Naya Diganta

তিউনিসিয়ায় কাইস সাঈদের নতুন প্রজাতন্ত্র

তিউনিসিয়ায় কাইস সাঈদের নতুন প্রজাতন্ত্র

তিউনিসিয়ায় সংবিধানের ওপর গণভোটের প্রহসন হলো। মাত্র ২৫ ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণে এই গণভোট তাকে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা দিয়েছে। যে তথাকথিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট হাই অথরিটি ফর ইলেকশন ঘোষণা করেছে যে প্রদত্ত ভোটের ৯৪.৬ ভাগ শতাংশ সাঈদে প্রণীত নতুন সংবিধানের পক্ষে রায় দিয়েছে, তার সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা রয়েছে সামান্যই। প্রেসিডেন্ট নিজে তিউনিসিয়ার ওপর যে অভ্যুত্থান চাপিয়ে দেয়ার পর বৈধ কমিটি ভেঙে দেয়ার পর এই কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিল। যে ফলাফল ঘোষিত হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গণভোট বিবেচিত হওয়ার মতো শর্ত পূরণ করেনি।

সাঈদ কমিশনের সংবিধানের ১৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিবার্চন কমিশন ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার পর-ই সংবিধান কার্যকর হবে। ভোটের আগে থেকেই এটা বোঝা যাচ্ছিল যে ভোটের ফলাফল সাঈদ বাহিনীর পক্ষে যাবে এবং সাঈদ সরাসরি তিউনেসিয়ার জনগণের উপর স্বৈরাচারী ক্ষমতার আরোপ করবেন।

প্রকৃতপক্ষে খুব কম সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও প্রায় ১১ বছর পর জাইন এল আবিদির সরকার পতনের পর তিউনেসিয়াতে আবারো স্বৈরশাসন ফিরে আসছে। মজার ব্যাপার হলো, সাঈদ নিজে আইনের শিক্ষক, আর এই কারণেই নিজের মতো করে সংবিধান তৈরি, এর ধারা ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছেন। দৃশ্যত, ভোটের পর এখন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন গত ১০ বছরে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের সংস্কৃতি ও সদ্য জন্ম নেয়া গণতন্ত্রের চর্চা এখানেই শেষ হলো।

শেষ হওয়া ভোটে বিজয়ের ফলে সংবিধান অনুসারে সাঈদ এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। অবশ্য, তার সরকার নিয়ে চারদিক এখন সরব, তৈরি হচ্ছে বিভাজন, নানা মত। সামনে কী হবে তা ভেবেই অনেক মানুষ চিন্তিত। সাঈদ কায়েসের প্রকল্পে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বিষয়গুলো সমাজ ও জাতি গঠন করতে পারে না; তার প্রকল্পটি তার দাবি অনুযায়ী 'নতুন প্রজাতন্ত্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

সংশয়ের মুল কারন তিনি যাদের কে অপছন্দ করেন খুব দ্রুত তাদের কে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজের পথ থেকে একই ভাবে সরিয়ে দিচ্ছেন।সাঈদ যা করছেন তা হলো প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি জাতিকে বিভক্ত করে দিচ্ছেন এবং তার প্রথম দায়িত্ব ছিল সবাই কে একত্র করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পথ নির্ধারণ করা। আরো বলতে গেলে সাঈদ তার স্বৈরাচারী প্রকল্পের মাধ্যমে তিউনেসিয়াকে বহির্বিশ্ব থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটা স্পষ্ট যে দুই পক্ষের দ্বন্দে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পূর্বের আইন বা সংবিধানের দিকে চোখ দিলে দেখা যাবে যে ২০১৪ সালে সাঈদ যে আইনের আওতায় শপথ গ্রহণ করেছিলেন সে অনুযায়ী তার এই অভ্যুত্থান অসম্ভব ছিল এবং এভাবে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারতেন না। পথ কঠিন জেনে তিনি আইন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন, এখানেই থামেননি তিনি আইন ও সংবিধানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে সামনে এগিয়েছেন এবং প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে বৈধতার পথও সুগম করেছেন।

সাঈদ এই অব্দি পৌঁছাতে ভালো-খারাপ সব পক্ষকে ধোঁকা দিয়েছেন। তবে এসবের পরও ঠিক এক বছর আগেই অনুমান করা যাচ্ছিল যে তিনি যে আইন বা নিয়ম তৈরি করতে যাচ্ছেন তা বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাড়াবে।তিনি আইনসভা বন্ধ করে দেন, আইনের প্রয়োগ বন্ধ করেন এবং একই সাথে জরুরি অবস্থা জারি করেন।

এরপর তিনি গণবিরোধী সব আইন আরোপ করেন, তারপর যে সংস্থাগুলো এগুলোর বিষয়ে কথা বলে এবং পর্যবেক্ষণ করে সেই সকল সংস্থাগুলোকেও বিলীন করে দেন।
এসবের পর তিনি নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা দখলের পর গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর নিজেকে দেশের সকল ক্ষমতার অধিকারী ঘোষণা করেন এবং নিজ দেশের শাসন ক্ষমতা নিজের কাঁধে তুলে নেন এর মাধ্যমে তিউনিসিয়াতে নিজের অবস্থান আরো শক্ত করে নেন।

কায়েস সাঈদ তার এই বিপ্লবের মাধ্যমেই জেসমিন বিপ্লবকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। সাঈদের এই বিপ্লবের মাধ্যমে তিউনেসিয়া এখন আরব বসন্তের দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী ও অভিজাতদের হাতে শোষিত হয় এমন দেশের তালিকায় নাম লেখালো। যাইহোক, সাঈদ যতটা সহজ মনে করছেন গণভোট পরবর্তী সময় মোটেও ততটা সহজ হবে না। গনভোটের নাম মাত্র মানুষের অংশগ্রহণ, বিরোধীদলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধ্বস,পাবলিক সার্ভিসের বেহাল দশা, জীবনযাত্রার নিম্নমান, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি ও বিপক্ষ দলগুলোর বিলীন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক চাপ সব মিলিয়ে বেকায়দায় পড়তে পারে সাঈদ সরকার।

কায়েস সাঈদ কোনো দিক থেকেই তিউনেশিয়ার মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেননি। মানুষকে সুখ-শান্তিতে রাখার পরিবর্তে যারা তিউনিশিয়াতে গণতন্ত্রের পতন না বলে, বলেছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের পতন, যারা সারা বিশ্বে ভুল তথ্য উপাত্ত দিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিল, যারা গণমানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল সেইসব মানুষ ও গণমাধ্যমকে সাঈদ অঢেল অর্থ সম্পদ দিয়ে খুশি করেছেন।

২০১০ সালে তিউনিসিয়া থেকেই আরব বিশ্বে স্বাধীনতার সূর্য উজ্জ্বল হয়েছিল, কিন্তু এটি আবারো আরব-আমেরিকান-জায়নবাদী চক্রান্তের মেঘে ঢাকা পড়েছে যা মানুষকে মর্যাদা ও স্বাধীনতার সাথে বাঁচতে দিচ্ছে না। তবে আলো আসবেই, সময়ের ব্যবধান মাত্র। মেঘ সরিয়ে সূর্য আবারো ছড়িয়ে দেবে আলো।
সূত্র : মিডলইস্ট মনিটর