তুতি ও যৌথ মহড়া এবং অন্য দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে আসে। প্রতিরক্ষা খাতের যুদ্ধ সরঞ্জাম বা সমরাস্ত্রে ভারতের ওপর কোনো নির্ভরতা বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের নিজস্ব সমরাস্ত্র উৎপাদন বা কেনার উৎসও নয় ভারত। তবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া, সফর বিনিময় ইত্যাদি রয়েছে। এক দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠানে অন্য দেশের সামরিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যৌথ সমরাস্ত্র উৎপাদন ও সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহের একটি প্রস্তাব মনোজ মনোহর পারিকর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল। তবে সেটি বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ হয়নি।

যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা সম্পর্কের নিবিড়তায়ও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এতে তারা প্রতিরক্ষার জন্য ক্রেডিট লাইনের অধীনে প্রকল্পগুলো দ্রুত চূড়ান্ত করতেও সম্মত হয়েছেন বলে উল্লেখ করে বলা হয়। এটি উভয় দেশের জন্য উপকারী হবে। ভারত এই বিষয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যানবাহনের প্রাথমিক ক্রয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য উন্মুখ বলে উল্লেখ করেছে। ভারতীয় পক্ষ বৃহত্তর সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য দিল্লির উপকূলীয় রাডার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের সমঝোতা স্মারকটি বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব তার ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, এবারের প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারতের সাথে নতুন কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে না। অতীতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে কথা হবে। যতদূর জানা যায়, ভারতের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে নতুন কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়নি। তবে ভারত থেকে সমরাস্ত্র কেনার জন্য আগের লাইন অব ক্রেডিটের অঙ্কটা যেখানে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছিল এবার তা বাড়িয়ে এক বিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারের আমল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু যানবাহন ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরক্ষা সামগ্রী বাংলাদেশ এই প্রতিবেশী দেশ থেকে কেনেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোর দৃষ্টান্ত বাদ দেয়া হলে ভারত প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৃতীয় কোন দেশে রফতানি করেনি। গত কয়েক বছরে জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্য কিছু যুদ্ধাস্ত্র মিয়ানমার ও অন্য কয়েকটি দেশে রফতানির চেষ্টা করছে দেশটি। বাংলাদেশেও দিল্লির পক্ষ থেকে তেজশ জঙ্গিবিমানসহ কিছু যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবের কথা জানা যায়। ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ঢাকা সফর এবং প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে এই বিষয়টি নিয়ে কথা হয়ে থাকত পারে। এ ছাড়া সফরকালে উভয় নেতাই সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। সাধারণভাবে জঙ্গি ও মৌলবাদ বলতে প্রতিবেশী দেশটি ইসলামিস্টদের বুঝিয়ে থাকে।

যেকোনো দেশের প্রতিরক্ষা নিরাপত্তার পরেই জ্বালানি নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার পর ইউরোপকে রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভরতার মূল্য কিভাবে দিতে হচ্ছে তা সবার জানা। বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদার ১৫ ভাগ দেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। বাকি তেল পরিশোধিত ডিজেল বা কেরোসিন আকারে আমদানি করা হয়। তেল পরিশোধনে গড়পড়তা ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয় বলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একাধিকবার নতুন রিফাইনারি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত চাপে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে এগোনো সম্ভব হয়নি।

এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের কাছে সহায়তা চেয়েছেন বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, উভয় নেতাই ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছেন যা বাংলাদেশের শক্তির চাহিদা পূরণে অবদান রাখবে। বাংলাদেশ পক্ষ ভারতকে পেট্রোলিয়াম পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সহায়তা করারও অনুরোধ করেছে বলে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়। ভারতীয় পক্ষ উভয় পক্ষের অনুমোদিত সংস্থাগুলোর মধ্যে এই ইস্যুতে আলোচনার সুবিধার্থে সম্মত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের একটি নিবন্ধিত এ২এ সরবরাহকারী হিসেবে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডকে তালিকাভুক্ত করার বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

ভারত হলো মূলত তেল আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা মানে হলো দেশটি অন্য দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে তা বাংলাদেশের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করবে। এতে দুটি বিপত্তি দেখা যেতে পারে। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় যেসব দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে সেটি আর বহাল থাকবে না। জরুরি সময়ে তাদের কাছ থেকে তেল কেনার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ওআইসিভুক্ত দেশ থেকে তেল আমদানিতে আর্থিক ঋণসহায়তা দেয় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক। এই ঋণ সহায়তা বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহে পাওয়া যাবে না। সর্বোপরি বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মসংস্থানের বৃহত্তম বাজার মধ্যপ্রাচ্য। ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি করা হলে এসব দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক দুর্বল হবার প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে। এর পরও কর্মকর্তারা কোন যুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে ভারত থেকে তেল আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন বোধগম্য নয়।

জ্বালানি নিরাপত্তার মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিদ্যুৎ নিরাপত্তা। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বাংলাদেশে যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয় তার কোনোটাই শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকে না। ২০০৫, ২০১০ এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে যে বিদ্যুৎচাহিদা ও সরবরাহের প্রক্ষেপণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার কোনো কিছুই ঠিক থাকেনি। এখন বিদ্যুতের যে উৎপাদনক্ষমতা তার অর্ধেকের মতো বাস্তবে উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎ না নিয়েই ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো আড়াই হাজার মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র্র স্থাপন করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশ নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ না করে এখন আমদানির ওপর জোর দিচ্ছে। এটি করতে গিয়ে ভারতের দুই কোম্পানিকেও বিদ্যুৎ না নিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এখন নতুন করে ভারতীয় আদানিকে দিয়ে নেপালে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে উভয় পক্ষ বিদ্যুৎ খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির অনুরোধ জানানো হয়। ভারতীয় পক্ষ জানিয়েছে যে, এর জন্য নির্দেশিকা ইতোমধ্যেই ভারতে রয়েছে। এ লক্ষ্যে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর আওতায় দুই নেতা কাটিহার (বিহার) থেকে বোরনগর (আসাম) পর্যন্ত প্রস্তাবিত উচ্চক্ষমতার ৭৬৫ কেভি ট্রান্সমিশন লাইনসহ দুই দেশের পাওয়ার গ্রিডগুলোকে একযোগে সংযুক্ত করার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছেন। এই ব্যবস্থা বিদ্যুতের সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্তি কতটা নিশ্চিত করবে তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে ধারণা তার সাথেও এটি সাংঘর্ষিক হবে।

দুই নেতা ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা) উভয় দেশের জন্য উপকারী হবে বলে উল্লেখ করে এ সংক্রান্ত যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সাম্প্রতিক চূড়ান্তকরণকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা ২০২২ সালের ক্যালেন্ডার বছরের মধ্যে আলোচনা শুরু করার জন্য বাণিজ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ঢাকা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি আশা করেছিল।

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ভারতের সাথে আলোচনার একটি প্রধান ক্ষেত্র। গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে আপত্তি সেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের। স্বাধীনতা-উত্তর সরকার এই বাঁধ চালু করার যে সাময়িক অনুমতি দিয়েছিল তাতে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করার কথা ছিল তা পরে আর করা হয়নি। বিষয়টি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে যাবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শেষ পর্যন্ত গঙ্গার পানি বণ্টনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেখানে বাংলাদেশের ন্যূনতম পানিপ্রাপ্তির একটি গ্যারান্টি ক্লজ ছিল। ১৯৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আবার একটি পানি বণ্টন চুক্তি হয়। কিন্তু তাতে গ্যারান্টি ক্লজ তুলে দেয়ার ফলে ফারাক্কা পর্যন্ত আসার আগেই পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই চুক্তিটি পর্যালোচনা করার সময় অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। এবার যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি দু’দেশের সম্পর্কে তিক্ত অধ্যায় হয়ে আছে। এই চুক্তির কাঠামো ২০১১ সালে শেষ করে তা স্বাক্ষরের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটি ঝুলে আছে। এবারের সফরেও তা দ্রুত নিষ্পত্তি করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে। অথচ ফেনি নদী কার্যত আন্তর্জাতিক নদী না হলেও সেখানকার পানি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশকে দেয়ার বিষয় এর মধ্যে নিষ্পন্ন হয়েছে। এখন তিস্তাকে এড়িয়ে কুশিয়ারাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। আগামীতে ব্রহ্মপুত্রও একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের জন্য।

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে কানেকটিভিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এবারের শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন যে, সীমান্তে সংযোগ এবং বাণিজ্য অবকাঠামো সম্প্রসারণ উভয় দেশের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। গত এপ্রিলের শুরুতে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যখন ঢাকায় ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার শুরুর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ট্রানজিটের জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার শুরু করেছে।

দু’দেশের সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা। জুলাই ২০১৯-এ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানান যে, গত এক দশকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। শেখ হাসিনার এবারের সফরকালে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসার আগেই সীমান্তে গুলি করে এক বাংলাদেশী তরুণকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা। ভারত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও এই ইস্যুটির নিষ্পত্তির ব্যাপারে দিল্লির ঢাকার প্রতি কার্যকর কোনো সহযোগিতা নেই। যৌথ বিবৃতিতে এ নিয়ে কেবল রেটরিকই স্থান পেয়েছে।

বড় কোনো দেশের সাথে যখন রাজনৈতিক সমঝোতা হয় তখন সবকিছু প্রকাশ্যে আনা হয় না। সাধারণভাবে প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত কিছু বিষয় প্রকাশ করা হয় না। এর বাইরে বড় কোনো ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিষয় থাকলেও সেটি প্রকাশ করা হয় না। এবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর তার এই মেয়াদের শেষ সফর বলে মনে করা হয়। আরো এক মেয়াদে তার সরকারকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে যা যা করা দরকার তার সব কিছু করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন দিল্লিতে গিয়ে মোদি সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন বলে যে বক্তব্য চট্টগ্রামের জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে রেখেছেন তাতে রাজনৈতিক বিষয় এবারের সফরে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সফরে শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে গেছেন। কিন্তু তিনি চট্টগ্রামে যে বক্তব্য রেখে বিশেষভাবে আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন সেই এজেন্ডায় কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিতভাবে এখনো গণমাধ্যমে আসেনি।

জার্মান ডয়েচ ভ্যালের দু’টি টকশো অনুষ্ঠানে এ নিয়ে নেতিবাচক ধারণাই দেয়া হয়েছে। একজন বাংলাদেশী সাংবাদিকের বরাত দিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হাসিনা ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের দিকে নজর রেখে দিল্লি সফর করেছিলেন। তিনি এই সফর থেকে যা কিছু অর্জন করবেন বলে আশা করতেন, তা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপান একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর বারবার জোর দিচ্ছে এজন্য ভারতের সমর্থন প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের শেষ দুটি নির্বাচন ছিল কারচুপি ও অন্যায্যতায় ভরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ অবস্থায় ভারতকে খুশি রাখা বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়, বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন চীনের চাপের মধ্যে রয়েছে দেশটি। যে দেশ ভারতের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আর চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে যে, তারা কোয়াডে যোগ দিলে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রভাবিত হবে।

পত্রিকাটি উল্লেখ করে, চীন বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারই নয়। এটি ঢাকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারও। আর বর্তমান সময়টি এমন যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হচ্ছে, এর প্রভাবে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এই সময়ে ঢাকার জন্য চীনের সমর্থন বিশেষভাবে প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তার বিদেশী অংশীদারদের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার সরকার কতদিন সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে শীর্ষপর্যায়ের কোনো সফর চূড়ান্তভাবে সফল বা ব্যর্থ হয় না। কিছু সফলতা প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে নিশ্চয় থাকবে। তবে শীর্ষপর্যায়ের লেনদেনে উইন উইন পরিস্থিতি নিশ্চিত করা না গেলে সম্পর্ক টেকসই হয় না। অনেক সময় সম্পর্কের রশিটিকে অতি মাত্রায় টাইট দিতে গেলে তা ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়।
mrkmmb@gmail.com