Naya Diganta

মালয়েশিয়ায় নির্বাচনী হাওয়া

মালয়েশিয়ায় নির্বাচনী হাওয়া

মালয়েশিয়ায় হঠাৎ করেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে দুর্নীতির মামলায় জেলে পাঠানোর পর শাসক দল আমনুর পক্ষ থেকে তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। তা না হলে আমনুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবকে বরখাস্ত করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী হাওয়ার আকস্মিক এই উত্থানে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিম এক মাসের মধ্যেই নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন। অন্য দিকে শাসক জোটের অংশীদার পেরিকাতান ন্যাশনাল মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর শতায়ু ছুঁই ছুঁই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রোগশয্যা থেকে উঠে অল মালয় পার্টির জোট গঠনের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। তিনি নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথাও জানিয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন, ২০২২ সালে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সব দলই ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তবে পেছন থেকে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয়। যে বলয়ে রয়েছে দেশটির মালয় সুলতানরা, প্রতিরক্ষা বাহিনী, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক কিছু ব্যক্তি। দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি মালয় ও ভ‚মিপুত্র জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই গভীর ক্ষমতা বলয় বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে।

নির্বাচনী হাওয়া শুরুর পর থেকে মূলত তিনটি প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ধারা তৈরি হয়েছে। একটি হলো আমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল, দ্বিতীয়তটি বারসাতু, পাস ও বর্নিও মালয়েশিয়ার কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাতান ন্যাশনাল। এ দু’টি জোট এখন সরকারে রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান। এই জোটের নেতা হিসেবে ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি অনুসারে আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতা না দিয়ে নিজের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ক্ষমতার লাইন থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। তার সহযোগী মহিউদ্দিন ইয়াসিন ‘শেরাটন অভ্যুত্থান’ নামে খ্যাত এক নাটকীয় ঘটনায় বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান।

এরপর মাহাথির শাসক জোট এবং বিরোধী পক্ষ দুই জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এখন তিনি মালয় দলগুলো নিয়ে একটি জোট গঠনের কাজ করছেন। দু’টি লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগোতে চাইছেন। প্রথমত, বৃহত্তর আমনু গঠন করে এই শাসক দল থেকে ছিটকে পড়া সবাইকে আবার ঐক্যবদ্ধ করা। মহিউদ্দিন ইয়াসিনও তা সমর্থন করছেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ড. নাজিবকে নির্বাচনের আগেই জেলে পাঠানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এ পথে বাধা হয়ে আছেন আমনুর বর্তমান নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর আমনু গঠনের উদ্যোগ সফল না হলে অন্য সব মালয়ভিত্তিক দল নিয়ে একটি জোট তৈরি করে নির্বাচন করা। এ ব্যাপারে মাহাথিরের গোপন সহযোগী আজমিন আলী নেপথ্যে কাজ করছেন। বারিসান আর পেরিকাতান ন্যাশনালের মধ্যে সমঝোতা না হলে মহিউদ্দিন ইয়াসিনও এই ধারায় মিলতে পারেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

এ ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ হলে তিনটি প্রধান ধারার মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্ব›িদ্বতা হতে পারে। একপক্ষে থাকবে বারিসান ন্যাশনাল আর এক বিপরীতে পাকাতান হারাপান জোট ও পেরিকাতান ন্যাশনাল জোট। এভাবে নির্বাচন হলে ফলাফল কেমন হবে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি। ঠিক কবে নির্বাচন হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মেরুকরণ কী দাঁড়াবে, গভীর ক্ষমতা বলয় কী চাইছে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কী দাঁড়াবে এসব কিছু নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।

নতুন পরিস্থিতি
মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এমন একটি দেশ যেখানকার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও ক‚টকৌশল সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া কঠিন। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তার দলের শাসনামলেই জেলে পাঠানো হয়েছে। এতে যে কেউ মনে করতে পারেন দেশটির বিচার বিভাগ এতটাই স্বাধীন যে একজন সাবেক দাপুটে প্রধানমন্ত্রীকে তার দলের শাসন চলাকালেই দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হলো। আসলেই মালয়েশিয়ার বিচার বিভাগ সম্পর্কে ‘আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন, কেবল রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া’ মর্মে যে কথা চালু আছে তা এখনো বহাল আছে।

ড. নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের সমর্থনে। মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলেও তার কথামতো পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কাজ করবেন এবং তার নীতি ও প্রকল্পগুলো বজায় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করতেন। কিন্তু মাহাথিরের ইস্তফার পর আব্দুল্লাহ বাদাবি নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের মতো করেই দেশ চালাতে চেষ্টা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাহাথির উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাককে সমর্থন দিতে শুরু করেন। তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন যাতে বাদাবি বিদায় নিতে বাধ্য হন। মাহাথিরের প্রচেষ্টা সফল হয়, নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু নাজিবও মাহাথিরের কথামতো চলতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজের মতো করে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ শুরু করেন। এতে মাহাথির আবারো ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু ততদিনে ক্ষমতাসীন আমনুর ওপর মাহাথিরের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যায়। মাহাথির আমনু থেকে পদত্যাগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত পিকেআর প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে বোঝাপড়ায় গিয়ে পাকাতান হারাপান নামে একটি বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করেন। মাহাথিরের নবগঠিত দল বারসাতু বিরোধী জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল হয়। আর বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এ মর্মে সমঝোতা হয় যে বিরোধী জোট জয়ী হলে মাহাথির দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন আর আনোয়ার ইব্রাহিমকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাহাথিরের নেতৃত্বে বিরোধী জোট জয়লাভ করে। আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর জোটে বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। বারসাতু ১২টি আসন লাভ করে। কিন্তু মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগার থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে বাধা না দিলেও এক দিকে আমনু থেকে এমপিদের নিজ দলে এনে বারসাতুকে শক্তিশালী করেন অন্য দিকে আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা আজমিন আলীকে আনোয়ারের বিপরীতে সমর্থন দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। পিকেআর সভানেত্রী আনোয়ারের স্ত্রী ডা: আজিজাকে উপপ্রধানমন্ত্রী করা হলেও তাকে একেবারেই একটি অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেন মাহাথির। দলের মধ্যে আনোয়ারের অনুগত বলে পরিচিতদের তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো মন্ত্রীর পদও দেননি।

মাহাথিরের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে তার ক্ষমতা না ছাড়ার পরিকল্পনা ততই এগোতে থাকে। পিকেআর উপপ্রধানের পদে থেকেই আজমিন আলী দাবি করেন মাহাথির যেন পূর্ণ মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী থাকেন। শেষ পর্যন্ত মাহাথিরের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতায় পিকেআরে বিভক্তি সৃষ্টি হয় এবং আজমিন আলীর নেতৃত্বে একটি অংশ পিকেআর ছেড়ে বারসাতুতে যোগ দেয়। মাহাথির পদত্যাগ করে সর্বদলীয় প্রধানমন্ত্রী হবার ছক আঁটেন কিন্তু তার দলের মহিউদ্দিন ইয়াসিন তার আকাক্সক্ষার সামনে বিদ্রোহ করে বিরোধী দল আমনু ও পাসের সহযোগিতায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করে ফেলেন। কোণঠাসা মাহাথির দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আরেকটি নতুন দল গঠন করেন। আনোয়ারের এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত ডিপ স্টেটের সমর্থন না মেলায় সফল হয়নি।

নতুন সমীকরণ
মহিউদ্দিন ইয়াসিন ডা: মাহাথিরকে ডস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ভাগিয়ে নিলেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। মহিউদ্দিন তার পুরনো প্রতিপক্ষ আমনুর সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিব রাজাক ও বর্তমান চেয়ারম্যান ড. জাহিদ হামিদীর অনুগতদের কোণঠাসা করে পাল্টা গ্রæপকে মন্ত্রিত্ব ও অন্যবিধ সুবিধা দেন। এতে ড. নাজিব ও জাহিদ হামিদী সরকারের বাইরে থেকে ভেতরে ভেতরে কোয়ালিশনের বৃহত্তম দল হিসেবে আমনুর নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। আর মহিউদ্দিন ইয়াসিনের সরকারও তাদের বিরুদ্ধে আগের সরকারের সময় চলমান মামলা অব্যাহত রাখেন। মহিউদ্দিন আমনুর নেতাদের মধ্যে দলের সহসভাপতি ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব ও অন্যতম নেতা খায়েরী জামালউদ্দিনকে সামনে নিয়ে আসেন। এভাবে আমনুর মধ্যে একটি অংশ সরকারের সুযোগ সুবিধা লাভ করে, আরেকটি অংশ বঞ্চিত হয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকে। এই বিক্ষুব্ধ অংশই সংগঠিত হয়ে বিরোধী দলের সাথে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে মহিউদ্দিনকে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি করে। শেষ পর্যন্ত মহিউদ্দিন ইয়াসিন সিনিয়র মন্ত্রী ও আমনুর সহসভাপতি ইসমাইল সাবরির হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেন।

এর মধ্যে সরকারে শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব বারসাতু এবং বিরোধী জোটের সাথে সমঝোতা করে স্থিতিশীলতার ফেরানোর প্রচেষ্টা নেন। তবে নাজিব রাজাক ও জাহিদ হামিদীর প্রভাব কমানো এবং দলের মধ্যে তাদের কোণঠাসা করার কাজও অব্যাহত রাখেন। এখন ড. নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে আদালতের চূড়ান্ত যে রায়টি হতে পেরেছে সেটি প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুগত নেতা মন্ত্রীদের নীরব সম্মতিতেই হয়েছে।

ড. নাজিব চেয়েছিলেন তার মামলাটি চলমান থাকা অবস্থায় নতুন নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা নেবেন। কিন্তু ইসমাইল সাবরি তার উচ্চাশাকে দ্রুত মামলা চূড়ান্ত করে ঠেকিয়ে দিয়েছেন। এখন ইসমাইল সাবরির সামনে দু’টি পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমটি হলো দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমনুকে এককভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। এ লক্ষ্যে স্থিতিশীল পরিস্থিতির মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজটি অনেকাংশে সম্পন্ন করেছেন। গত দুই প্রান্তিকে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্বের হার নিচে নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ জনমত আবার আমনুর পক্ষে আসতে শুরু করেছে যার ফলে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে আমনু ভালো ফল অর্জন করেছে। ইসমাইল সাবরির দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো দলের প্রধানের দায়িত্ব পাওয়া। নাজিবের পতনের পর এবার দলের সভাপতি জাহিদ হামিদীর কর্তৃত্বকে বিদায় করতে হবে এ জন্য। এর মধ্যে আগের সরকারের সময় ড. জাহিদের বিরুদ্ধে চালু করা মামলা পরিণতির দিকে যাচ্ছে। এ মামলায় আমনু প্রধানের শাস্তি হলে ইসমাইল সাবরির দলের প্রধান হবার পথ খুলে যাবে।

এর মধ্যে হঠাৎ করেই পরিস্থিতি উল্টো দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। আমনুর কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভাগীয় প্রধানদের বিশেষ সভায় দলের প্রেসিডেন্ট আহমদ জাহিদ আবারও সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সাধারণ নির্বাচনের পথ সুগম হয়। জাহিদ বলেছেন যে বর্তমান বাস্তবতা একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ইসমাইল সাবরিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরোধীদের সাথে একটি চুক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বলে দেশের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে।

এর মধ্যে অবশ্য অনেক খেলা চলছে। ডা: মাহাথির মোহাম্মদ চাইছেন ইউনাইটেড আমনু তৈরি করে আবার সেই দলে ফিরে আসতে অন্যদের নিয়ে। মহিউদ্দিন ইয়াসিনও একই ভাবনার মধ্যে রয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হলে মহিউদ্দিনের প্রাপ্তি হয়তো তেমন কিছু থাকবে না। তবে মাহাথির পুত্র মুখরিজ মাহাথির নবগঠিত দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন। তবে আমনুর নতুন নেতারা পুরনোদের ফিরিয়ে এনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চান না। ফলে এ প্রয়াস কতদূর সামনে এগোবে বলা মুশকিল। অন্য দিকে নাজিবের অনুগতরা আবারো সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। জায়েদ হামিদী বলেছেন, নাজিবের অন্যান্য মামলায় দল তার পক্ষে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুগতদের জন্য এই চাপ ক্রমেই বাড়তে পারে। এ ছাড়া সরকারের অন্যতম শরিক পাস প্রধান আবদুল হাদি আওয়াং ও তার দলের সদস্যরা চলমান সব দুর্নীতির মামলা শেষ করে তারপর নির্বাচন দেবার দাবি জানাচ্ছেন।

আনোয়ারের ভাগ্য কোন পথে
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত ব্যক্তি হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথির প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে কক্ষপথ থেকে অতলগহ্বরে ফেলে দেন মাহাথির। এরপর জেল জুলুম পার হয়ে এক দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয় তাকে। নিজে জেলে থেকে স্ত্রীকে দিয়ে নতুন দল সংগঠিত করে সেই দলকে দেশের অন্যতম বৃহৎ দলে পরিণত করেন। শেষ পর্যন্ত তার জোট বিগত নির্বাচনে জয়ও পায়।

কিন্তু ডা: মাহাথির আবারো তার প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেন। দ্বিতীয় দফা ওয়াদা খেলাপের পরও মাহাথির আরো একবার আনোয়ারের সমর্র্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আনোয়ার আর তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি।
এখনকার মালয়েশিয়ার বিরোধী দলের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হবার ক্ষেত্রে হ্যাটট্রিক করেছেন। সরকার আকস্মিকভাবে নতুন নির্বাচন ঘোষণা দিলেও তিনি কতটা ভালো করবেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আনোয়ার ইব্রাহিম তার দেশে অত্যন্ত দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। অনেকে এমনও মনে করেন তিনি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব পেলে দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু তিনি সংখ্যাগুরু মালয়দের একটি বড় অংশের আস্থা অর্জন করতে পারছেন না। বিশেষ করে মালয় প্রধান ডিপ স্টেটের সদস্যরা তাকে সমর্থন করছেন না।

মালয়েশিয়া একটি বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ। দেশটির অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ২৭ ভাগ চায়নিজ জাতিগোষ্ঠীর হাতেই রয়েছে মূলত। ৬০ ভাগ মালয় দেশটি রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। দেশটির সব সুলতানই হলেন মালে। দেশটি নিরাপত্তাবাহিনীর সব অংশই মালয় নিয়ন্ত্রিত। মালয়েশিয়ার ডিপ স্টেট বা গভীর ক্ষমতা বলয়ের প্রায় সবাই মালে। ৩৮ সদস্যের যে নিরাপত্তা পরিষদ রয়েছে তারাই মূলত নির্ধারণ করেন কারা সরকার গঠন করবে। তাদের গরিষ্ঠ অংশ মনে করে আনোয়ার ইব্রাহিম সরকার গঠন করলে চীনা জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব বাড়বে। পাকাতান হারাপান জোট ২০১৮ সালে যখন সরকার গঠন করে তখন চীনা ও ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি সদস্য মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ডিএপি নেতা লিম গুয়াং য়েং হন অর্থমন্ত্রী। মহিউদ্দিন ইয়াসিন যখন অভ্যুত্থান করেন তখন এই যুক্তিটিই প্রধান ছিল যে, আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হলে চীনা প্রভাব আরো বাড়বে। এই জাতিবাদী ভাবধারাকে উসকে দিতে ভূমিকা রাখেন তিন ব্যক্তি। তাদের একজন হলেন ডা: মাহাথির মোহাম্মদ, অন্যজন আনোয়ারের দলেরই এক সময়কার দ্বিতীয় শক্তিধর নেতা আজমিন আলী আর তৃতীয় জন হলেন ইসলামী দল পাস প্রধান আব্দুল হাদি আওয়াং।

পরবর্তী সময়ে প্রাসাদ রাজনীতিতে মাহাথির ছিটকে পড়লেও বাকি দু’জনের গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা থেকে যায়। কিছুকাল ধরে অবশ্য আজমিন আলী নতুন কোনো প্রকল্পের জন্য চুপচাপ রয়েছেন বলে মনে করা হয়। তার ঘনিষ্ঠ আরেক নেত্রী জুরাইদা তার সাথে মতবিরোধ করে একটি ছোট দলে যোগ দিয়েছেন। নতুন যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে চলেছে তার পুরো রূপ এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে নির্বাচনের আগে বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটতে পারে।

এই মেরুকরণে আনোয়ার কোনো ম্যাজিক দেখাতে না পারলে তিনি কতটা সফল হবেন তাতে সংশয় রয়েছে। মাহাথির আজমিন চীনা প্রধান ডিএপির সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। আমনুর বিক্ষুব্ধ অংশ মাহাথির, বারসাতু আর ডিএপি মিলে নতুন কোনো জোট হলে নির্বাচনে একটি ভিন্ন চেহারা আসতে পারে।

আনোয়ার ইব্রাহিম জোর দিয়ে বলেছেন, ১৫তম সাধারণ নির্বাচনের জন্য তার জোট প্রস্তুত। পিকেআর-এর নির্বাচনী কনভেনশনের পরে তিনি বলেন, এক মাস বা এক বছরের মধ্যে নির্বাচন ডাকা হলে তাতে কিছু যায় আসে না। পাকাতান লড়াই করে জয়ী হতে প্রস্তুত। ইসমাইল সাবরি এখন খুবই দুর্বল কারণ তিনি আমনু নেতৃত্বের চাপে রয়েছেন। তিনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী নন যিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন।

আনোয়ারের পাকাতান হারাপান শেষ পর্যন্ত যদি মালয়দের আস্থা অর্জনের মতো কোনো মেরুকরণ ঘটাতে পারে তাহলে ভিন্ন একটি হিসাব নিকাশও হতে পারে। মালয়েশিয়ার রাজা একসময় আনোয়ারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ডিএপির সংস্পর্শ ছেড়ে এলে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে ডিপ স্টেটের কোনো আপত্তি থাকবে না। তেমন কোনো আকস্মিক পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত ঘটে যায় কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়।
mrkmmb@gmail.com