Naya Diganta

কী পড়ছি, কী লিখছি

সাহিত্যিক যদি উচ্চাকাক্সক্ষী হন তাহলে পড়া ও লেখা তার কাছে প্রতিদিনের বিষয়। লেখা তো আর সব সময় হয়ে ওঠে না। সে জন্য মুড দরকার; গদ্য লেখার ক্ষেত্রে ভালো প্রস্তুতিও। সুতরাং লেখা যদি নাও হয়, পড়া প্রতিদিনই কম বেশি হচ্ছে। আমি এমন একটা দিনের কথা মনে করতে পারি না যে দিন কিছুই পড়িনি। ট্রেনে পড়ি, বাসে পড়ি, এমনকি সেলুনে বা হাসপাতালে গেলেও পড়ি। একবার নৌকায় করে বরযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই স্ফূর্তি করছিল। আর আমি এক কোণে গুটিসুটি হয়ে বসে একটা সাহিত্য ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। তা দেখে অন্যরা খুব অবাক হয়েছিল।
একদম ভালো ছাত্রের মতো অনেক সকালেই পড়া-লেখার টেবিলে বসে যাই। নাশতা খাওয়ার আগে দু-আড়াই ঘণ্টা কিছু পড়ি বা লিখি। এটা আমার দৈনন্দিন রুটিনের অংশে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া দুপুরে এবং সন্ধ্যা বেলায়ও আমি লিখি। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির শেলফগুলোর দিকে যখন তাকাই, ভাবি, কত বই এখনো শেষ করা হয়নি! কত বই আমার দিকে চেয়ে কাতর দৃষ্টিতে বলছে, অনেক মাস তো হলো; নাও, এবার আমাকে পড়তে শুরু করো! আর যেসব পুস্তকের অর্ধেকটা বা এক-তৃতীয়াংশ পড়ে রেখে দিয়েছি সেগুলো এ জীবনে শেষ করা হবে কি না কে জানে! অথচ দেখুন, এ অবস্থার মধ্যেই আবার নতুন বই কিনে আনি। সম্প্রতি কিনেছি ‘পাউল সেলানের কবিতা’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘শেকসপিয়রের মেয়েরা’, টনি মরিসনের উপন্যাস The Bluest Eye, সদরুদ্দিন আহমেদের ‘প্রসঙ্গ’ : দেশী ও বিদেশী সাহিত্য’, ডেভিড পারফিন্সের A History of Modern Poetry, কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের ‘গদ্য সমগ্র’, জুয়েল মাজহারের কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রি ও বাঘিনী’, জাফর আলম অনূদিত সাদত হাসান মান্টোর ‘টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প’ এবং শিহাব সরকারের প্রবন্ধ ‘গদ্যের হাট’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের সেরা কবিদের একজন পাউল সেলান। বিচ্ছেদ, নিঃসঙ্গতা, বিভীষিকা, মৃত্যুচেতনার মতো বিষয়গুলো অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন তিনি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য বিশ্বাস ও সক্ষমতা সম্বন্ধে সবাই জানেন। ‘শেকসপিয়রের মেয়েরা’ বইতে তিনি বিশ্ববরেণ্য ওই নাট্যকারের বেশ কিছু বিখ্যাত নারী চরিত্রের কর্মকাণ্ডের যুক্তিগ্রাহী বিশ্লেষণ করেছেন। নোবেল লরিয়েট টনি মরিসন আফ্রো-আমেরিকান লেখক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের সামাজিক অবস্থান ও মানসিক টানাপড়েনের বিষয়টি উপজীব্য হয়েছে উপন্যাসটিতে। ইংরেজি কবিতায় আধুনিকতা ও পরবর্তী ভাবধারা কীভাবে বিকাশ লাভ করেছে তারই চমৎকার দলিল ডেভিড পারকিন্সের বইটি। সদরুদ্দিন আহমেদ লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন পরিণত বয়সে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অধ্যাপক অনেক সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য তার প্রাগুক্ত বইটির জন্য। কৃষ্ণগোপাল মল্লিক পশ্চিমবঙ্গের লেখক। ষাটের প্রজন্মের এই প্রয়াত কথাসাহিত্যিক যথেষ্ট রসবোধের অধিকারী আর ব্যঙ্গবিদ্রুপেও ওস্তাদ। সেই পরিচয় ধৃত আছে ‘গদ্য সমগ্র’-এর দুটি খণ্ডে। জুয়েল মাজহার আশির প্রজন্মের অগ্রগণ্য কবি ও অনুবাদক। অনেক বছর ধরে তিনি তার ব্যতিক্রমী কাব্যসামর্থ্যরে পরিচয় দিয়ে আসছেন। ‘রাত্রি ও বাঘিনী’ কাব্যগ্রন্থে সেই পরিচয় গাঢ়তর হয়েছে। শিহাব সরকার কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু তিনি যে তলে তলে গদ্যেও হাত পাকিয়েছেন তা বোঝা গেল প্রবন্ধগ্রন্থ ‘গদ্যের হাট’ দুই উল্লেখ্য দিক। সাদত হাসান মান্টো কেবল এই উপমহাদেশের নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের একজন। তাকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই।
এই বইগুলো পড়ছি মাস চারেক ধরে। পড়া হচ্ছে লেখার শত্রু, আর লেখা হচ্ছে পড়ার। তা সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লিখতেও হয়, কখনো মনের তাগিদে, কখনো সাহিত্য সম্পাদকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। কিছু দিন আগে লিখেছি ‘একটা ছোট সুন্দর ঘোড়া’ নামের ছোট গল্প। ‘শোয়েব শাদাব, এক কবিজীবন’ শিরোনামে একটি গদ্যও লিখেছি সাহিত্য মাসিক ‘অধ্যায়’-এর জন্য। আর এখন লিখছি উপন্যাস- একটি পরিবারের চার প্রজন্মের গল্প নিয়ে।