Naya Diganta

রাতের আঁধারে লুট হয়ে যাচ্ছে ভৈরব নদের মাটি

ভৈরব নদ খননের মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায় : নয়া দিগন্ত

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র নদের নাম ভৈরব। অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে সরকার সম্প্রতি নদটির পুনঃখননের কাজ শুরু করে। এতে নদটি তার হারানো যৌবন কিছুটা হলেও ফিরে পায়। কিন্তু নদ খননের কাজ শেষ হতে না হতেই একটি প্রভাবশালী মহল নানা কৌশলে দুই পাড়ের মাটি রাতের আঁধারে কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে। নদের দুই পাড়ের মাটি এভাবে বিক্রি করে দেয়ার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে দুই ধারের জনবসতি ও ফসলি জমি। অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে উপজেলার ভৈরব নদ পুনঃখননের কাজ শুরু করে সরকার। এরপর থেকে দুই পাড়ে স্তূপ করে রাখা মাটি মতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা কেটে নিয়ে তা বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করতে শুরু করেন। মাটি কেটে বিক্রির প্রতিবাদে এলাকার সাধারণ মানুষ ও কৃষকরা মানববন্ধন-বিােভ করলেও আজও মাটি কাটা বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন উপজেলার প্রায় ৮-১০টি স্পটে মাটি বিক্রির ঘটনা ঘটে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভৈরব নদ এলাকার শিংনগর, মনোহরপুর, আন্দুলবাড়ীয়া, রায়পুর, কাশিপুর, মিনাজপুর সংলগ্ন নদীর খননকৃত মাটি রাতের আঁধারে ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে তা ট্রাক্টর দিয়ে বিভিন্ন ইটভাটায় পাচার করা হচ্ছে। দুই পাড়ের খননকৃত মাটি পাড় সংরণের জন্য রাখা হলেও তা কেটে নিয়ে যাওয়ায় নদীর আশপাশের কৃষিজমি ও বাড়িঘর নিয়ে শঙ্কায় পড়ে এলাকাবাসী। এ অবস্থায় নদ এলাকায় কৃষিজমি ও বসতি রায় এবং দুই পাড়ের মাটি লুট বন্ধের দাবিতে সম্প্রতি কেডিকে ইউনিয়ন, বাঁকা ইউনিয়ন ও উথলী ইউনিয়নের কৃষক ও সাধারণ মানুষ পৃথক পৃথকভাবে বিােভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই মাটি কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এলাকাবাসীর অভিযোগ থেকে জানা যায়, মেহেদী নামের এক যুবক কুষ্টিয়া থেকে উথলী এলাকায় আসেন এবং নিজেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের ভাগ্নে পরিচয়ে মাটি বিক্রি শুরু করেন। এছাড়া মাদারীপুরের সামসুল নামের এক ব্যক্তি এসে সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজান খানের লোক পরিচয় দিয়ে তিনিও একই কাজ শুরু করেন। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত মেহেদীকে জরিমানা করেন। মেহেদী বর্তমানে এলাকা ছাড়লেও সামসুল কথিত টেন্ডারের নামে মাটি বিক্রি করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এলাকাবাসীর প্রচণ্ড বিরোধিতার কারণে তিনি সব জায়গায় ব্যর্থ হচ্ছেন।
মাটিখেকো সিন্ডিকেটের অনেক সদস্য এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মাটি ভরাটের নামে নদের মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ২-৪ ট্রাক মাটি ফেলা হলেও বেশির ভাগ মাটিই ইটভাটায় বিক্রি করা হয়েছে।
উপজেলার বাঁকা গ্রামের আজিজুল, হাসেম সরকার, শিংনগর গ্রামের পীর মোহাম্মদ বলেন, নদী খননের উদ্বৃত্ত মাটি কেটে নেয়ার নামে নদীর পাড় ঘেঁষে মাটি নিয়ে যাচ্ছে মাটিদস্যুরা। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের ফসলি জমি ও বাড়িঘর ধসে নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। নদীর মাটি বিক্রির প্রতিবাদে আমরা এলাকায় মানববন্ধন ও বিােভ কর্মসূচি পালন করলেও সাড়া মেলেনি প্রশাসনের।
নদীর মাটিকাটা সিন্ডিকেটের সদস্যদের সাথে অতিসম্প্রতি যোগ হয়েছে কিছু নামধারী সাংবাদিক ও ছাত্রলীগ নেতা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামমাত্র দামে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে নদীর উদ্বৃত্ত মাটি কাটার অনুমতি নিয়ে নদীর বিরাট অংশের মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করছে।
একই চিত্র দেখা গেছে ধোপাখালী, মনোহরপুর, সীমান্ত ইউনিয়নের যাদবপুর ও হরিহরনগর এলাকায়। এসব এলাকার মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের কথিত কিছু নেতাকর্মী। সঙ্ঘবদ্ধ এ চক্রটি প্রশাসনের সব স্তরকে ম্যানেজ করে দাপটের সাথে নদীর মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
উপজেলার কেডিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল বাসার শিপলু বলেন, আমার ইউনিয়ন থেকে নদীর একমুঠো মাটিও রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে দেয়া হবে না। কোটি কোটি টাকার রাস্তা নষ্ট করে এবং কৃষিজমি ও জনবসতি হুমকির মুখে ফেলে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা হবে।
চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহম্মেদের মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করে সংযোগ না পাওয়ায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জীবননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম বলেন, নদীর মাটি বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মাদারীপুরের জনৈক সামসুল নামের এক ব্যক্তি উদ্বৃত্ত মাটি কাটার অনুমতি সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে করতোয়া নদীর মাটি কাটার অনুমতি পেয়েছেন রনি নামের এক ছেলে। অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং অভিযান চলমান আছে।