Naya Diganta

দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কি সম্ভব!

দেশে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ বেড়েই চলেছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। দীর্ঘ দিন যাবৎ নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ প্রণীত হয়। এ আইনটিতে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় সার্চ কমিটির অনুরূপ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি এ চারজনসহ রাষ্ট্রপতি মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক, যাদের একজন নারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

দ্বিতীয় সার্চ কমিটিতে সাংবিধানিক পদধারী চারজনসহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। নির্বাহী আদেশে গঠিত উভয় সার্চ কমিটিকে প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি করে নাম প্রস্তাব করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। প্রণীত আইনটির সার্চ কমিটিকেও নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি করে নাম প্রস্তাব করার ক্ষমতা দেয়া হয়। নির্বাহী আদেশে গঠিত সার্চ কমিটির ন্যায় প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির প্রস্তাবকৃত নাম হতে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী একটি করে নাম গ্রহণ করে কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

নির্বাহী আদেশে গঠিত সার্চ কমিটি এবং প্রণীত আইনের অধীন গঠিত সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময়ের পর যে সব নামের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল এদের মধ্যে প্রস্তাবকৃত নামসমূহের ব্যক্তিগণের মধ্যে কে কোন দল কর্তৃক সুপারিশকৃত এতদবিষয়ে কোনো তথ্য দেশবাসীকে জানানো হয়নি যদিও তথ্য অধিকার আইনে দেশবাসীর পক্ষ হতে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করা হয়েছিল।

সার্চ কমিটি বা সরকার কর্তৃক নাম জানানো হোক বা না হোক প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রস্তাবকৃত দু’টি নাম হতে একটি নাম গ্রহণ করে একজনকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেয়ার বিধান করায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন সুপারিশের বাইরে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার অবকাশ একেবারেই অবাস্তব।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনকে বুঝায়।

বাংলাদেশে ইতঃপূর্বেকার ১২টি নির্বাচন কমিশনের কর্মতৎপরতা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় দলীয় সরকার নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে একমাত্র অষ্টম নির্বাচন কমিশন ব্যতীত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, একাদশ ও দ্বাদশ এ পাঁচটি নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দলীয় সরকারের অনুকূলে যায়। কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকার, সাংবিধানিকভাবে গঠিত প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং অসাংবিধানিকভাবে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নরের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে গঠিত পঞ্চম, সপ্তম ও দশম এ তিনটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কমিশন কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কমিশন গঠন অব্যবহিত পূর্বেকার ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিকূলে যায়।

উল্লেখ্য, অষ্টম নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকার কর্তৃক গঠিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন সাংবিধানিকভাবে গঠিত দ্বিতীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্বে ছিল অপর দিকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, একাদশ ও দ্বাদশ এ পাঁচটি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন যে দলীয় সরকার কর্তৃক কমিশনগুলো নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিল সে সরকারগুলো ক্ষমতাসীন ছিল। চতুর্থ, ষষ্ঠ ও নবম এ তিনটি নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলসমূহের দাবি ও জন-আকাক্সক্ষার কারণে মেয়াদ পূর্তির পূর্বে অপরিপক্ব বিদায় নিতে হওয়ায় এ কমিশনগুলোর পক্ষে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবকাশ সৃষ্টি হয়নি।

দ্বাদশ নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের মেয়াদকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে পূর্ণ হওয়া পরবর্তী প্রণীত আইনের অধীন ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর অব্যবহিত পূর্বেকার ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন পালন করবে এমনটি প্রত্যাশিত। এ নির্বাচন কমিশনটি একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশনের ন্যায় দলীয় সরকার কর্তৃক সার্চ কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে গঠিত হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা ইতোমধ্যে দেশের মূল বিরোধী দল ও সচেতন জনমানুষের নিকট প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ক বিধানে বলা ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তন পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনবিষয়ক বিধানে বলা হয়- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাবার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাবার ক্ষেত্রে ভেঙে যাবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান কার্যকর ছিল তা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা প্রবর্তিত বিধানের অনুরূপ কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন পূর্ববর্তী যে ছয়টি সংসদ গঠিত হয়েছিল এর কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার কারণে সংসদ বহাল রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ক্ষমতসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলবহির্ভূত অপর কোনো দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়নি অপর দিকে দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পূর্বের ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কখনো বিজয়ী হতে পারেনি। সুতরাং ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বেকার ন্যায় দলীয় সরকার এবং দলীয় সরকার কর্তৃক গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীন দল যে পুনঃবিজয়ী হবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এর ব্যত্যয় সম্ভাবনার বিপরীত।

নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এবং সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়ক ক্ষমতা প্রদান করা হলেও ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কখনো নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধান নির্দেশিত সহায়তা প্রদান করেনি। আর এ কারণেই দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যদিও বা কোনো নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রত্যয়ী হয়েছিল তবে তা ক্ষমতাসীনদের রূঢ় মনোভাবে বিফল হয়।

বাংলাদেশের নবম, দশম ও একাদশ বিগত এই তিনটি সংসদ নির্বাচন সংবিধান নির্দেশিত পন্থায় এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আইনের বিধানাবলি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এ নির্বাচনগুলোর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনুরূপ আরেকটি নির্বাচন বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে অনেকটাই দুরূহ যদিও ক্ষমতাসীনরা সে লক্ষ্যে এখনো অবিচল। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ হতে দেশবাসীকে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আশ্বস্ত করার যে পাঁয়তারা চলছে তাতে যে সফলভাবে করতে পারবে এমন সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত প্রতিভাত নয়। ইতোমধ্যে দেশের মূল বিরোধী দলসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ ইভিএমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠানের বিপক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। এ বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইভিএমের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলে তাতে কমিশনের প্রতি জনআস্থা আরা বেড়ে গেছে।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ হতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময়কালে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে কমিশন যে আগ্রহী এমন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

যেকোনো দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টনের পদ্ধতিকে বলা হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থা। এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ব্যবস্থা। এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু পক্ষের যুক্তির কাছে বিপক্ষের যুক্তি পরাভূত। কী পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এ বিষয়ে সংবিধান ও আইনের বিধানাবলি অনুসৃত হয়। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হলে বিদ্যমান নির্বাচনী আইনে সংশোধনী আনা আবশ্যক এবং সেটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়ই সম্ভব। বর্তমানে আমাদের সংসদের ৫০ জন মহিলা সদস্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দলীয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। এ ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা গেলে তা দেশের রাজনীতিতে মৌলিক গুণগত পরিবর্তন ঘটাবে।

এ পরিবর্তনটির আশায় আমাদের রাজনৈতিক দলসমূহ বিশেষত ক্ষমতাসীন দল দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধ সম্ভব।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com