Naya Diganta

সময় ভ্রমণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

সময় ভ্রমণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

সময় মহাবিশ্বের গভীর প্রহেলিকার নাম। সময় কী? দেখা যায় না, ধরা যায় না, রূপ-রস-গন্ধের অনুভূতিও তৈরি করে না। স্রোতের মতো শুধুই সামনে বয়ে চলে। সেই বয়ে চলাটা আবার বুঝতে হয় পরোক্ষভাবে। আমাদের কাছে সময় মানে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের ব্যাপার। কিন্তু এই সময় মানুষের জন্য এক মহামূল্যবান নেয়ামত যার সঠিক ব্যবহারই কেবল তার সাফল্য এনে দিতে পারে।

আল্লাহ বলেন, ‘সময়ের কসম! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সূরা-আসর-১-৩)

সময়কে গুরুত্ব দিয়ে, সময়ের কসম করে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করছেন এই বলে যে, সময় সাক্ষী আছে যারা ঈমান আনেনি বা আনবে না তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।

বিজ্ঞানে দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতার মতো সময়ও একটি ভৌত রাশি। কিন্তু সময়ের সাথে অন্য সব ভৌত রাশির পার্থক্য আছে। দৈর্ঘ, প্রস্থ এবং উচ্চতা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায়। সময়কে শুধু মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার সাহায্যেই অনুভব করতে হয়। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করার কোনো উপায় নেই। অন্য সব ভৌত রাশির সাথে এখানেই সময়ের পার্থক্য। গতি ছাড়া সময়ের প্রবাহকে মাপার কোনো উপায় নেই, এমনকি বোঝারও উপায় নেই।

এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় গতি কী?
কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো বস্তুর যে সরণ হয়, সেটিই তার গতি। অর্থাৎ সময়ের ধারণা ছাড়া গতি পরিমাপের কোনো উপায় নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে-সময়ের ধারণা ছাড়া গতিকে বোঝার উপায় নেই, আবার অন্য দিকে গতির সাহায্যেই সময়কে বুঝতে হচ্ছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সময়ের সাপেক্ষে বিবেচনা করলে কোনো স্থির বস্তুই স্থির নয়। বরং তারও একটা নিজস্ব গতিবেগ আছে। কারণ একজন ব্যক্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সময় দাঁড়িয়ে থাকবে না। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ‘সময়’ সব সময় সামনে আগায়, কখনো পিছনে যায় না। এই গতিবেগকে আমরা বলি মোশন থ্রো টাইম।

স্টিফেন হকিংস বলেন, সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়, ঠিক যেমন সমতল ভূমিতে ধীরে আর পাহাড়ি ঢাল বেয়ে দ্রুত বয়ে চলে নদী। এটি এমন একটি চিন্তা যা আজ থেকে ১০০ বছর আগে খোদ আইনস্টাইন উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইনের মতে আলোর সমান বা তার চেয়ে অধিক বেগে যাত্রা করা অসম্ভব।

আমরা যা কিছু দেখছি সব অতীতের, বর্তমানের নয়
আমরা যা দেখি, তার কোনোটাই বর্তমানের না, সব অতীতের। কারণ, আমরা নিজের চোখে কিছুই দেখি না, আলো আমাদের দেখিয়ে দেয়। বস্তুর প্রতিফলিত আলোক রশ্মি যখন আমাদের চোখের রেটিনায় পড়ে, সেখান থেকে ব্রেইনের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আমরা বস্তুকে দেখি। প্রতিদিন সকালে উঠে যে রক্তিম সূর্য আমরা দেখি, তা মূলত ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগেকার। কারণ সূর্য থেকে আলো ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল পার হয়ে আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছুতে এ সময়টুকু লাগে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাতে পরিষ্কার আকাশে মানুষরা যে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি খালি চোখে দেখতে পায় তা মূলত ২৬ লাখ কোটি আলোকবর্ষ আগেকার।

সময়কে ধরে বলবিদ্যার হিসাব যে হতে পারে সে কথা আগে জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন পদার্থবিদ্যার সাথে সময়ের যোগসূত্র তৈরি করেন।

অ্যারিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২) তার ‘মেটারিওলজি’-এর ১২তম অধ্যায়ে যুক্তি দেখিয়েছেন- সময় কখনো থেমে থাকে না, আর এই মহাবিশ্বও চিরন্তন। অর্থাৎ তিনি ভাবতেন, সময়ের কোনো শুরু বা শেষ নেই। যখন কিছু ছিল না তখনো সময় ছিল; আর এই বিশ্বজগতের পরিণতি যাই হোক না কেন, সময়ের মতো সময় বয়েই চলবে। কিন্তু সময়ের ব্যাপারে বর্তমান ধারণা অ্যারিস্টটলের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একটি সময় সময়ের কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের মাধ্যমেই সময়ের সূচনা হয়েছে।

টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণ
১৮৯৫ সালে এইচজি ওয়েলস সময় ভ্রমণের ধারণাটি দি টাইম মেশিন নামক বইতে উল্লেখ করেন।
টাইম ট্রাভেল বলতে বুঝায় কোনো রকম শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াই বর্তমান থেকে অতীত বা বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে সময়ের অক্ষ বরাবর পরিভ্রমণ করা।

সময়ের অক্ষ বরাবর স্থান পরিবর্তনকে কাল মাত্রিক সরণ বলা হয়। এক সময় থেকে আরেক সময়ে পরিভ্রমণকেও আমরা সময় ভ্রমণ বলে থাকি। এটি হতে পারে অতীতে ভ্রমণ, হতে পারে ভবিষ্যতে ভ্রমণ।

বহুমাত্রিক মহাবিশ্ব
আসলে এই মহা বিশ্ব হলো চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্ব। তার মানে মহাবিশ্বের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি বস্তুর বর্ণনা দিতে চারটি মাত্রা পরিষ্কার থাকতে হয়। সেই চারটি মাত্রা হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময়। যেমন ধরুন, আপনার বাগানের ডালে একটি আম আছে। আপনি যদি এই আমটির অবস্থান নিয়ে একটি ভালো বর্ণনা দিতে চান তাহলে আমটি কোন জায়গায়, কখন, কতটুকু সাইজের তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হবে। আপনি যদি শুধু এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বর্ণনা করেন কিন্তু সময় মাত্রাটি না বলেন তাহলে এই আমটি নির্দিষ্ট হলো না। কারণ আমটি হয়তো গতকাল গাছে ছিল আজকে নেই। এ জন্যই বস্তুর বর্ণনা করতে গেলে চতুর্মাত্রিক মাত্রা উল্লেখ করতে হবে।

বিজ্ঞানী নিউটন মনে করতেন, সময় এবং স্থান হলো পরম। কিন্তু বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিউরি অব রিলেটিভিটি মোতাবেক স্থানের সাথে সময় হলো আপেক্ষিক বিষয়।

মানুষ যত বেশি গতিতে চলবে, সময় তত কম পার হবে। আপনি আলোর গতির কাছাকাছিতে মহাকাশ যানের ঘড়ির হিসেবে ১০ বছর ভ্রমণ করলেন। ১০ বছর পরে পৃথিবীতে ফেরত এসে দেখবেন যে পৃথিবীতে দশ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। মহাকাশে পৃথিবীর চেয়ে আপনার গতি বেশি হওয়ায় পৃথিবী আপনার চেয়ে বেশি সময় পার করে ফেলেছে। অর্থাৎ আপনি ভবিষ্যতে এসে পড়েছেন। তাহলে, এই আপেক্ষিক ভবিষ্যৎ ভ্রমণ বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানই ব্যাখ্যা করতে পারছে।

টাইম ট্রাভেলের শর্তসমূহ
টাইম ট্রাভেলের শর্ত মূলত দু’টি। প্রথমত, সময়ের চেয়ে দ্রুত বা আস্তে চলা। দ্বিতীয়ত, মধ্যাকর্ষণ বা মহাকর্ষণ শক্তির তীব্রতা বাড়িয়ে বা কমিয়ে।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্র অনুসারে কোনো বস্তু যখন আলোর গতিতে চলবে তখন তা হয়ে যাবে ভরশূন্য। আর যদি বস্তু আলোর গতিতে চলমান হয়ে যায়, সময় তখন হয়ে যাবে শূন্য। আরো দ্রুতগতিতে চললে সময় তখন পিছনে চলে যাবে যা বাস্তবিকভাবেই কখনো সম্ভব নয়।

পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, সময়ের আপেক্ষিকতার সাহায্যে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। আপেক্ষিকতাকে ব্যবহার করে সময়কে সম্প্রসারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সময়ের পরিবর্তন ঘটে। এই পরির্বতন ঘটার কারণ, সময় গতির ওপর নির্ভর করে। আর এর সত্যতা প্রমাণিত। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে নভোচারীরা ৬ মাস থাকার পর পৃথিবীর সময় থেকে তাদের ০.০০৫ সেকেন্ডের ব্যবধান দেখা যায়। এখানে তারা ৬ মাসে ০.০০৫ সেকেন্ডের টাইম ট্র্যাভেল করছে। ০.০০৫ সেকেন্ডে খুবই কম হলেও আমরা এর মাধ্যমে খুব সহজেই প্রমাণ পাই আলোর বেগকে কাজে লাগিয়ে টাইম ট্রাভেল সম্ভব। তাত্তি¡কভাবে ধরুন আপনি এমন একটা বাহনে ঊর্ধ্বাকাশে আলোর গতির কাছাকাছি গতিবেগ নিয়ে ১ ঘণ্টা ভ্রমণ করার পর আবার পৃথিবীতে ফিরে এলেন। আপনি আলোর গতির কাছাকাছি চলার কারণে আপনার সময় গেছে ১ ঘণ্টা, কিন্তু যে পৃথিবীতে আপনি ফিরে এলেন তাদের ইতোমধ্যেই ১০টি বছর পার হয়ে গেছে। আরো আশ্চর্যজনক বিষয় হলো আপনার শরীরে শারীরিক পরিবর্তন হবে না। কারণ পরিবর্তনটা হয় সময়ের সাথে সাথে।

সের্গেই কনস্ট্যান্টিনোভিচ ক্রিকালেভ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন কিংবদন্তি নভোচারী। মহাকাশে তিনি ৮০৩ দিন ৯ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট অবস্থান করেছিলেন। তিনি পৃথিবীকে পাঁচ হাজার বার প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, তিনিও এক ধরনের টাইম ট্র্যাভেল করেছেন। মহাকাশে গতিশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন ছিলেন। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার কাল দীর্ঘায়নের সূত্রমতে, তার ঘড়ি কিছুটা ধীর হয়ে যায়। হিসাব মতে, মহাকাশ ভ্রমণকালে তার কাল দীর্ঘায়ন হয়েছিল ০.০২ সেকেন্ড। অর্থাৎ পৃথিবীর তুলনায় তার বয়স ০.০২ সেকেন্ড কম বেড়েছে।

১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে যায়। এ ঘটনার প্রায় সাত মাস আগে তিনি পৃথিবী ও নিজ দেশ ছেড়ে মহাকাশের পথে পাড়ি জমান। ওই সময় তিনি মির মহাকাশ স্টেশনে বাস করছিলেন। সেখান থেকেই শুনতে পান দেশভাগের কথা। ফলে পূর্বপরিকল্পিত সময়ের চেয়েও মহাকাশে তাকে এক মাস বেশি অবস্থান করতে হয়। ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ পৃথিবীতে ফিরে আসার অনুমতি পান সের্গেই। ফিরে এসে গ্রহণ করেন রাশিয়ার নাগরিকত্ব।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তীব্রতা বাড়িয়ে বা কমিয়ে
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যত তীব্র হবে, সময়ের গতি তত কমবে। নিয়ম হলো যে বস্তু যত বড় ও ঘনত্বের তার মাধ্যাকর্ষণ বল তত বেশি। সে ক্ষেত্রে কোনো মানুষ যদি বৃহস্পতি গ্রহে এক বছর বসবাস করে পৃথিবীতে ফিরত আসে তাহলে সে দেখতে পাবে পৃথিবীর মানুষগুলো ইতোমধ্যে ১০ বছর অতিক্রান্ত করে ফেলেছে। এর কারণ হলো বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। আবার কেউ যদি চাঁদে ১০ বছর বসবাস করার পর আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে, তাহলে সে দেখতে পাবে হয়তো পৃথিবীর মাত্র আট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

টাইম ট্রাভেল শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব, বাস্তবিক অর্থে আলোর গতিতে না পৌঁছাতে পারলে সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে এমন একটি টাইম মেশিন নির্মাণ করা প্রয়োজন যেখানে আলোর গতির কাছাকাছি গতি অর্জন করা সম্ভব।

আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে কি মানুষের চলা সম্ভব?
উত্তর হলো না। কেউ যদি মহাশূন্যে আলোর সমান গতিতে চলতে থাকে তবে মহাশূন্যে তার বয়সও বাড়বে না, সময়ও পার হবে না, সময় থমকে দাঁড়াবে, ওই ব্যক্তির কোনো ওজনও থাকবে না। তবে এই অবস্থা বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয়। কারণ এই গতি তৈরি করতে যে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে তা মানুষের পক্ষে বাস্তবে সম্ভব নয়। মানুষ এখন পর্যন্ত মাত্র ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪০,০০০ কিলোমিটার গতি অর্জন করতে পেরেছে। মনুষ্য নির্মিত সর্বোচ্চ গতিবেগ সম্পন্ন মহাকাশযান হলো পার্কার সোলার প্রোব যার গতি সেকেন্ডে ১১ হাজার কিলোমিটার। এটি আলোর গতির মাত্র ০.০৩%। যেসব বস্তুর কোনো ভর নেই কেবল সেসব সর্বোচ্চ আলোর গতি অর্জন করতে পারবে। এই মহাবিশ্বে আলোর গতির চেয়ে কারো দ্রæত চলা সম্ভব নয়। কারণ আলোর গতি হলো কসমিক স্পিড লিমিট। মানুষ তো দূরের কথা, কোনো ভরযুক্ত বস্তুর পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ বিগ ব্যাং সংঘটিত হবার পর থেকে এই মহাবিশ্ব আলোর গতির চাইতেও দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।

আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে চলা সম্ভব নয় অন্য আরো একটি কারণে। আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলতে গেলে কজালিটি প্রিন্সিপাল ব্রেক করতে হয়। কজালিটি প্রিন্সিপাল বা কার্যকারণ নীতিটা হলো, যেকোনো ঘটনা ঘটার জন্য প্রথমে একটি ‘কারণ’ থাকে, তারপরেই তার ‘ইফেক্ট’ থাকে। মহাবিশ্বের যেকোনো ঘটনা আমরা আলোর মাধ্যমেই দেখতে পাই। অর্থাৎ আলোর মাধ্যমেই মহাবিশ্বের সব ইনফরমেশন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে। যদি এক আলোক বর্ষ পূর্বে মহাবিশ্বের কোথাও সুপার্নোভা বিস্ফোরণ ঘটে থাকে তাহলে তা এক বছর পর আমরা এখন তা দেখতে পারব, তার আগে নয়। এখন ইনফরমেশন যদি আলোর চেয়েও বেশি ট্রাভল করে, তাহলে কজালিটি প্রিন্সিপাল (কার্যকারণ নীতি) লঙ্ঘন করে। কারণ কজালিটি প্রিন্সিপাল হলো আগে কারণ তারপর ইফেক্ট। যেমন একটা ডিম ওপর থেকে পড়ে ভেঙে গেল। এখানে উপর থেকে পড়ে যাওয়াটা হলো কারণ আর ভেঙে যাওয়াটা হলো ইফেক্ট। আমরা কারণের আগে ইফেক্ট দেখতে পারব না।

কোনো বস্তুর বেগ যখন বেড়ে যায় তার ভরও বেড়ে যায়। আবার বেগ বাড়াতে শক্তির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যে বস্তুর ভর যত বেশি তাকে গতিশীল করতে তত বেশি শক্তির প্রয়োজন। যেমন, একটা ফুটবলকে ১০ মিটার/সেকেন্ড গতিশীল করতে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে নিশ্চয়ই একটা গাড়িকে সে পরিমাণ গতিশীল করতে অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন। বস্তুর ভরের ক্ষেত্রে দু’টি কথা না বললেই নয়। আর তা হলো একটি নির্দিষ্ট বস্তুর ভর সব সময়ই এক থাকে শুধু একটা জায়গায় স্থির থাকাবস্থায়। কিন্তু এই বস্তুটিই যদি গতিশীল করা হয় তবে বেগ বাড়ার সাথে সাথে বস্তুর ওজন বেড়ে যাবে, বস্তুর ওজন যত বেড়ে যাবে তাকে গতিশীল করতে তত শক্তির প্রয়োজন হবে। এভাবে কোনো বস্তু আলোর গতির মতো গতিশীল করতে অসীম শক্তির প্রয়োজন। অন্য সব বস্তুর কথা বাদ দিলাম, অনেক হালকা কনিকা যেমন ইলেক্ট্রন তাকে আলোর সমান গতিশীল করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, সম্পূর্ণ মহাবিশ্বেও সে পরিমাণ শক্তি নেই।

আলোতে থাকা ফোটন কণার কোনো ভর নেই। ভর নেই বলে হিগস ফিল্ডের সাথে ফোটন কণার কোনো ধরনের সংঘর্ষ হয় না। ফলে ফোটন কণা আলোর গতিতেই চলে। এজন্য ফোটন কণা হলো মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন পার্টিকেল।

স্যার আইজাক নিউটন মনে করতেন মহাবিশ্বের সব স্থানে সময়ের গতি সমান। অর্থাৎ পৃথিবীতে ১ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়া মানে মহাবিশ্বের সব স্থানেই ১ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়া। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইনের থিউরি অব রিলেটিভির কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি যে, পৃথিবীতে ১ ঘণ্টা হওয়া মানে মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে বা নক্ষত্রে এক বছরও হতে পারে। নিউটনের মতে যা কিছু ঘটে গেছে তা সবার জন্যই অতীত, বাস্তবে আইনস্টাইনের মতে যা ঘটে গেছে তা সবার জন্য অতীত নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সাথে ঘটতে পারে। তাই টাইম ট্রাভেল এখন আর সাইন্স ফিকশন নয়।

তাত্তি¡কভাবে, বর্তমান সময় থেকে আমরা ভবিষ্যতেও যেতে পারি আবার অতীতেও যেতে পারি। আমরা সবাই কিন্তু সবসময় স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতের পথেই যাত্রা করছি। যেমন আমরা কেউ যখন দ্রুতগামী ট্রেন বা এরোপ্লেনে চড়ি, তখন আমরা কিন্তু নিজেদের অজান্তেই ভবিষ্যতের পথেই যাত্রা শুরু করেছি। কোনো বস্তু যখন গতিশীল থাকে ওই বস্তুর সময় ধীর হয়ে যায়। যেমন পৃথিবীর ৪০০ কিলোমিটার উপরে থাকা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে চলে। সুতরাং মাটিতে থাকা একজন মানুষের সাথে ইন্টারন্যাশনাল স্পেসে থাকা নভোচারীর সময়ের পার্থক্য তৈরি হয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস্ অ্যান্ড ইউরোলজি,
শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।