Naya Diganta

চলনবিলে জলজ ফুলের রানী পদ্ম

চলনবিলে সহস্র পদ্মফুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য : নয়া দিগন্ত

প্রায় চার দশক পর চলনবিলে ফুটছে জলজ ফুলের রানী পদ্ম। পদ্ম ও শাপলা দূর থেকে দেখতে প্রায় একই রকম মনে হলেও কাছে গেলে এর পার্থক্য সহজেই ধরা যায়। প্রকৃতিতে পদ্মের সম্মোহন সূর্যের সাথে আর শাপলার সম্মোহন চাঁদের সাথে।
পদ্মের মধ্যে নীলপদ্ম জলজ ফুলের ভুবনে সবার শীর্ষে। নীলপদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয়। পদ্মফুল তার ৬৪টি পাপড়ি মেলে ধরলে প্রকৃতিতে মাঝে ফুটে ওঠে এক নৈসর্গিক শোভা।
প্রায় চার দশক পর চলনবিলে পদ্মফুল আবার তার আবির রাঙানো রূপের মোহনভঙ্গিমা সাজিয়ে বসেছে। তার অপার্থিব বাহারি রূপে চলনবিলের প্রকৃতিকে করেছে স্বপ্নময় বর্ণিল। পদ্ম দিনের আলোয় দ্যুতি ছড়ায়। বিলজুড়ে শত শত পদ্মের এ নয়নাভিরাম দৃশ্য দুই চোখভরে দেখতে ছুটে আসছে হাজারো পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা।
পদ্মের বেশ কয়েকটি ইংরেজি নাম আছে- লিলি, লিলি নাইল, লোটাস, ইজিপসিয়ান লিলি, দ্য ফ্লাওয়ার অব অ্যানসিয়েন্ট ইজিপসিয়ান। বৈজ্ঞানিক নাম নিমফাইয়া কেরুলা। সাধারণ পদ্ম সাদা ও গোলাপি রঙের দেখা যায়। আমাজান লিলি পদ্মেরই একটি ভিন্ন জাত। চর্যাপদে বাংলা ভাষার সাহিত্য সৃষ্টির সূচনায় আছে পদ্মের পাপড়ি ৬৪টি। পাপড়ির নিচে অনেকটা হলদেটে পাপড়ি আছে কয়েকটি। ফুলের মাঝের অংশের পুষ্পরেণুর শাখা হলদেটে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দোবিলা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি কাইউম সরদার (৮৫) জানান, গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে চলনবিল থেকে হারিয়ে যেতে থাকে পদ্ম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জামালের গবেষণায়ও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞন বিভাগের গবেষকরা এ অঞ্চলে আর কোনো পদ্ম দেখতে পাননি বলে জানান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ প্রায় চার দশক পরে চলনবিলে পদ্ম ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলেন, পদ্ম একটি বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। পদ্মফুলের একটি পরিপক্ব বীজ এক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনুকূল পরিবেশ পেলে সে আবারো বংশবিস্তার করে। চলনবিলে ফোটা পদ্মের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে।
বৈশিষ্ট্য অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মানো পদ্মফুলকে দু’টি প্রজাতিতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এশিয়ান বা ইন্ডিয়া লোটাস (পদ্ম), অন্যটি হচ্ছে আমেরিকান বা ইয়েলো লোটাস। এশীয় পদ্ম আবার দুই রঙে দেখা যায়। একটি মসৃণ সাদা, অন্যটি হালকা গোলাপি। আমাদের দেশে যেসব পদ্মফুল দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো এশিয়ান বা ইন্ডিয়ান লোটাস।
অধ্যক্ষ এম এ হামিদ রচিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের বেশি। ১৯০৯ সালে পরিচালিত চলনবিল জরিপ প্রতিবেদনে এর আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম জানান, শুষ্ক মৌসুমে চলনবিলের জলমগ্ন এলাকা থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার।
চলনবিল এলাকার মধ্যে বিভিন্ন নামে এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল রয়েছে। এসব বিলে পদ্ম, শাপলা, শালুক, মাখনা, সিঙ্গট, গেচু, চেচুয়াসহ বহু প্রজাতির সপুষ্পক, ফার্ন, মস ও শৈবাল পাওয়া যেত। এর অনেকটিই এখন বিপন্ন এবং বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকদের অভিমত, পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলনবিল নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা আর পদক্ষেপ নেয়ার সময়।