Naya Diganta

ক্ষমা করুন আমাদের অক্ষমতা, বিদায় বন্ধু শাহ আলম নূর

শাহ আলম নূর

বিদায় বন্ধু শাহ আলম নূর। ২ সেপ্টেম্বর ২০২২, জুমাবার চলে গেলেন পলাশ থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা, দেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ শাহ আলম নূর। ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারি জামালপুর শহরের কাচারি পাড়ার নানাবাড়িতে জন্ম নেয়া এই মানুষটি বিদায় নিলেন রাজধানী ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। বয়সের ব্যবধানে তিনি আমার অনেক সিনিয়র তারপরেও তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করার সাহস দেখালাম। কারণ তার ছিল একটি বন্ধুবৎসল মন। একটি জাতীয় দৈনিকের সহযোগী সাপ্তাহিক পত্রিকায় আমি যখন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন তিনি ওই সহযোগী দৈনিকের সম্পাদনা সহকারী বিভাগে কর্মরত। প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো, কথা হতো। এক পর্যায়ে তিনি আপনি থেকে স্নেহের ডাক ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা শুরু করলেন, হয় তো বা বয়সের ব্যবধানের কারণেই এই স্নেহের পরশ পেতাম তার। মাঝে মাঝে পিঠে হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘হারুন তোমার সংবাদ বিশ্লেষণ চমৎকার আমার বিশ্বাস তুমি অনেক দূর যাবে। আমাদের আদর্শের সমালোচকদের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার শক্তি তোমার কলমের আছে।’ আমি বলতাম,‘ নূর ভাই দোয়া করবেন।’ আমি সাংবাদিকতা শুরুর কয়েক বছরে পরে তিনি সাংবাদিকতা থেকে বিদায় নিয়ে এড ফার্ম এবং নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও যোগাযোগ হতো নিয়মিত। মাঝে মাঝে অফিসে আসতেন। তার তৈরি এড (বিজ্ঞাপন) আমাদের পত্রিকাগুলোয় নিতেন। সেই চিরচেনা প্রাণখোলা হাসি হেসে দাওয়াত দিতেন তার অফিসে নয় তো বাসায়। একবার তার সাথে কুরবানি দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তার সেই দিনের আন্তরিকতার পরিচয় ভুলবার নয়, আমাদেরকে শুধু বাসায় আপ্যায়ন করেই ছাড়লেন না, কুরবানির গোশতের ভাগ শেষে বট নিয়ে শুরু হলো সমস্যা। ওই জিনিস প্রস্তুত করা সমস্যা মনে করে অনেকে বললেন, না, এই জিনিস আমরা নেব না। তিনি বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। সাথে সাথে একটি ছেলেকে ডেকে গরম পানি দিয়ে একবারে ফ্রেশ অবস্থায় আলাদা আলাদা প্যাকেটে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। এমন আন্তরিক ও সহযোগিতার হাত বাড়াতেন প্রতিটি কাজে।

অথচ এই প্রিয় মানুষটির জানাজায় আমি হাজির হতে পারলাম না। আমার এই অক্ষমতা ক্ষমা করো বন্ধু, শাহ আলম নূর। অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করছি। তিনি আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন। আপনাকে আল্লাহতায়ালা তার কাছে নিয়ে নিলেন পবিত্র জুমাবারে।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যখন নাট্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে চলছে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার জোয়ার ঠিক সেই সময় সাংবাদিকতার মতো সম্মানজনক পেশা ছেড়ে একবুক সাহস নিয়ে আপনি শুরু করেন নাট্য ও চলচ্চিত্র আন্দোলন। বিপরীত স্রোতে সীমিত সামর্থ্য ও সমর্থন নিয়ে এই পথচলা খুব সহজ ছিল না। অনেক সমালোচনা, বঞ্চনা, অবজ্ঞা-অবহেলা আপনাকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু দমে যাননি। কেউ দমাতে পারেনি। হলিউড, বোম্বাইয়ের সাথে তারা আপনার কর্মকে তুলনা করে, অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেই মানে পৌঁছে দেয়ার জন্য কেউ হাত ধরেনি। তাই বলে আপনি থেমে যাননি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শ ও বিশ্বাসের আলোকে অশ্লীলতা মুক্ত আপনার কর্মগুলো সুন্দর মনের মানুষরা ঠিকই সুন্দরভাবে গ্রহণ করেছে। আমার মতো অনেক তরুণ ভিসিআর ভাড়া করে গ্রামে গ্রামে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে।

তার নির্মিত আল কোরআনের ফরিয়াদ, কুলখানি, বোরকা, জাহান্নামের ফেরিওয়ালা, দুধারী তলোয়ার, পরকালের পাঠশালা, ব্যাপক দর্শকপ্রিয়। তার নাটকে জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, সামস সুমন, শক্তিমান অভিনেতা খলিল, সাজ্জাদ মাহমুদ, আনিস, কাজী আলমগীর, আহমদ শাহ বুলবুল উৎপল, নায়িকা প্রিয়া ডায়েস, জলি আহমেদ, খালেদা আখতারসহ অসংখ্য বিখ্যাত অভিনেতা অভিনয় করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তির ভেলকিবাজি হেরে গেছে শাহ আলম নূরের সততার কাছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য গত ২৩ জুন জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে শাহ আলম নূরের মতো বিশ্বাসী নির্মাতাদের কাছে হেরে যাচ্ছেন কিনা এমন, প্রশ্ন তুলে সংশয় প্রকাশ করেছেন, শাহরিয়ার কবির ও রামেন্দু মজুমদাররা।

একটি কথা বলা হয়নি। কেন আমি আপনার জানাজায় হাজির হতে পারলাম না। গত ১২ আগস্ট প্রেসার বেড়ে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর রহমত এবং সুপ্রিয় সাংবাদিক নেতা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সোনার বাংলা ইউনিট প্রধান কামরুল হাসান ভাই এবং স্নেহের নয়া দিগন্তের অন লাইন বিভাগের জিয়াউর রহমান সংবাদ শুনে শিগগিরই আমার বাসায় এসে ব্যবস্থাগ্রহণ করেন।

আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর ভাষায়,‘ফেরেশতার মতো আল্লাহ তাদের পাঠিয়েছিলেন, তাকে সাহায্য করার জন্য।’ তারপর থেকে ডাক্তারের কিছু নিদের্শনা মেনে চলতে হচ্ছে, অতি আবেগঘন ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ পরিহার করে চলতে হবে। গত বৃহস্পতিবার দিন হঠাৎ করেই একটু বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। তাই বাসার ভেতরেই চলতে গিয়ে আবার মনে হলো, আল্লাহর ফেরেশতাদের কোলে দোল খাচ্ছি, যখন চোখ খুললাম জানলাম প্রেসার ডাউন হয়েছিল। তাই এখনো গৃহবন্দি আছি। আবেগের কান্না বুকের মাঝে চেপে রাখতেও পারছি না, তাই সাহস নিয়ে বসে পড়লাম কম্পিউটারের সামনে।


আপনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, আপনাকে চিনিতে পারিনি হয়তো। আজ শুধু মনে পড়ছে এই হতভাগা জাতি মৃত্যুর আগে কোনো গুণীজনকে সম্মান দেয় না। আমরাও দিতে পারিনি। আমাদের এই অক্ষমতা ক্ষমা করবেন, নূর ভাই। আমরা না পারলেও মহান আল্লাহর পুরস্কার থেকে আপনাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। কারণ আপনার জীবনের সমস্ত কাজের উদ্দেশ্য ছিল সেই মহান রবের সন্তুষ্টি। দুনিয়ার তুচ্ছ খ্যাতি আর যশের মোহ আপনাকে সেই পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এখানেই আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্য লুকিয়ে আছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা আপনাকে এই বলে ডেকে নিয়েছেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার রবের দিকে ফিরে এসো সন্তুষ্ট হয়ে এবং (তোমার রবের) সন্তুষ্টির পাত্র হয়ে। অতঃপর আমার (নেক) বান্দাহদের মধ্যে শামিল হও, আর প্রবেশ করো আমার জান্নাতে। [সূরা আল-ফাজর : ২৭-৩০]’ আপনি চলে গেলেও আপনার কর্মের নূরের আলো জ্বলতে থাকবে এই দেশের প্রতিটি বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে। এই প্রত্যাশা আমাদের সবার, আপনার সব বন্ধুর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক