Naya Diganta

রাধাও নেই, নেই বৃন্দাবনও

লেখক : জয়নুল আবেদীন

একদিকে ‘ফেসবুকে ভাইরাল ভিডিওতে শিক্ষক স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা’, ‘ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করায় শিক্ষক শাসন করেছিলেন বলে ক্ষুব্ধ হয়ে পিটিয়ে শিক্ষক হত্যা’ অপর দিকে, পপুলেশন কাউন্সিলের গবেষণার প্রতিবেদন, ‘বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ কিশোরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় (উইকি মিডিয়া), ‘শিক্ষকের বেতে মাদরাসাছাত্রের মৃত্যু’। তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আমরা শিক্ষকসমাজের প্রায় সবাই আসলে তা-ই। আমরা নির্যাতনবান্ধব, নির্যাতনের প্রশ্রয়দানকারী, এমনকি কখনো এর পরোক্ষ সহযোগী (১৮ মার্চ ২০২৩, প্রথম আলো)।

ভবানীপুর কেজেবি ডিগ্রি কলেজের গণিত বিভাগের সহকারী শিক্ষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ দত্ত কয়েক বছর ধরে সপরিবারে বসবাস করছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। অথচ তিনি কলেজ থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সালাম বিশ্বাস ও তার ভাই সুনীল দত্ত (৮ আগস্ট ২০২২, দেশ রূপান্তর)। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের এসব টানাপড়েন দেখে মনে হয়, মানুষের সাথে মানুষের আত্মার সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছে। সম্পর্কের চরম টানাপড়েনকালে গুরু-শিষ্য, মাতা-পিতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন ইত্যাদি সাপেক্ষ (Relative Term) সংস্রবের অন্তর্নিহিত অর্থও যেন অন্তঃসারবিহীন।

দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম। মক্তবে সূরা-কালাম ও প্রাইমারিতে বাংলা অক্ষর পরিচয় ও হিসাবপত্র জানাই যথেষ্ট ছিল। তার পরও হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৌঁছে যাই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে। দীর্ঘ পথে দেখা হয় কত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। কারো কথা মনে হলে শরীর ঘৃণায় শিরশির করে আবার কেউ কেউ ভাস্কর হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে মনের আকাশে।

আমি আর নওয়াব হোসেন সমবয়সী ও পাশাপাশি ঘর। শৈশব থেকেই দু’জন একসাথে লেখাপড়া ও খেলাধুলা। এক টেবিলে পড়াশেষে ঘুমিয়ে পড়তাম এক বিছানায়। মাতৃহীন নওয়াবের মাতৃস্বাদ পূরণ করতেন আমার মা। দু’জনের হাতে খাবার দিয়ে মা প্রায়ই বলতেন, ‘নোয়াব মৃত মায়ের দুধ পান করেছিল। ওর মা যখন কলেরায় মারা যায় তখন ওর বয়স এক বছর। খবর শুনে আমরা দেখতে যাই।

দেখি, নওয়াব মৃত মায়ের বুক থেকে দুধ পান করছে।’ দু’জনের কথা কাটাকাটিও হয়নি। যুদ্ধ ছিল স্নায়ুর, অর্থাৎ লেখাপড়া নিয়ে। ক্লাসে ‘রোল নং ১’ দখলের যুদ্ধ। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত চলছিল ওই যুদ্ধ। এরপর নওয়াব হোসেন চলে যায় কান্দারগাঁও, আমি যাই সোনারগাঁও (ঠাকুরবাড়ির স্কুল)। কান্দারগাঁও স্কুলকে বাবা বলতেন, ‘গনির বাপের স্কুল’। ‘গনির বাপ’ ক্যাপ্টেন মো: মোসলেহ উদ্দিনের (পিএসসি বিএন অবসরপ্রাপ্ত) দাদা আর আমার বাবার দোস্ত। স্কুলের জন্য জমি দিয়েছিলেন, তাই অনেকের কাছেই এরকম নামে পরিচিত।

শুক্রবার ছুটি। দু’জনই বৃহস্পতিবারের অপেক্ষায় থাকতাম। নাইওরিদের মুখে নতুন শ্বশুরবাড়ির কথা ছাড়া যেমন অন্য কোনো কথা নেই, তেমনি আমাদের দু’জনের মুখে নতুন স্কুলজীবনের কথা ছাড়া আর কোনো কথা ছিল না। ‘সফর স্যার’ নামটি নওয়াব হোসেনের মুখ থেকেই প্রথম শুনি। প্রাইমারিকালে বাবার বকুনির ভয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমার পাঠের প্রধান বিষয় ছিল ‘বিষাদ সিন্ধু’। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু থেকে ইমামদের কাহিনীসহ গাজী কালু চম্পাবতী, সোনাভান, ছয়ফলমুলক বদিউজ্জামাল, গফুর বাদশা বানেছা পরী ইত্যাদি পুঁথি পড়ে পড়ে বাবাকে শোনাতাম। তাই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ২৬টি বর্ণমালাসহ A-তে Apple, B-তে Book ছাড়া তেমন কিছু জানতাম না। নওয়াব হোসেনের মুখে যখন Parts of speech, Article, Preposition, Pronoun, Composition, Subject আর Verb-এর খই ফুটত তখন আমি বলতাম ঠাকুরবাড়ির গল্প। ঠাকুরবাড়ির কাঁচামিঠা আম, মেওয়া ফল আর চুপি চুপি কদমি লিচু খাওয়ার গল্প। সেখান থেকেই নওয়াব হোসেন আর আমার শিক্ষার সিঁড়ি আলাদা হয়ে পড়ে। নওয়াব হোসেন যখন তাদের প্রধান শিক্ষক ‘সফর স্যার’কে নিয়ে বড়াই করতেন তখন চুপ থাকতে পারতাম না- আমিও বড়াই করতাম আমাদের হেড স্যারকে নিয়ে। ইংলিশে 'Gold Medalist' আমাদের হেড স্যার। হেড স্যার ছিলেন হালকা, পাতলা ও বেঁটে। লোকের ভিড়ে নজরে পড়ত না। তাকে নিয়েই বড়াই করতাম। বড়াই করতে গিয়ে একই বাক্যে পাশাপাশি দু’টি 'the'-এর ব্যবহার প্রবাদবাক্যের মতো হয়ে গিয়েছিল। একবার জাতীয় পর্যায়ে প্রধান শিক্ষকদের এক সম্মেলনে ছিলেন হেড স্যারও। শিশুদের মতো দেখে কেউ একজন তাচ্ছিল্য করে- Who are you?
I am 'the the' head master of the BBNAM Institution.

উত্তর শুনে বিস্মিত হয়ে,
'the the'-এর ব্যাখ্যা?
প্রধান শিক্ষক হিসেবে একটি the প্রাপ্য। 'Gold Medalist' হিসেবে আরো একটা the প্রাপ্য।

এ বিষয়ে সঠিক তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও আমরা প্রবাদটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে গর্ববোধ করতাম। স্যার খালি হাতে মারতে গেলে কনুই ব্যবহার করতেন। স্যারের কনুইয়ের ‘মাইর’ যে খেয়েছে সে জীবনেও ভুলবে না। আমি একবার খেয়েছিলাম। যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন শুরু আলোমতি প্রেমকুমার যাত্রাপালা। আনন্দবাজার এলাকায় লজিং (থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে শিশুদের পড়ানো) থাকতাম। আমার পরিচয়, মুন্সি। মুন্সিদের যাত্রা দেখা দূরের কথা, নামাজ কাজা করলেই লজিং ক্যান্সেল। বারদী এলাকায় যাত্রার আসর। চৌদ্দ পয়সা টিকিট। রাত ১০টায় শুরু, ফজরের আজানের আগেই শেষ। গরিবের মেয়ে আলোমতি আর রাজার পুত্র প্রেমকুমার। জলপান করতে গিয়ে এক নজর দেখেই পাগল হয়ে যায়। সাথী-বন্ধুদের মুখে শুনে শুনে পাগল হয়ে যাই আমিও। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এক রাতে গিয়ে হাজির হই যাত্রাগানে। কিসের পরীক্ষা কিসের কী! পরীক্ষার হলে উত্তরপত্র সামনে নিয়েও যাত্রা দেখছিলাম। চুলে টান পড়তেই ঘুম ভাঙে। বাম হাতে চুল ধরে বেঞ্চের উপর কপাল ঠেকিয়ে ডান হাতের কনুই পিঠের উপর চালান করে যাত্রার ভ‚ত তাড়িয়েছিলেন।

নারায়ণগঞ্জ নতুন কোর্টের পাশে শিকদার ভিলার দোতলায় আমার চেম্বার। ছোটখাটো সাইজের এক লোক সিঁড়ি বেয়ে চেম্বারের সামনে এসে-

-এইটা জয়নুল সাবের চেম্বার? (স্বভাবসুলভ সম্মতি দিতেই সামনের চেয়ারে বসেন, বসেই) আপনার বাড়ি মেঘনা থানায়, আমার বাড়িও মেঘনা। আমার নাম সফর আলী।
-(নামটা শুনেই চমকে ওঠে) কোন সফর আলী? মাস্টার সফর আলী?
-জি, মাস্টার সফর আলী।

মাস্টার সফর আলী, শব্দটি কানে আসতেই স্প্রিংয়ের মতো আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে যাই। নতশির পা ছুঁয়ে- স্যার, আমি আপনার ছাত্র, মাফ করবেন, চিনতে পারিনি। আপনাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে সম্মান করা দরকার ছিল। যখন চিনতে পেরেছি তখন আর মক্কেলের চেয়ারে নয়, (আমার চেয়ার দেখিয়ে) ওই চেয়ারে বসুন।

এক প্রকার জোর করেই তাকে আমার চেয়ারে বসাই। বসেই জানতে চান, আমি কোন সালে তার ছাত্র ছিলাম।
-স্যার, আপনি আমার ভাবগুরু।

ভাবগুরু মানে?
-স্যার, ১৯৬৫ সালে হিন্দু-মুসলিম রায়টের সময় আমি ও নওয়াব হোসেন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। নওয়াব হোসেন কান্দারগাঁও জুনিয়ার হাইস্কুলে আর আমি সোনারগাঁও মধুঠাকুরেরবাড়ি এনএ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশনে। আপনি কান্দারগাঁও জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। নওয়াব হোসেনের মুখে আপনার নামটি শুনতে শুনতে হয়ে পড়েছিলেন- আমারও ভাবগুরু। মেঘনার শীর্ষে ওঠা অনেকেই আপনার ছাত্র।

আপনি যদি আমার কাল্পনিক ভাবগুরু না হয়ে প্রত্যক্ষ গুরু হতেন, আমার চেম্বার থাকত মহামান্য হাইকোর্টে। শিক্ষার শুরুতে ইংরেজি শেখার সুযোগ পাইনি। তাই ইংরেজিতে সারা জীবন রয়ে গেলাম ৩৩ মার্কা ছাত্র। আমার জুনিয়ররা তাদের ভিজিটিং কার্ড অলঙ্কৃত করে নামের পাশে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’ লিখে। ইংরেজি না জানার কারণে হাইকোর্টের সদস্যপদের জন্যও দরখাস্ত করি না।

আমার চেম্বারে সফর স্যারের আগমনের কারণ ছিল, শিক্ষকতা থেকে অবসরে গিয়ে সমাজসেবায় জড়িয়ে পড়েন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যানকালে স্থানীয় বিচার নিষ্পত্তির সময় জমিজমার বিরোধও নিষ্পত্তি করতেন। নারায়ণগঞ্জ জামতলা তার ছেলের বাসায় মাঝে মধ্যে আসেন। তখনই শোনেন আমার নাম। মাঝে মধ্যে আসতেন। জমিজমার নিষ্পত্তি আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না আলোচনা করতেন।

স্যারের মীমাংসা শুনে বলতাম, ‘স্যার, ইক্যুইটি ও ন্যায়পরতার ধারণা থেকেই আইনের জন্ম। যেহেতু স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে আপনি ন্যায়পরতার দৃষ্টিতে রায় দিয়েছেন সেহেতু আপনার রায় সঠিক।’

কথা প্রসঙ্গে শুনেছিলাম, তিনিও আহসান উল্লাহ স্যারের ছাত্র। এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে জানতে পারি, সফর আলী স্যার সোনারগাঁও জিআর ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাস করেন। আহসান উল্লাহ স্যার ছিলেন সোনারগাঁও BBNAM Institution-এর শিক্ষক, যা মঞ্জুরিপ্রাপ্ত হয় ১৯৫৭ সালে। দু’জনই প্রয়াত। পড়ে যাই গোলকধাঁধায়। আহসান উল্লাহ স্যারের বাড়ি সোনারগাঁ একই বাড়ির আইনজীবী এম এ বাতেন। আমার চেম্বারের কাছেই বাতেন সাহেবের চেম্বার। বাতেন সাহেবের কাছে জানতে পারি, আহসান উল্লাহ সাহেব, BBNAM Institution-এর আগে সোনারগাঁও জিআরে ছিলেন। দুয়ে দুয়ে চার অঙ্কটা মিলে যায়।

ঔপন্যাসিক পিয়ারা আপার মুখ থেকে ‘নূরুল হক স্যার’ নামটি শুনে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি, ‘কোন নূরুল হক স্যার?’ পরিচয় প্রাপ্তির পর পলকের মধ্যে মন পবনের ঘোড়া চলে গেল ছয় দশক আগে। মারের ভয়ে স্যারের নজর থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে প্রায় ছয় দশক। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় তিনি এখনো সুস্থ আছেন। নম্বর নিয়ে ফোন করতেই স্যারের সেই পুরনো কণ্ঠস্বর। আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেই প্রতিবাদ করে বলি-

-স্যার, আমি আপনার ছাত্র। আপনি ছাত্রদের ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। আপনার মুখে ‘তুই’ ডাক শোনার জন্য অনেক কষ্টে আপনার ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছি। আপনাকে ছাড়া ‘তুই’ সম্বোধন করার জন্য দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আপনার মুখে ‘তুই’ সম্বোধন শোনার জন্য কালই আসছি।

কাল অর্থাৎ গত ৯ আগস্ট গিয়েছিলাম স্যারের মুখে ‘তুই’ সম্বোধন শুনতে। স্যারের নজর থেকে আমার স্বেচ্ছা নির্বাসনের ঘটনা জানতে চাওয়ার উত্তরে বলেছিলাম, ‘স্যার, ঠাকুরবাড়ির স্কুলে ভর্তির পর শ্রেণীকক্ষে ঢুকেই শুনি, এই স্কুলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। প্রমাণটা সেদিন পাই যেদিন প্রথম ঝটিকা ক্লাস নেয়ার জন্য আমাদের শ্রেণীতে আসেন। এক ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তর বের হওয়ার আগেই ছাত্রটির প্রস্রাব বের হয়ে গিয়েছিল। আপনার ভয়ে প্রস্রাব বের হওয়া সেই ছাত্রটি আজ প্রথম শ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ার। এক বিকেলে স্কুলের কমন রুমে ক্যারমবোর্ড খেলছিলাম। পাশের কক্ষেই ছিলেন আপনি।

পরীক্ষার্থীদের কোচিং করছিলেন। আমাদের শোর-চিৎকারে কোচিং থেকে একজন ছাত্র পাঠিয়েছিলেন আমাদের ডেকে নেয়ার জন্য। আপনি ডাকছেন শুনে হার্টবিট বেড়ে যাওয়াসহ প্রস্রাবের উপক্রম হয়েছিল আমারও। তাই, আপনার ডাকে কাছে না গিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। তখন থেকেই আপনার কাছ থেকে আমার স্বেচ্ছা নির্বাসন শুরু। পথ দিয়ে হাঁটছেন, জানতে পারলে ওই পথ দিয়ে হাঁটতামও না। আশির দশকের ঘটনা। অঙ্কে ভালো ছাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার কদর বেড়ে যেত। যে বছর গৌরীপুর বাজারে আগুন লেগেছিল, সে বছর কান্দারগাঁও মুজাফফর আলী হাইস্কুলের এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র পড়েছিল গৌরীপুর। এক জুনিয়র বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য আগের রাতে গিয়েই আপনাকে দেখতে পাই। বন্ধুর কাছে আমার সমস্যার কথা বলে রাতেই চলে আসতে চাইলে বন্ধু বলেছিল, ‘আপনারা শুধু স্যারের বাইরের কঠিন আবরণটা দেখছেন, ভেতরের কোমল কুসুমটা দেখছি আমরা।

সামনে গিয়ে দেখুন; শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা, স্যার আপনাকে চিনতেই পারবেন না।’ তার পরও আমি আপনার সামনে যেতে সাহস পাইনি। ফজরের আজানের সাথে সাথে গৌরীপুর থেকে চলে এসেছিলাম।

আমার স্বেচ্ছা নির্বাসনের কাহিনী শুনে স্যার সহাস্যে, ‘আমি কি কিছু ভুল করেছিলাম?’ ছাত্রের কাছে শিক্ষকের প্রশ্ন। উত্তরে বলেছিলাম- না, স্যার ভুল করেননি, ঠিক করেছিলেন। ঠিক করেছিলেন বলেই, দেশের অনেক শীর্ষ পদে আজ আপনার শিক্ষার্থীরা। বছর তিনেক আগে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আহ্বানে বান্দরবানের লামা গিয়েছিলাম। সেখানে পাহাড়-জঙ্গলের অবহেলিত শিশু-কিশোরদের মাঝে কল্পনাতীত মেধা ও দৈহিক শক্তি দেখেছি। তা নিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ নয়া দিগন্ত পত্রিকায়, ‘অপ্রতিরোধ্য কসমো স্কুলের শিক্ষার্থী’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যার মর্ম, আত্মবিশ্বাস একজন সাধারণ মানুষকে অসাধারণ মানুষে পরিণত করতে পারে। প্রতিটি শিশু সুপ্ত প্রতিভা ও আত্মশক্তি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। শিশুর সুপ্ত প্রতিভা ও আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলাই শিক্ষকের কর্ম। সে কর্মটি আপনারা করতে পেরেছেন। আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে ‘সিংহ শাবক আর ভেড়ার বাচ্চা’ গল্পটি যখন শুনি, তখনই মনে পড়ে আপনাদের কথা। সফর স্যার আর আহসান উল্লাহ স্যার পরস্পর গুরু-শিষ্য। তাদের গুরু-শিষ্যের হিসেবটা বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার, অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও সক্রেটিসদের গুরু-শিষ্যের হিসেবের মতোই মিলে যায়। মিলে না কেবল বর্তমান গুরু-শিষ্যের হিসেব। কী করে মিলবে? এখন রাধাও নেই, নেই বৃন্দাবনও।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com