Naya Diganta

আমার দেখা নয়াচীন

শেখ মুজিবুর রহমান

(১৫ আগস্ট সোমবার স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং স্বাধিকার সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এদিন তিনি পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং আরো ক’জন স্বজনসহ মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের প্রথম দিকের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। বইয়ের ভাষা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’ অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতো যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে!

হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে আমন্ত্রণ এলো পিকিংয়ে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। পাকিস্তান শান্তি কমিটি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। পূর্ব বাংলা থেকেও কয়েকজনকে যেতে হবে। ৩৭টি দেশ এতে যোগদান করবে। অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন?

আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, ব্রিটেন হোক, চীন হোক যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে- যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন।

কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লাখ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে। তবুও আপনারা বলবেন, আজ তো স্বাধীন হয়েছি। কথা সত্য, পাকিস্তান নামটা পেয়েছি; আর কতটুকু স্বাধীন হয়েছি আপনারা নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। যা হোক, পাকিস্তান গরিব দেশ, যুদ্ধ চাইতে পারে না। যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের জনগণের সকলের চেয়ে বেশি কষ্ট হবে এ জন্য। তাদের পাট, চা, তুলা অন্যান্য জিনিস বিদেশে বিক্রি না করলে দেশের জনগণের কষ্টের সীমা থাকবে না। দুর্ভিক্ষ মহামারী সমস্ত দেশকে গ্রাস করবে। তাই মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য- যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।

ঠিক করলাম শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। আমাদের পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, যাকে আমরা সকলে ‘মানিক ভাই’ বলি, বন্ধুবর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর ইউসুফ হাসান এবং আমি, এই পাঁচজন যাবো ঠিক হলো। কিন্তু পাসপোর্ট কোথায়? ওটা না হলে তো আর কোনো প্লেন আমাদের নেবে না। সকলেই সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছে, করি নাই আমি- কারণ কোথাও আবার সভা করতে গিয়ে থাকব। আরো ভেবেছিলাম, বোধ হয় পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না। যা হোক, যাবার মাত্র একদিন পূর্বে বন্ধুবর ইয়ার মোহাম্মদ খান (তৎকালীন আওয়ামী লীগের ট্রেজারার), যিনি আওয়ামী লীগের ট্রেজারার, আমাকে বললেন, আজই দরখাস্ত করো। চেষ্টা করে দেখা যাবে। যা হোক, তার ও আতাউর রহমান সাহেবের কথায় দরখাস্ত করলাম। কিন্তু পরে আবার জানতে পারলাম আমার দরখাস্ত পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছে নাই। মহাবিপদ! পাসপোর্ট অফিসার জনাব শুকুর সাহেব খুব ভালো লোক। ব্যবহারও চমকার, আর কাজও করতে পারেন। তার মতো কর্মচারী হলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য। তিনি বললেন, আবার আমার কাছে আর একটা দরখাস্ত করুন। তাই করলাম। তার হাতে তো আর ক্ষমতা নাই- ‘লাল ফিতার প্যাঁচ। করাচির হুকুম প্রয়োজন। তা না হলে তো পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কোনো জলসাই হয় না।

খবর নিয়ে দেখা গেল তখনো হুকুম পৌঁছে নাই। হোম ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা সকলেই বসে রইলাম পাসপোর্ট অফিসে। পরের দিনই যেতে হবে কোনো কিছু ঠিক করতে পারি নাই। কাপড় জামা টাকা পয়সা কোনো কিছুর জোগাড় নাই। রাত্রে করাচি থেকে মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের কাছ থেকে খবর পেলাম সিট রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। সকালে আবার পাসপোর্ট অফিসে গেলাম। প্রায় ১০টার সময় খবর এলো হুকুম এসেছে পাসপোর্ট দিয়ে দিতে। কিন্তু ১২টায় বিওএসি প্লেন ছেড়ে যাবে- এর মধ্যে কী করব? ভেবে কূল পাই না। সাড়ে এগারোটার সময় পাসপোর্ট পেলাম। ফোন করে জানলাম, প্লেন ২৪ ঘণ্টা লেট। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সময় কিছু পাওয়া গেল। পাসপোর্ট নিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের অফিসে গেলাম। ব্রহ্মদেশের কনসাল অফিসে গেলাম। আমরা সকলেই এক সাথে ঘুরছি। পরে জানা গেল ভিসার প্রয়োজন নাই, কারণ আমরা তো এখনো ‘রানিমা’র প্রজা।

আমাদের বিদেশে লিখতে হবে পাকিস্তানি ব্রিটিশ নাগরিক। হায়রে স্বাধীনতা! বাড়ি ফিরতে প্রায় ৬টা বেজে গেল। টাকার প্রয়োজন, আমরা তো বড়লোক নই। আর পাকিস্তানে ফটকা ব্যবসাও করতে আসি নাই যে নগদ টাকা থাকবে! ধার করতে হবে। জোগাড়ে লেগে গেলাম। ফরেন এক্সচেঞ্জ দরকার। যা হোক, কোনো মতে কিছু জোগাড় করলাম, কাপড়-চোপড়ও কিছু জোগাড় হলো। দুই বৎসর আড়াই বৎসর জেলে থেকে কাপড় প্রায়ই ছোট হয়ে গেছে।

পরের দিন সকালে হঠাৎ আতাউর রহমান সাহেব ফোন করলেন প্লেন ৮টায় আসবে, যথাসময় ৯টায় ছাড়বে। আমাকে খুঁজতে আতাউর রহমান সাহেব গেছেন, আর আমি খুঁজতে আসছি তাকে। তার বাসায় খবর পেলাম প্লেন ছাড়ার সময়। তাড়াতাড়ি কমলাপুর চললাম মানিক ভাইকে আনতে, কারণ তিনি তো খবর জানেন না। যেয়ে দেখি মানিক ভাই বসে রয়েছেন, কোনো প্রস্তুতি নাই। উনি ঠিক করেছেন যাবেন না, কারণ টাকার অভাব; বিশেষ করে ইত্তেফাকের লেখা কে লিখবে, টাকার জোগাড় কে করবে?

আপনারা বোধ হয় জানেন না, মানিক ভাই ইত্তেফাকের শুধু সম্পাদক নন, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে পিয়নও বটে। দুনিয়ার যাবতীয় কাজ তার প্রায় একলারই করতে হয়। অন্য কর্মীরা প্রায়ই জেলে, ওয়াদুদ বাইরে। ওয়াদুদের ওপর সমস্ত ভার দিলেন। আর খোন্দকার আবদুল হামিদের মতো ২-১ জনকে লেখা দিতে অনুরোধ করে রওয়ানা হলেন। আওয়ামী লীগ অফিসে এসে আতাউর রহমান সাহেবের সাথে দেখা হলো। আমরা তেজগাঁও অ্যারোড্রামের দিকে রওয়ানা হলাম, যেয়ে দেখি প্লেন প্রস্তুত; পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত। খুবই আনন্দিত হলাম, বিশেষ করে মাহমুদুল হক কাসুরী, আবদুল্লা মল্লিক ও অনেককে দেখে।

প্লেন ছেড়ে দিলো। ভাবলাম নতুন দেশ দেখব, কত আনন্দ! শুনে আরো খুশি হলাম রেঙ্গুনে বিকাল ও রাতে থাকতে পারব বলে। সারা বিকাল আমরা রেঙ্গুন শহর দেখতে পারব। প্রায় ২টায় রেঙ্গুন পৌঁছলাম। আমাদের বিরাট একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো। সুন্দর কামরা দেয়া হলো। আমরা গোসল করে প্রস্তুত হলাম। আতাউর রহমান সাহেব তার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় টাঙ্গাইলের আরফান খান সাহেবের ছেলে আজমল খাঁ- ওখানে থেকে ব্যবসা করে-অনেক টাকার মানুষ ও পুরানা ব্যবসায়ী, সকলে জানে ও চেনে- তাকে ফোন করে দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি এলেন। তার নিজের মোটরগাড়ি আছে। সেই গাড়িতে করে প্রথমেই তার রয়াল স্টেশনারি দোকানে নিয়ে গেলেন। বিরাট দোকান দেখে আনন্দ হলো। তার কাছ থেকে শুনলাম নিজের চেষ্টায়ই তিনি লাখ লাখ টাকার মালিক। তার বয়স ৩০-৩৫ বৎসর হবে। দেশী লোক পেয়ে অনেক দিন পরে সে আমাদের সাথে প্রাণ খুলে আলাপ করল। দেশের কথা জানতে চাইল। আমাদের নিরপেক্ষভাবে ব্রহ্মদেশের খবর দিলো। তার বাসায় নিয়ে গেল এবং স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ভদ্র মহিলার চমৎকার ব্যবহার, নিজেই আমাদের খাওয়ালেন। তারপর ক্লাব, বৌদ্ধদের প্যাগোডাসহ সব ভালো ভালো জায়গা- আমাদের দেখালেন।

যতদূর খবর নিয়ে জানলাম, ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপ্লবীরা বহু স্থান দখল করে আছে, আর মাঝে মাঝেই রেঙ্গুন শহরের পানি বন্ধ করে দেয়। আর একটা ভয়াবহ খবর পেলাম, ব্যান্ডিটরা দিনে দুপুরে ডাকাতি করে। ভয়েতে দিনের বেলায়ও কেউ জানাশোনা মানুষ না হলে দরজা খোলে না।

আতাউর রহমান সাহেবের আর এক চেনা মানুষ, খুব নামকরা রেঙ্গুনেই থাকেন, তিনি একজন ডাক্তার, তার বাড়িতে আমরা যাই। তিনি বাড়ি ছিলেন। অনেক ডাকাডাকি করলাম, দরজা খোলে না। দোতলার উপর থেকে ওই দেশী এক মহিলা কথা বললেন। তাকে দরজা খুলতে বলা হলো, তিনি অস্বীকার করলেন। আমরা বললাম, একটু কাগজ দেন, একটা চিঠি লিখে রেখে যাই। তিনি বললেন, কাগজ দিতে হলে দরজা খুলতে হবে। তোমাদের চিনি না।

পরে চিঠি লিখে তাকে নিতে বললাম, তিনি অস্বীকার করলেন। বললেন, ‘ওখানে ফেলে যাও, তোমরা চলে গেলে আমি কুড়াইয়া নিব।’ আমরা আজমল খাঁ সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, এর কারণ কী? তিনি বললেন, ‘এইভাবে ডাকাত দল বাড়িতে আসে, তারপর হাত পাও বেঁধে সর্বস্ব নিয়ে চলে যায়। এটা দিনের বেলায় প্রায়ই হয়ে থাকে। পথের থেকেও টাকাওয়ালা লোক ধরে নিয়ে যায়। পরে টাকা দিলে ছেড়ে দেয়।’ যা হোক, এরপর প্যাগোডা দেখতে গেলাম। প্যাগোডা বৌদ্ধদের প্রার্থনা করার মন্দির। অনেক অর্থ দিয়ে গড়া বিরাট বিরাট মন্দির, দেখতে খুবই সুন্দর। ও দেশের লোকগুলো খুবই ধর্মভীরু বলে মনে হলো। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এক একটা মন্দির করেছে।

রাত্রে আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের ঢাকার লোক, মিষ্টভাষী সন্দেহ নাই। আমরা যেয়ে দেখি ছবি দেখছেন, সে ছবি আমাদের রাষ্ট্রদূতের অফিস থেকে তোলা হয়েছে। প্রায় সকল ছবিই আমাদের রাষ্ট্রদূতের নিজের ও তার আত্মীয় পরিবার পরিজনের। কোথায় কবে খানা খেয়েছেন, কবে ব্যাঙকোয়েট’ দিয়াছেন, ব্রহ্মদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রদূত অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলো রঙিন ছবি। কত টাকা খরচ করা হয়েছে, গোপনে খোঁজ নিতে চেষ্টা করলাম। অনেকে অনেক রকম বলল, মনে হয় যথেষ্ট খরচ হয়েছে।

রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সাথেই থাকেন, বিরাট অফিস ও বহু কর্মচারী তাকে সাহায্য করে। দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়া এত জাঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালো হতো। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতো জায়গাও নাই। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। তাদেরই সামনে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়। নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করে আর খোদার কাছে ফরিয়াদ জানায়। জানি না খোদার কাছে সে ফরিয়াদ পৌঁছে কি না!

ব্রহ্মদেশ সম্বন্ধে যা কিছু শুনলাম ও বুঝতে পারলাম তার কিছুটা প্রকাশ করতে চাই। অনেকেই জানেন ওদেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। যাকে আমরা অনেকেই ‘বিপ্লব’ বলে থাকি। কম্যুনিস্ট ও কারেন সম্প্রদায়ের লোকেরা যুদ্ধ করছে সরকারের বিরুদ্ধে, দেশকে নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য। উ ন্যু সরকারও তাদের সাথে ভীষণ যুদ্ধ চালাচ্ছে; কিন্তু ৫-৬ বছরেও বিদ্রোহীদের দমন করতে পারছে না। তার প্রধান কারণ এটা একটি জঙ্গলময় দেশ। বিরাট বিরাট বন, পাহাড় নদীর সংখ্যাও খুব বেশি। কখনো বিদ্রোহীরা সম্মুখ যুদ্ধে আসে না। গেরিলারা যুদ্ধ চালায়। হঠাৎ আক্রমণ করে গভীর বনে পালাইয়া যায়। কার সাধ্য তাদের খুঁজে পায়!

তবে বিদ্রোহীরা কিছু করতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণ জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। সংগ্রামরত কম্যুনিস্টরা একটি সুবিধা পেয়েছে কারেন সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে। কারেন একটা জাতি। এরা ব্রহ্মদেশ সরকারের কাছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করে, কিন্তু সরকার তা দিতে অস্বীকার করায় তারা কম্যুনিস্টদের সাথে এক হয়ে বিপ্লব শুরু করে। জাপান যখন ব্রহ্মদেশ অধিকার করে তখন এরা বহু অস্ত্র জোগাড় করে। পরে সরকারের সাথে যুদ্ধে এইগুলো কাজে লাগায়। এখন ব্রহ্ম সরকার কারেনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দিতে রাজি আছে। কারেনদের যদি ব্রহ্ম সরকার হাতে নিতে পারে অথবা তাদের সঙ্গে একটা মিটমাট করতে পারে তাহলে কম্যুনিস্টরা বেশি দিন টিকতে পারবে না, হয় তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে, না হয় দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।

পূর্বেই বলেছি, জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। কম্যুনিস্টদের জনসমর্থন তত নাই। কারণ তারা মাঝে মাঝে রেঙ্গুন শহরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যাকে তাকে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করে, আর যে অঞ্চল তাদের অধিকারে যায়, সেই অঞ্চলের জনগণের কাছ থেকে অর্থ ও খাদ্য আদায় করে। বোধ হয় গভীর জঙ্গলে থাকে তারা, তাই জোগাড় করতে পারে না খাদ্য ও অন্যান্য, যা তাদের বিশেষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এটুকু জানবার সুযোগ হয়েছে আমার।

অনেক রাত্রে হোটেলে ফিরে এলাম। সেখানেও অনেকের সাথে আলাপ হলো। ভোরেই আমাদের প্লেন ছাড়বে। তাই একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। খুব ভোরে আমাদের প্লেন ছাড়ল। প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে আমরা ব্যাংককে পৌঁছলাম। সামান্য এক ঘণ্টা বিশ্রাম করার পর আবার রওয়ানা হলাম হংকংয়ের দিকে। প্রায় ৪ ঘটিকার সময় আমরা হংকং পৌঁছলাম। যাবার সময় প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে আমাদের উড়োজাহাজ চলল, নিচে সমুদ্র। আমরা উড়ে চলেছি, মাঝে মাঝে মেঘ দেখলে মানিক ভাই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আবার বামপিং আসছে, খেয়েছে বাবা!’ আমরা সাবধান হয়ে বসতাম। কারণ প্লেন মেঘের মধ্য দিয়ে যাবার সময় নিচের দিকে নেমে পড়ে, তাতে অনেকের দম নিতে কষ্ট হয়। কারণ মেঘের মধ্যে হাওয়া থাকে না।

হংকংয়ের কাছে যখন গেলাম তখন মনে হতে লাগল, আহা দূর থেকে দেখতে কী সুন্দর দেশ! পাহাড়ের উপর থেকে আস্তে আস্তে একটা দেশ নিচের সমুদ্র পর্যন্ত নেমে আসছে, মধ্যে মধ্যে নদী। একটা বাড়ি অনেক উপরে, একটা বাড়ি অনেক নিচে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভিড়ে আছে, কোনো কোনো জাহাজ আবার ছেড়ে যাচ্ছে। আবার ছোট ছোট লঞ্চগুলো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।

আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।

হংকংয়ের কোলন হোটেলে আমাদের রাখা হলো। কিছু সময়ের মধ্যে পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পীর সাহেব মানকী শরীফ, খান গোলাম মহম্মদ খান লুন্দখোর, ফজলুল হক সায়েদা, মি. হানিফ এবং পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন নেতা পৌঁছালেন। তাদের মধ্যে পাঞ্জাব মুসলিম লীগ দলের মি. আবদুল কাইয়ুমও সদস্য ছিলেন। সেখানে বসে আমাদের নেতা ঠিক করা হলো। সকলে মিলে পীর মানকী শরীফকে পাকিস্তান ডেলিগেশনের নেতা এবং জনাব আতাউর রহমান খান ও জনাব মাহমুদুল হক কাসুরী ডেপুটি নেতা হলেন। কম্যুনিস্ট দেশে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে অধিকাংশই আমরা কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন না। ভারতবর্ষ থেকেও কম্যুনিস্ট ছাড়া অনেকে বড় বড় কংগ্রেসি, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃবৃন্দ গিয়াছিলেন। আমরা আওয়ামী লীগের লোকসংখ্যায় বেশি হয়ে গেলাম; কম্যুনিস্টরা আমাদের। ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে থাকে; আর মুসলিম লীগরা কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন বলে গালমন্দ করে থাকে।

আমরা চা খেলাম। কাগজের রিপোর্টার এসে আমাদের ফটো নেয়া শুরু করল। আমরা হোটেলে এসে দেখলাম যার যার মালপত্র তার তার রুমে ঠিক করে রাখা হয়েছে। কাপড়-চোপড় পরিবর্তন করে তাড়াতাড়ি আমরা হংকং শহর দেখতে বের হলাম। কিছু কাপড়-চোপড়ও আমাদের কিনতে হবে। আমরা আমাদের পাকিস্তানি টাকা পরিবর্তন করে হংকং ডলার করলাম। হংকংয়ে বহু দোকান দেখলাম সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুদের। আমাদের পেয়ে তারা খুব খুশি হলো। তাদের দোকান থেকেই আমরা মালপত্র কিনলাম। তারা আমাদের কাছে দেশের কথা জানতে চাইল। তারা বলল, ‘আমরা পাকিস্তানি, দেশে ফিরে যেতে পারব কি না? আমাদের আত্মীয়স্বজন সকলেই হিন্দুস্তানে চলে এসেছে। বাড়িঘর বোধ হয় নাই।’ অনেক প্রশ্ন করলেন। আমরাও তাদের সান্ত¡না দিলাম। বললাম, দেশ সকলের, আপনারা ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আপনাদের ঘরবাড়ি ফিরে পাবেন।

এক দোকানদারের একটা যুবক ছেলে ছিল। সে দোকানেই থাকত। আমার সাথে আস্তে আস্তে আলাপ করা শুরু করল। জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কম্যুনিস্ট? বললাম, না। আমাদের স্বতন্ত্র দল আছে, দলের নাম তাকে বললাম এবং বললাম আমাদের প্রোগ্রাম আছে, ম্যানিফেস্টো আছে। আমাদের দলের নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। আইন করে কারো কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্য আমাদের দলের নাই। আমরা দেশের সম্পদ এবং ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ দিয়ে দেশ গড়তে চাই। ভাড়া করে কোনো আদর্শ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আবার মিছামিছি কোনো আদর্শকে লোকের চোখে হেয় করতেও চাই না। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি।’ সে অনেক কিছু জানতে চাইল, যতটুকু উত্তর দেয়া যায় দিলাম। যেখানে দেয়া যায় না, হ্যাঁ, না বলেই শেষ করে দেই। কারণ দেশের ভিতরে আমাদের সরকারের অন্যায়-অত্যাচার সম্বন্ধে বললেও বিদেশে বলার পক্ষপাতী আমরা নই। কারণ এটা আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার বলে মনে করি।

যা হোক, ভদ্রলোক যখন দেখল আমি কম্যুনিস্ট না এবং আমার কথায় যখন তার বিশ্বাস হলো, তখন সে আমার সাথে প্রাণ খুলে আলাপ করতে আরম্ভ করল। ভদ্রলোক কট্টর কম্যুনিস্ট-বিরোধী।

তিনি আমাকে নয়াচীন সম্বন্ধে অনেক আজগুবি গল্প বলতে শুরু করলেন। বিশেষ করে এ কথা বললেন যে, নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে অনেকের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে, অনেককে ফাঁসি দিয়েছে, অনেককে গুলি করে হত্যা করেছে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে হংকংয়ে পালিয়ে এসেছে। আজ তাদের দুর্দশার সীমা নাই। বুঝলাম, লোকটা ভাবপ্রবণ। সামান্যতে কাতর হয়ে পড়েছে। আজকের রাজনীতির যে একটা ধারা- যে যখন ক্ষমতায় আসে তখন বিরুদ্ধ পার্টির ওপর অত্যাচার চালায়। যেমন- রাশিয়ায় ম্যালানকভ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে স্ট্যালিনের প্রধান কমরেড রাশিয়ার ১০ বৎসরের হোম মিনিস্টার, লোনাভর, রাতারাতি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে গেলেন এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। আবার আমেরিকায় কম্যুনিস্ট মত পোষণ করে বলে অনেক আমেরিকানকে জেলে পচে মরতে হচ্ছে। এমনকি রোজেনবার্গ দম্পতিকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। যাক, তিনি আমাকে অনেক করুণ কাহিনী শোনালেন।

আমি ভাবলাম কিছুটা সত্যই হতে পারে। তিনি আরো আমায় বললেন, দেখেন যারা নয়াচীনে যায় যাবার সময় একরকম থাকে আর ফিরে আসার সময় আর এক রকম হয়ে যায়। আমি বললাম, বুঝাইয়া বলুন। তিনি বললেন, ওখান থেকে ফিরে যখন আসে তখন নয়াচীন সরকার ও জনসাধারণের খুব প্রশংসা করে।

আবার বলল, এর কারণ জানেন? ওখানে গেলে সুন্দর সুন্দর মেয়ে আপনাদের কাছে আসবে, আপনাদের সকল সময় মুগ্ধ করে রাখবে। কিছু দেখতে দেবে এবং আদর করবে এত বেশি যে আপনারা দুনিয়া ভুলে যাবেন। আমি ভাবলাম, লোকটা অন্ধ। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের লোভ মোহ দিয়া ভোলানো সোজা না। তা হলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগওয়ালারা তা পারত। মনে মনে ভাবলাম, ‘জেলে দিয়া, মিথ্যা মামলার আসামি বানিয়ে, ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত করে নানা প্রকার অত্যাচার করেও আমাদের মতের পরিবর্তন করা যায় নাই। দেখা যায়, হংকংয়ে থেকে কম্যুনিস্ট বিরোধী হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ চীনের অনেক বড় বড় লোক কম্যুনিস্ট জুজুর ভয়ে হংকংয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তবে আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে। অনেকে আবার হুজুগে এসে বিপদে পড়েছে। এইভাবে বহুলোক হংকংয়ে সামান্য জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। যা হোক, ফেরার পথেও দু’দিন হংকংয়ে ছিলাম, তাই হংকং পর্ব শেষ করে নয়াচীনে ঢুকব।

হংকং ইংরেজ কলোনি, ইংরেজই শাসন চালায়, তবে হংকংয়ের বাসিন্দাদেরও প্রতিনিধি থাকে। একদিকে বিরাট বিরাট দালানকোঠা আর ব্যবসাবাণিজ্য, আর একদিকে লাখ লাখ গরিব রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছে। সকলের চেয়ে বড় আয় নারী ব্যবসায়। তাই দিয়েই বহু লোক সংসার চালায় দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ শহর বলে বহু লোক এখানে বেড়াতে আসে। যার কারণে ইংরেজদের ব্যবহার খুব ভালো। মিছামিছি লোককে হয়রানি বা পেরেশান করে না। তাদের ব্যবহার ও গণতন্ত্রের জন্য মানুষ হিসেবে ইংরেজ জাত শ্রেষ্ঠ, যদিও আমার এটা ব্যক্তিগত মত।

আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই, ইলিয়াস ও আমি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ১৬-১৭ বৎসরের একটা মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল লাগাইয়া দিতে অগ্রসর হয়। মেয়েটি কলারে হাতও দিয়াছে, খান সাহেব হঠাৎ যেন চমকাইয়া উঠলেন। পরে ধাক্কা দিয়া ফুল ছুড়ে ফেলে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে এগিয়ে চললেন। মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মতো যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কী? আতাউর রহমান সাহেব তো রাগে অস্থির, আর মানিক ভাই তো তার রাজনৈতিক মঞ্চের মতো ঘুরাইয়া ফিরাইয়া ওনার পিছনে লাগলেন। আমরা খুব হাসাহাসি শুরু করলাম। বেচারা ভদ্রলোক রাগে শোকে দুঃখে কথা বলেই যেতে লাগলেন।

হংকংয়ে ফুল দেয়াটা হলো প্রেম নিবেদন। ফুলটা গ্রহণ করলেই ওরা মনে করবে আপনি তার সাথে যেতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে হাত ধরে সাথে করে ওদের জায়গায় নিয়ে যাবে। বেচারি ভেবেছিল, আমাদের দলের নেতা মোটাসোটা ভালো কাপড় পরা, গম্ভীর প্রকৃতির-টাকা পয়সাও নিশ্চয় যথেষ্ট আছে। ঠিকই ধরেছিল কিন্তু বেচারি জানে না, আমাদের নেতা নীরস ধর্মভীরু মানুষ, ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করেন আর তার একমাত্র সহধর্মিণীকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসেন। এসব দিকে খেয়াল দেয়ার মতলব ও সময় তার নাই। তবে এই মেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ কী? এই সমাজব্যবস্থা। বাঁচবার জন্য এরা সংগ্রাম করছে, ইজ্জত দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করছে। হায়রে মানুষ! রাস্তায় রাস্তায় বহু মেয়েকে এইভাবে হংকং শহরে ঘুরতে দেখা যায়, অধিকাংশ চীন দেশের মোহাজেরান। জুজুর ভয়ে হুজুগে এসে এখন ফিরে যেতেও পারে না, আর কাজ করে যে খাবে সে ব্যবস্থাও নাই।

অনেক দুঃখে দিন কাটছে ওদের। দেশের মালিক ইংরেজ, জনগণ না। ইংরেজ জাত, যে যায় তাকে আশ্রয় দেয়, তাই এত যুদ্ধের পরেও জাতটা বেঁচে আছে আর থাকবেও। আমাদের সাথে অনেক ইংরেজের দেখা হলো, আলাপ হলো। যখন শুনল আমরা পাকিস্তানি, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের একটা দেশ, খুব খাতির করতে লাগল। ভালো ব্যবহারও করল। এবং অনেক বিষয়ে আলাপ করল। চীন দেশে যাবো শুনে আমেরিকানদের মতো আঁতকে উঠল। একজন বলল, বহুদিন পরে চীন দেশে একটা সত্যিকারের সরকার কায়েম হয়েছে। এখন চীন দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।

হংকংয়ে না পাওয়া যায় এমন কোনো জিনিস নাই। মালপত্র খুব সস্তা। সেখানে জিনিসের দামের ওপর ট্যাক্স না বসানোর জন্য জিনিসপত্র খুবই সস্তায় পাওয়া যায় বিশেষ করে কাপড়, ঘড়ি, পেন এবং নানাবিধ কনজুমার্স গুড’স। পাকিস্তানি টাকার ছয় টাকায় যে হাওয়াই শার্ট পাওয়া যায় তার দাম আমাদের দেশে ৩০ টাকা। যে গরম জ্যাকেট আমি এনেছিলাম পাকিস্তানি টাকার মূল্যে ২৪ টাকায় তার দাম আমাদের দেশে কমপক্ষে ১০০ টাকা। যে স্যুট আমি ও আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যরা ৬০ টাকায় বানাইয়া আনি, তার দাম কমপক্ষে আমাদের দেশে ২০০ টাকা। অন্য জিনিসের দাম আপনারা চিন্তা করে দেখতে পারেন এই পরিমাণে কম হবে। ঘড়ি ও পেনের দাম আমাদের দেশে হংকংয়ের থেকে ডাবল হবে। তবে সেখানে খাদ্যের দাম প্রায় আমাদের দেশের মতোই। খাবার বিদেশ থেকে আনতে হয়।
কারণ হংকং চীন দেশের মেইনল্যান্ডের পাশে ক্ষুদ্র একটা দ্বীপময় স্থান। যথেষ্ট খাবার হতে পারে না, কেননা লোকসংখ্যা খুবই বেশি। চোর ডাকাত খুব বেশি নাই। ইংরেজ সেটা দমন করেছে, তবে ৪২০-এর আমদানি কিছুটা বেশি। নতুন মানুষ দেখলে কিছুটা চেষ্টা করে বই কি! তবে আমাদের ওপর চালাতে পারে নাই। কারণ আমরা হুঁশিয়ার ছিলাম।

রাত প্রায় ৯টায় আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আমি ও ইলিয়াস এক রুমে ছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পরে খুব আরামে ঘুম হলো, কারণ ক্লান্ত ছিলাম। সকালে উঠে আমরা গোসল করে প্রস্তুত হলাম, কারণ নয়াচীনে রওয়ানা করব। আমাদের সকালেই খবর দিয়ে যাওয়া হলো। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আমাদের সকল কিছু দেখাশুনা করতে লাগল। সকাল ৯টায় আমরা কোলন রেল স্টেশনে উপস্থিত হলাম। আমাদের মালপত্র পূর্বেই স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেয়ে দেখি মালপত্র ট্রেনের কামরায় উঠে যাচ্ছে। ট্রেনগুলোর কামরা আমাদের দেশের কামরার মতো না। দুইটা করে সিট, একটা বেঞ্চ (ইবহপয)-গদি দেয়া, আমরা উঠে পড়লাম। কিছু সময় পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো।

নয়াচীন ও হংকংয়ের সীমানায় এলাম। ছোট একটা খাল দ্বারা ভাগ হয়েছে। আমরা ইংরেজের জায়গায় নামলাম। ছোট স্টেশন, অনেক বই পাওয়া যায়। আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করা হলো। ভিসা এনে দেয়া হলো। আমাদের জন্য দোভাষী ঠিক করাই ছিল, যথাসময়ে এসে হাজির। আমাদের শরবত খাওয়াল। আমাদের মালপত্রের জন্য চিন্তা নাই, চীনের শান্তি সেনারা (শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী) তার দেখভাল করেছে। পরীক্ষা করে ইংরেজ সীমানা থেকে চীন সীমানার পূর্বে নিয়ে গিয়েছে। সব মিলে এসে প্রায় দু’ঘণ্টা লাগল। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে আরম্ভ করলাম।

কিছুক্ষণ পরে দোভাষী এসে আমাদের জানাল, এবার আপনারা রওয়ানা করুন। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সকলই ঠিক হয়ে গেছে। একটা পুল পার হয়ে নয়াচীনে ঢুকতে হবে। পুলটার অর্ধেক হংকংয়ের, অর্ধেক নয়াচীনের। দু’পাশেই বন্দুকধারী প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। আমরা আবার ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমরা ক্যান্টন শহরে যাচ্ছি। এই শহরটা খুবই সুন্দর, অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে লাল চীন সৈন্যবাহিনী এই শহর দখল করে এবং চিয়াং কাইশেক ফরমোজা দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

আমরা ট্রেনে কিছু খেয়ে নিলাম। ফলের জোগাড় যথেষ্ট তারা করেছে। এই সময়ে মানিক ভাইয়ের কথা সামান্য লেখা দরকার। মানিক ভাই ভালো লেখতে পারেন, কিন্তু এত যে খেতে পারেন তা আগে জানতাম না। সমানে খেতে শুরু করলেন, মনে হলো প্রায় ২-৩ ঘণ্টা খেয়েই চললেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মানিক ভাই পেটে হলো কী? বললেন, দুর্ভিক্ষ হয়েছে। মানিক ভাই দোভাষীকে নিয়ে বসলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আর খাওয়ার পরে খাওয়া চলল। মানিক ভাইয়ের স্মরণশক্তি অস্বাভাবিক, নোট করতে হয় না। কেমন করে সব কিছু মনে রাখেন বুঝতে পারি না। যা হোক, আমিও একটি মাস্টারকে নিয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন না, দোভাষী তার কথা আমাকে বুঝাইয়া দেয়, আমার কথা তাকে। আলোচনাটা পরে উল্লেখ করব।

রেলগাড়ির কথা বলি। কম্যুনিস্ট দেশ বলে সকল সমান হয়ে যায় নাই। ট্রেনে দু’রকম ক্লাস আছে, নরম ক্লাস আর শক্ত ক্লাস। ভাড়ায়ও ব্যবধান আছে। প্রায় দু’গুণ। একটায় গদি আছে আর একটায় গদি নাই। হেলান দিয়ে দু’জন করে বসতে পারে বেঞ্চিতে। রাতে ঘুমাবার বন্দোবস্ত আলাদা রুমে হয়। সেখানেও দিনে থাকা যায়। নরম ও শক্ত ছাড়া সুবিধা প্রায় সমান। প্রত্যেক গাড়িতে লাউড স্পিকার ঠিক করা আছে, পথে পথে গান চলে। সাবধান হয়ে বসবার জন্য এবং ময়লা বা নোংরা না করার অনুরোধ করে।

বড় বড় নেতাদের রেকর্ড করা বক্তৃতা শোনানো হয়। কোনো খবর থাকলে বলা হয়। আর স্টেশনের নিকটে আসলে ১৫ মিনিট পূর্বেই বলে দেয়া হয়, সামনে অমুক স্টেশন। যাত্রীদের তাতে খুবই সুবিধা হয়। চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে বেড়াতে হয় না। অনেক সময় ঘুমাইয়া থাকার জন্য অথবা নতুন মানুষকে জানতে না পেরে স্টেশন পার হয়ে চলে যেতে হয় না। এমনি প্রত্যেক স্টেশনে বলে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে এসে কামরাগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। কোনো ময়লা পড়ে থাকলে মুছে নিয়ে যায়।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খুবই খেয়াল। গাড়িতে খাবার ঘরও আছে। যাদের খাওয়ার দরকার খেয়ে নেয়। টিকিট চেকার সাহেব মাঝে মাঝে ঘুরে যান। তবে যতদূর জানলাম বিনা টিকিটে কেহ ভ্রমণ করে না। একজন টিকিট চেকার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার দোভাষীর মাধ্যমে-আপনি টিকিট ছাড়া লোক কত দিন দেখেন নাই? সে বলল, প্রায় দেড় বৎসর। তবে যদি গাড়ি ছাড়বার সময় তাড়াতাড়ি উঠতে হয়, তবে পরের স্টেশনে আমাকে খবর দেয় আমি টিকিট দিয়ে আসি। আজকাল আর আমাদের টিকিট চেক করতে হয় না, কারণ কেহই বিনা টিকিটে গাড়িতে ওঠে না। আর ফাঁকি দিতেও চেষ্টা করে না। তারা মনে করে এ পয়সা তাদের নিজেদের, রাষ্ট্র তাদের, গাড়ি তাদের, নিজেকে ফাঁকি দিয়া লাভ কী? তবুও সে বলল, অন্যান্য লাইনে ২-১টা ঘটনা এখনো আছে, তবে ধরা পড়লে যাত্রীর দলই তাকে এমন শায়েস্তা করে, জীবনেও ভুলবে না। আর সরকারও ভীষণ শাস্তি দেয়।

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি চিয়াং কাইশেকের সময় চাকরি করতেন? উত্তর, হ্যাঁ। তবে এরা আপনাকে রাখল কেন? তিনি বললেন, আমরা অনেকেই আছি বিশেষ করে যারা ঘুষ খেতাম না। ঘুষ যারা খেত তারা অনেকে পালিয়ে গেছে। আমাদের পূর্বেই ইউনিয়ন ছিল। আমি ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম গোপনে। আমরা ইউনিয়নের সদস্য হয়েছি এ কথা জানলে চিয়াং কাইশেকের দল আমাকে তাড়াইয়া দিতো, না হয় জেলে দিতো।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি মনে করেন, চোরের দল পালাইয়া গেছে আর যারা সাধু বলে পরিচিত তারা আছে?’ তিনি উত্তর করলেন, ‘এ কথা আপনি বলতে পারেন। তবে যারা সত্যবাদী, ঘুষ খায় না, দেশকে ভালোবাসে ও কর্মঠ তারা আছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বেতন কত পান?’ উত্তর দিলেন, ‘বেশ পাই, চলে যায়। চিয়াং কাইশেক আমলের চেয়ে বেশি পাই। থাকবার জায়গা পাই। অনেক সুবিধা আছে। তবে তাড়াতাড়ি তো কিছু হয় না, সময় দরকার।’ আমি আর বাড়াবাড়ি করলাম না। কারণ বেচারাও আমার সাথে আর আলাপ করতে চান না ভাবেসাবে বুঝলাম।