Naya Diganta

পেলোসির তাইওয়ান সফর কি বাইডেনের জন্য গুরুতর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

তাইওয়ান সফরের ঝুঁকি সম্পর্কে ন্যান্সি পেলোসিকে সতর্ক করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর জো বাইডেনের গুরুতর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এখন তাকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে সম্পর্ক সামাল দিতে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ার করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন অনেক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মূলত দাঁড়িয়ে আছে তাইওয়ানের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের এক ইচ্ছেকৃত অস্পষ্ট অবস্থানের ওপর। বেইজিং দাবি করে তাইওয়ান তাদের দেশের অংশ। তাইওয়ান বলে তারা স্বাধীন। আর যুক্তরাষ্ট্র বলে, তাইওয়ান কোনো স্বাধীন দেশ নয়, কিন্তু আবার একইসাথে তারা তাইওয়ানকে মিত্র বলে গণ্য করে।

তাইওয়ান নিয়ে এই যে একটা ধোঁয়াটে অবস্থান, সেটা সবাই মেনে চলে এবং কেউ নিজের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা ক্রমণাত্মক অবস্থান নেয় না। কারণ সেখানে ভঙ্গুর একটি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এটাকেই মন্দের ভালো বলে মনে করে সবাই।

কিন্তু তাইওয়ান নিয়ে এই যে একটা পরস্পর-বিরোধী অস্পষ্ট অবস্থান, সেটার ওপর হঠাৎ যেন খুব কড়া আলো ফেলেছে মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ওই দ্বীপে এক সফর। চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সেটি তৈরি করেছে বড় ধরণের টানাপোড়েন।

গত ২৫ বছরের মধ্যে ন্যান্সি পেলোসি হচ্ছেন তাইওয়ান সফরে যাওয়া সবচেয়ে উচ্চপদস্থ মার্কিন রাজনীতিক। চীন-মার্কিন সম্পর্ক এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন সেটিকে ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন ন্যান্সি পেলোসির এই সফর যেন তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক টেনে আরো নিচে নামালো।

যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ সামাল দিতে ব্যতিব্যস্ত। এরকম একটা সংকটের মধ্যে ন্যান্সি পেলোসির এই সফর যেন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো একটি সংঘাতে জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

তাইওয়ান ইস্যুতে যেন মনে হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ পরস্পর-বিরোধী অবস্থানে আছে। মনে হচ্ছিল তাইওয়ান যেন ওয়াশিংটনের ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি ক্ষেত্র।

ন্যান্সি পেলোসি একজন ডেমোক্র্যাট এবং বহুদিন ধরেই তার চীন বিরোধী কট্টর অবস্থান সবারই জানা। তিনি যখন তাইওয়ান সফরে গেলেন, রিপাবলিকান পার্টির আইন-প্রণেতাদের একটা বড় দল তাকে রীতিমত সোৎসাহে সমর্থন দিল। তাইওয়ান এখন চীনের দিক থেকে যেভাবে আরো বেশি করে হুমকির মুখে আছে, তখন এই রিপাবলিকানরা স্বশাসিত দ্বীপটির সাথে সংহতি জানাতে সেখানে কংগ্রেস সদস্যদের সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।

তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য ন্যান্সি পেলোসিকে থামানোর চেষ্টা করেননি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন।

কিন্তু তিনি গোপনে ন্যান্সি পেলোসির কাছে তার উপদেষ্টাদের পাঠিয়েছিলেন এই সফরের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করে দিতে, বিশেষ করে চীনের জন্য রাজনৈতিকভাবে খুবই স্পর্শকাতর এক সময়ে। নভেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে এক গুরুত্বপূর্ণ পার্টি কংগ্রেসের মুখোমুখি হতে হবে। প্রেসিডেন্ট শি যখন আভ্যন্তরীণভাবে চাপের মুখে আছেন, তখন বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে মোটেই দুর্বল বলে দেখাতে চাইবেন না - এভাবেই ন্যান্সি পেলোসিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেষ্টারা।

কিন্তু এসব পরামর্শ অগ্রাহ্য করে এরপরেও যখন ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান যেতে চাইলেন, তখন বাইডেন প্রশাসনকে বাধ্য হয়ে তার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হলো। তবে একইসাথে তারা এই সফরের গুরুত্বকে খাটো করে দেখাতে চাইছিল। তারা বলার চেষ্টা করছিল, যুক্তরাষ্ট্র ‌‌যে ‘ওয়ান চায়না‌’ পলিসি‌, অর্থাৎ চীন একটাই বলে যে নীতি অনুসরণ করে, সেটিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

তবে বাইডেন প্রশাসন স্বীকার করছিল, ন্যান্সি পেলোসি এরকম সফরে গেলে চীন খুব বাজে প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং এর বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে না হলেও, অন্তত কয়েক সপ্তাহ ধরে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।

চীন এখন তাইওয়ানকে রীতিমত ঘিরে ফেলে সেখানে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে, গোলা ছুঁড়ছে, মিসাইল নিক্ষেপ করছে। তবে ওয়াশিংটন এখনো বিশ্বাস করে প্রেসিডেন্ট শি এমনভাবেই সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যাতে করে একটা যুদ্ধ লেগে না যায়। কারণ কোনো পক্ষই আসলে যুদ্ধ চায় না।

কিন্তু তারপরও বলতে হয় চীন-মার্কিন তিক্ত সম্পর্ক এখন এক নাটকীয় মোড় নিয়েছে।

‘এরকম একটা ঘটনা যাতে একটা পূর্ণাঙ্গ সংকটে রূপ না নেয়, সেজন্য যে ধরনের রাজনৈতিক পরিসর থাকা দরকার, যেরকম সম্পর্ক থাকা দরকার, যে ধরনের ব্যবস্থা থাকা দরকার, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কিন্তু তা এখন নেই,’ বলছেন সাবেক কূটনীতিক ড্যানি রাসেল। তিনি এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, ‘পেলোসির এই সফরের পর চীনে কট্টরপন্থী লাইনের চিন্তা-ভাবনা আরো দৃঢ় হবে, এর পাশাপাশি ধৈর্য এবং সতর্কতার কথা যারা বলেন, তাদের অবস্থান সংকুচিত হবে।’

বিশ্বে এখন আরো যেসব সংকট মোকাবেলায় বড় দুই পরাশক্তির মনোযোগ দেয়া দরকার, সেই চেষ্টায় আগে থেকেই ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল, এখন সেটা যেন আরো বেশি ভেস্তে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় সবচেয়ে উপরের দিকে আছে রাশিয়ার প্রতি চীনের যে কূটনৈতিক সমর্থন, সেটা কীভাবে থামানো যায়। এরপর চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ তো আছেই। এরপর জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র নিয়েও চীনের সহযোগিতা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন এক সময় দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন চীনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আরো কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছিলেন, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আরো বেশি করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার নীতি নিয়েছেন। এর পাল্টা যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করছে, তা হলো বেইজিংকে এক কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে গণ্য করা। চীনকে এখন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে দেখা হয়।

চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিকে ভালোভাবে নেয়নি। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসনও চীনের সাথে সম্ভাব্য সহযোগিতার পরিকল্পনা নিয়ে খুব বেশিদূর আগায়নি।

হোয়াইট হাউস এখন বলছে, দুই দেশের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতভেদ আছে, সেগুলো মেটাতে তারা কিছু ‘সুরক্ষা বেষ্টনি’ তৈরি করাকেই লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে সরাসরি কথাবার্তার মাধ্যমেই এগুলো করা হবে।

কিন্তু তাইওয়ানের ইস্যুটি এখন ‌একটা ‘বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন‌‍’ সামনে নিয়ে এসেছে, বলছেন জার্মান মার্শাল ফান্ডের একজন বিশেষজ্ঞ বনি গ্লেসার। ‍‘আমার মনে হয় না প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন আর জো বাইডেনের কথায় আস্থা রাখতে পারবেন‍।’

এই আলোকে দেখতে গেলে, ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর পুরো সমস্যার একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে আরও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেগুলোকে তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা বলে সন্দেহ করে চীন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তো এমন কথাও বলেছিলেন যে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় মার্কিন নীতি অনুযায়ী যতটা করা দরকার, তার অঙ্গীকার হবে তার চেয়েও বেশি।

বনি গ্লেসার বলছেন, তাইওয়ানের ব্যাপারে এখন যে একটা ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ আছে, তার পরিবর্তে এখন আসলে সবার উচিত যার যার ‌‘রেড লাইন’ বা চরম সীমা কোথায়, সেটা পরিষ্কার করে বলে দেয়া। আর এরজন্য দরকার একটা অকপট আলোচনা।

নভেম্বরে জি-টুয়েন্টি জোটের শীর্ষ সম্মেলনে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটা মুখোমুখি বৈঠকের আয়োজন করার যে চেষ্টা এখন চলছে, তাতে যদি ফল পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো সেটা সম্ভব হতে পারে। এতে করে চীন-মার্কিন সম্পর্ক হয়তো বড়জোর কিছুটা স্থিতিশীল হবে, তবে সংকট মোকাবেলার বাইরে বাড়তি কিছু এই বৈঠকে ঘটবে, তেমন সম্ভাবনা খুব কম।

সূত্র : বিবিসি