Naya Diganta

সুবিধা দেয়ার পরও কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ

সুবিধা দেয়ার পরও কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ

গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ঋণখেলাপিদের জন্য সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ৷ আগস্টে পাওয়া হিসাবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে আদায় হচ্ছে না৷ এতে অর্থনীতির বড় ক্ষতি৷

চলতি আগস্ট মাসে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ যে পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া গেছে তাতে তা সওয়া লাখ কোটি টাকা ছড়িয়ে গেছে৷ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিলো এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা৷ সর্বশেষ হিসেবে জুন মাসে তার পরিমাণ হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা৷

যেভাবে বাড়ছে :
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলছে, চলতি ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা৷ এটি মোট বিতরণ করা ঋণের আট দশমিক ৯৬ শতাংশ৷ যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ৷

বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়৷ ঋণের শতকরা আড়াই থেকে চার শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়৷ এর আগে এটা ছিল শতকরা ১০ শতাংশ৷

বাংলাদেশ ব্যাংক করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিতে পড়া অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ঋণ পুনঃতফসিলে এই ছাড় দেয়৷ আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যুক্তি দেখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ কিন্তু বাস্তবে ফল হচ্ছে উল্টা৷ খেলাপি ঋণ আরো বাড়ছে৷

চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে দেশে মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা৷ সর্বশেষে তিন মাসে (মার্চ থেকে জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা৷ আর বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চে) বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা৷ আর গত এক বছরে ২০২১ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা৷ ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা৷ অন্যদিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা৷ সর্বশেষ ছয় মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা৷

এই হিসাবেও ফাঁকি

খেলাপি ঋণের এই হিসাবের মধ্যেও ফাঁকি আছে৷ কারণ এখানে পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব দেখানো হয় না৷ ওই ঋণ অবলোপ করা হয়৷ পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘খেলাপি ঋণের যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় আইএমএফের হিসেবে তার পরিমাণ বস্তবে দ্বিগুণের কম নয়৷ কারণ পুনঃতফসিল করা ঋণ রেগুলার ঋণ হিসেবে দেখানো হয় ৷ আসলে ওই টাকা আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবেনা৷'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘ঋণখেলাপি হতেই পারে৷ কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আলাদা৷ এখানে নিয়ম নীতি না মেনে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দেয়া হয়৷ আর সেই ঋণ যারা নেন তারা আর ফেরত দেন না৷ আমরা খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক দেখলেও এর দায় কিন্তু অল্প কয়েকজনের৷ ব্যাংকিং খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে৷ তারা এই খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন৷ ফলে প্রকৃত যারা বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন৷ অর্থনীতি সংকটে পড়ছে৷'

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যে খেলাপি ঋণের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক বলে, যাদের কথা বলে তাদের একটা বড় অংশ বোকাসোকা৷ তারা হয়তো যৌক্তিক কারণেই খেলাপি হয়েছেন৷ তাদের ঋণের পরিমাণও অল্প৷ কিন্তু মূল ঋণ নিয়েছে অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান৷ তাদের আইনের নানা সুবিধা দিয়ে ঋণখেলাপি হিসেবে দেখানো হয়না৷ তারা যে টাকা নিয়েছেন তা ফেরতও পাওয়া যাবেনা৷'

ফলে এখন ব্যাংকে টাকার সংকট৷ আর্থিক খাত ছোট হয়ে যাচ্ছে৷ জিডিপির অনুপাতে ব্যাংকে যে টাকা থাকা দরকার তা নেই৷ ফলে যাদের প্রকৃতই প্রয়োজন তারা ঋণ পাচ্ছেন না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷ তার কথায়, ‘রাজনৈতি বিবেচনায় যারা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন তাদের ধরা সম্ভব নয়৷ সরকার যে নীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে পলিসি তাতে খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকবে৷'

এই দুজন অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ঋণখেলাপিদের নতুন সুবিধা দেয়ায় ঋণ আদায় হবে না৷ বরং তারা ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম কাটিয়ে ওই টাকা না দেয়ার নতুন পথ খুঁজে পাবে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে