Naya Diganta

শুধু নারীর উপরেই কেন জন্মনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার হয়

বাংলাদেশে যেসব পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয় তার মধ্যে দু’টি বাদে বাকি সবগুলো নারীদের জন্য।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহার করেন মূলত নারীরা। বাংলাদেশে সরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনার যেসব পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয় তার মধ্যে দু’টি বাদে বাকি সবগুলো নারীদের জন্য।

যার প্রায় সবগুলোরই কোনো না কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যা নারীকেই সহ্য করতে হয়।

বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিগুলোও জন্ম নিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতিতে বিনিয়োগ ও গবেষণা চালায়, তাও মূলত নারীদের জন্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের বোঝা শুধু নারীর উপরেই রয়ে গেছে।

ঢাকার বাসিন্দা সিরাজুম মুনিরা বছর কয়েক হলো বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর একটি বাচ্চাও হয়েছে। এরপর চাকুরীজীবী স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপাতত একটু বিরতি দেবেন।

সিরাজুম মুনিরা বলছেন, চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে তিন মাস পরপর নিতে হয় এমন একটি ইনজেকশনের পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু সেটি যখন নেয়া শুরু করেন তারপর থেকে নানা রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হচ্ছে তাকে।

তিনি বলছেন, ‘যেমন এখন আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি। পেটটা ফুলে গেছে। পেটে ব্যথা করে অনেক। আর ইনজেকশনটা নেবার কারণে যখন ওটার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তখন টানা পনের থেকে বিশ দিন মাসিক চলতে থাকে। বন্ধ হতে চায় না। আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার আপা আমাকে বলেছে ইনজেকশন নেবার কারণে এরকম হচ্ছে। পেটে চর্বি জমে গেছে তাই পেট মোটা লাগে। আগে পিল খাইতাম। খাইলে বমি হবেই। পিল এখন দেখলেও বমি আসি।’

সিরাজুম মুনিরা বলছিলেন তার স্বামী কোনো পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী নন। কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, ও কনডম ব্যাবহার করতে চায় না। ও বলে যে ওর কনডম ব্যাবহার করতে ভালো লাগে না। তাই আমিই এই পদ্ধতি ব্যাবহার করতেছি।

ঢাকার রাস্তায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে পুরুষদের সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলে দু-একজন বিরক্ত বোধ করলেন।

ঢাকায় একটি আবাসিক ভবনের নিরাপত্তারক্ষী আতোয়ার হোসেন। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমেই শব্দ করে হেসে উঠলেন।

তিনি বলেন, পদ্ধতি ব্যবহার এগুলো নারীদের দায়িত্ব। তাকেই সবকিছু মেইনটেইন করতে হবে। নারীর দায়িত্ব কারণ তার কাছেই তো সব কিছু। সেইতো গর্ভবতী হয়।

পুরুষদের জন্য কি পদ্ধতি আছে সে সম্পর্কে আপনি কি জানেন, সে সম্পর্কে মোহাম্মদ জহির নামে একজন বলেন, ‘পুরুষদের জন্য কনডম আছে.......এরপর......আমি এছাড়া আমি কিছু জানি না।’

আপনি কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক মুদি দোকানি বললেন, ‘না......আমার ম্যাডামে (স্ত্রী) কি যেন বড়ি ব্যবহার করে। আমি বলতে পারলাম না।’

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি জানেন না, কারণ পুরুষদের জন্য সে বিষয়ে প্রচারণা যেমন নেই তেমনি নারীর জন্যেই ব্যবহারের পদ্ধতি ও সামগ্রী বেশি পাওয়া যায়। কারণ, সামাজিকভাবে মনে করা হয় এটা নারীর দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতেও রয়েছে তার প্রতিফলন।

সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে যেসব পদ্ধতির ব্যাপারে দম্পতিদের উৎসাহিত করা হয় তার দু’টি ছাড়া সবই নারীদের জন্য। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ওয়েবসাইট ঘাটলেই তা পরিষ্কার।

যেসব পদ্ধতির কথা সেখানে উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জন্ম বিরতিকরন খাবার বড়ি, কপার টি, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, লাইগেশন, চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া হয় এমন জন্মনিয়ন্ত্রণ ইমপ্ল্যান্ট। এগুলো সবই নারীর জন্য।

আর পুরুষদের জন্য উল্লেখ রয়েছে কনডম ও ভ্যাসেকটমির কথা।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ ইমপ্ল্যান্ট। এরপর রয়েছে কপার টি ও ইনজেকশন। প্রতিটি পদ্ধতির জন্য যে লিফলেট ওয়েবসাইটে রয়েছে সেখানেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলোও লেখা রয়েছে।

যেমন কপারটি ব্যবহার করলে তলপেটে ব্যথা হতে পারে, নিয়মিত ফোটা ফোটা রক্তস্রাব হতে পারে।

অনেক সময় প্রদাহ হতে পারে। চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুলে মাসিক অনিয়মিত অথবা রক্তস্রাব বেশি হতে পারে। মাথা ব্যথা হতে পারে। ওজন বেড়ে যেতে পারে।

ইনজেকশনেও একই ধরনের সমস্যা হয় ব্যবহারকারী নারীদের। খাবার বড়ি হরমোনে প্রভাব ফেলে। মাসিকের পরিমাণ কমে যায়। যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়।

প্রতিদিন নিয়ম করে বড়ি খাওয়ার মানসিক যন্ত্রণাও যে রয়েছে সে কথা বলা নেই কোথাও।

ছয় মাস আগে বিয়ে হওয়া, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, এই যে রেগুলারিটি মেইনটেইন করতে হয়। ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হবে। কখনো দেখা গেল ভুলে গেলাম। একটু এদিক-ওদিক হলে আবার পিরিয়ডের জন্য ওয়েট করতে হবে। এইটা আমার জন্য একটা মেন্টাল প্রেশার হয়ে গেছে। প্রথম যখন ডাক্তার পিলের কথা বলল তখন মনে হয়েছিল এটা জাস্ট একটা ওষুধ নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখন ঝামেলা মনে হচ্ছে আমার কাছে। এই রেগুলারিটি রাখাটা একটা পেইন।

বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করি-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ৯৮ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন নারীরা।

দেশের ২৬টি উপজেলায় করোনাকালীন সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে চালানো গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন।

তিনি বলেন, পুরুষের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের দায়িত্ব সম্পর্কে তারা নানা ধরনের প্রচলিত অদ্ভুত ধারনা দেখতে পেয়েছেন। তিনি উল্লেখ করছিলেন পুরুষের পদ্ধতি কনডম ও ভ্যাসেকটমি সম্পর্কে।

তিনি বলেন, কনডম সম্পর্কে যেসব ধারণাগুলো রয়েছে যেমন কনডম পেটে চলে যায়, ছিঁড়ে যায়, কনডমে পিচ্ছিল যে বস্তু থাকে তা ক্ষতিকারক। ভ্যাসেকটমি সম্পর্কেও কিছু মিথ আছে লোকালি। যেমন পুরুষত্ব চলে যায়। পুরুষের শারীরিক শক্তি কমে যায়। তার যৌন শক্তি কমে যাবে। পুরুষের মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। পুরুষের গুরুত্ব কমে যায়। তাদের কদর কমে যাবে সমাজ ও সংসারে। নারীরাও তাই মনে করে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে কনডমের ব্যবহার উৎসাহিত করা হয় যৌনবাহিত রোগ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে নয়।

বিশ্বব্যাপীও নারীর জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিতেই প্রচারণা ও বিনিয়োগ হয়েছে বেশি। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কার্যকারিতা ও নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গবেষণাও হয়েছে নারীর শরীরকে মাথায় রেখে।

২০১৯ সালে পুরুষের জন্য প্রথম একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি প্রাথমিকভাবে মানবদেহের জন্য নিরাপদ হিসেবে পরীক্ষায় উৎরে গেলেও আজও তা বাজারে আসেনি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়নবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান শাশ্বতী বিপ্লব বলছেন, নারী গর্ভবতী হবে সে কারণে নারীই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যাবহার করবে এমন সামাজিক ধারণার বাইরেও এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থ। আর ওই কারণেই নারীদের শরীরকে চিন্তা করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তৈরি হয়।

তিনি বলেন, নারী প্রতি মাসের একটা নির্দিষ্ট সময় সন্তান নিতে সক্ষম থাকেন বাকিটা সময় থাকেন না। আবার তিনি একবার গর্ভবতী হলে বছর জুড়ে আর প্রজনন করতে পারেন না। কিন্তু একজন পুরুষ কিন্তু সবসময় সক্ষম থাকেন। ওই বিষয় চিন্তা করলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো পুরুষের জন্য হওয়াটাই বেশি বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বানান, বিক্রি করেন তারা কিন্তু মার্কেট রিসার্চ করেন। তারা জানেন কোনটা বেশি বিক্রি হবে। পুরুষের পদ্ধতি বিক্রি হবে না। তারা জানেন, নারীদেরটা বেশি বিক্রি হবে।

সবমিলিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের প্রশ্নে নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। জন্মনিয়ন্ত্রণের সরকারি প্রচারণায় অসুবিধাগুলো খুব কমই জানানো হয়।

নানা কষ্টদায়ক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও রুটিন করে ব্যাবহারের মানসিক চাপ সহ্য করে নারীদেরই জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়ভার বহন করতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দু’ক্ষেত্রেই তেমনটা দেখা যাচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি