Naya Diganta

জোয়ার আর ভাঙনে নির্ঘুম রাত

জোয়ারে ভোলায় প্লাবিত এলাকা : নয়া দিগন্ত

সাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ারের পানি কমলেও উপকূলের ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্ভোগ কাটছে না। ইতোমধ্যে তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘর, ফসলি জমি আর রাস্তাঘাটের করুণ দশায় এখন তাদের মাথায় হাত। মাঠের ফসল ও পুকুর-ঘেরের মাছ হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে অসংখ্য কৃষক এবং মৎস্যচাষি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অনেক স্থানে নদীভাঙনের প্রকোপ। বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়ার পর এখন ভাটার টানে শুরু হয়েছে ব্যাপক ভাঙন। দফায় দফায় ভাঙনে বিপন্ন হয়ে পড়েছে নদীতীরবর্তী বহু এলাকার মানুষ। আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে হুমকির মুখে থাকা কোনো কোনো এলাকার লোকজনের। সাম্প্রতিক উঁচু জোয়ার আর নদীভাঙনের কবলে পড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।


কয়রায় বাঁধ ভেঙে ৫ গ্রাম প্লাবিত
খুলনা ও পাইকগাছা সংবাদদাতা জানান, এক মাস না পেরোতেই কপোতাক্ষ নদের জোয়ার অস্বাভাবিক বেড়ে খুলনার কয়রায় আবারো বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। গতকাল শনিবার দুপুরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চরামুখা গ্রামের অস্থায়ী রিং-বাঁধটি ভেঙে অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দফায় দফায় ভাঙনের মুখে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।
এর আগে, গত ১৭ জুলাই ভাটির টানে প্রায় ২০০ মিটার জায়গাজুড়ে ভাঙন শুরু হলে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে মেরামতের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ওই দিন দুপুরে জোয়ারের সময় দ্রুত পানি বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, বাঁধের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেন না। যার ফলে দফায় দফায় ভাঙনের মুখে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো: আব্দুর ছালাম খাঁন জানান, দুপুরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে অস্থায়ী রিং-বাঁধটি ভেঙে গিয়ে মুহূর্তেই প্রায় চার-পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।


ভেসে গেছে ভোলার শতাধিক পুকুর-ঘেরের মাছ
ভোলা সংবাদদাতা জানান, টানা পাঁচ দিনের অস্বাভাবিক জোয়ারে ভোলার তিনটি ইউনিয়নের শতাধিক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে চরম সঙ্কটে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর ও ঘেরের মালিকরা। মাছচাষিদের অনেকেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মৎস্য বিভাগ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হলেও কবে নাগাদ তারা সহায়তা পাবেন তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
জানা গেছে, গত পাঁচ দিন ধরে মেঘনার পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আর এতেই অতি জোয়ারে তলিয়ে গেছে ভোলা সদরের রাজাপুর, ধনিয়া ও ইলিশা ইউনিয়নের শতাধিক পুকুর ও ঘের। রাজাপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো: হারুন বলেন, পুরো রাজাপুর ইউনিয়নের অর্ধশত ঘের ও পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত। জোয়ারের পানির এত চাপ বেড়েছে যে, রাস্তাঘাটও ভেঙে গেছে।
রাজাপুর ইউনিয়নের কন্দকপুর গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চার দিকে পানি, বাড়ির উঠান, রাস্তাঘাট ফসলের ক্ষেতসহ বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। এমন চিত্র দেখে বোঝা যাচ্ছে না এখানকার কোনটি পুকুর বা ঘের ছিল। জোয়ারের পানিতে জনপদের পুরো এলাকা যেন ভাসছে। এমন চিত্র শুধু কন্দকপুর গ্রামের নয়; একই চিত্র মেদুয়া, চর মোহাম্মদ আলী, দাউয়া, মেদুয়া, রামদাসপুর ও শ্যামপুর গ্রামে। ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ভিটা তলিয়ে যাওয়ায় অনেকের ঘরে রান্নার চুলো জ্বলছে না। এ দিকে জোয়ার এলেই বারাবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধের বাইরের এসব মানুষ। তাদের জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মানের দাবি ভোলাবাসীর।


নাজিরপুরে ১০ একর জমি বিলীন
নাজিরপুর (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, নাজিরপুরের মথুরাবাদ ও ভুবনখালী গ্রাম সংলগ্ন কালীগঙ্গা নদী তীরবর্তী চরে গতকাল শনিবার সকাল ৬টার দিকে প্রায় ১০ একর আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। সেখানে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এর আগে সমুদ্রে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। পরে নদীর পানি কমার সাথে সাথে তীব্র স্রোত হওয়াতে ভাঙন শুরু হয়েছে। গতকাল মুহূর্তের মধ্যে ভাঙনের ঘটনার খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আবদুল্লাহ সাদীদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
জানা যায়, নদীতে বিলীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মথুরাবাদ ও ভুবনখালী গ্রামের প্রায় ১৫টি পরিবার। হুমকির মুখে রয়েছে আরো প্রায় ২০টি বাড়িসহ রাস্তাঘাট ও মন্দির। আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এলাকার মানুষ। শ্রীরামকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন বেপারী বলেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়বে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। নদীতে পানি কমার সাথে সাথে তীব্র স্রোতের কারণে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।


গজারিয়ায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে অর্ধশত পরিবার
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মেঘনা নদীর ভাঙাগড়ার খেলায় দিশেহারা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নের ভর কালীপুরা গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার। মেঘনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে নদীভাঙন। প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের বসতবাড়ি, গাছপালা। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে কালীপুরা গ্রামের অর্ধশত মানুষের। কেউ কেউ ঘর ও মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। জমিজমা ও বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।
ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীপাড়ের মানুষের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ। পরিবার-পরিজন নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিনরাত। প্রতিটি মুহূর্ত শঙ্কিত থাকতে হয় তাদের। চোখের সামনে ভিটাবাড়ি মেঘনায় বিলীন হয়ে যেতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। ভাঙনের শিকার কালীপুরা গ্রামের বৃদ্ধ সরাফত আলী প্রধান বলেন, আমি দরিদ্র কৃষক। ১০ বছরে বাড়ি সরিয়েছি পাঁচ-ছয়বার। এবারও ভাঙনে আমাদের বসতবাড়ি ও গাছপালা নদীতে চলে গেছে। দূরে কোথাও নতুন করে বাড়িঘর তোলার সামর্থ্য নেই। পরিবার নিয়ে কোনো রকমভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। শুধু তিনি নন, নদীপাড়ের অগণিত পরিবার একাধিকবার বাড়িঘর সরিয়েও মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু রক্ষা করতে পারছে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ভাঙনের কবলে এলাকার ৫০ থেকে ৬০টি পরিবারের বসতভিটা হুমকির মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১২টি পরিবার ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে ইমামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুজ্জামান খাঁন জিতু জানান, জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী উপজেলার নদীভাঙন বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে আশা করি কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।