Naya Diganta

করোনা, বিদ্যুৎ ও ডেঙ্গু প্রসঙ্গ

করোনা, বিদ্যুৎ ও ডেঙ্গু প্রসঙ্গ।

আমি এখন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। ২২ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় এখানে পৌঁছিয়েছি পারিবারিক সংবর্ধনা সম্মিলনে যোগ দিতে। আমরা ইদানীং জাতীয়, দলীয়, ঐতিহাসিক সভা সেমিনার, সম্মেলন, ওয়ার্কশপ, ওয়েবিনার ওগায়রা নিয়ে বিস্তর ব্যস্ততায় থাকি। তীরহারা জাতীয় সমস্যার ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেয়ার স্বপ্নে বিভোর দেশ ও জাতি : সেখানে সবাই ব্যক্তি ও পরিবারের সমস্যার কথায় কান দিতে বধিরতার ভান, চোখ থাকতে অন্ধত্ব ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিত্ব বরণে ব্যস্ত। অথচ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ভুল বা গোঁয়ার্তুমি, দলের দুর্নীতি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ সন্দ পদক্ষেপ, পারস্পরিক দোষারোপে সমস্যা পাশ কাটানোর প্রবণতায় বিশ্বের অনেক দেশই ভুগছে আবহমান কাল থেকে। আজ যে বিষয়ে বলছি, সেই শ্রীহীন করোনা, বশংবদ বিদ্যুৎ ও ডেঞ্জারাস ডেঙ্গু নিয়ে ভোগান্তিটা সাম্প্রতিককালে আরো বাড়ছে বলে প্রতীয়মান হয়।

করোনার ইদানীংকালের কলকাঠি নাড়ার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তার হাতে ব্যাট এখনো রয়েছে, শেষ ওভারের আগে আরো রান তুলতে পশ্চিমের একটা ক্রিকেটার টার্নড রাজনীতিকের মতো মরিয়া। ২০০৭-এর ৬ নভেম্বর কলম্বো সাগরে ট্যারা চোখ মেলেছিল যে ঘূর্ণিঝড় সিডর সেও কিন্তু ১৫ নভেম্বর অবধি সুন্দরবন তথা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে চরম আক্রমণ শানাতে সময় নিয়ে একটু একটু করে অগ্রসর হয়েছিল। বাংলাদেশের আবহাওয়া দফতর সিডরের গতিবিধির পূর্বাভাস ঠিকমতো দিতে পারেনি। বলেশ^র নদ দিয়ে সিডর যখন ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ সীমানায় তখন তড়িঘড়ি করে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত জারি করে আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া অফিস। ৯, ১০-এর ওপর আর কোনো সঙ্কেত হাতে ছিল না। ক্রিকেটের কাট মাস্টারের ঢেউ খেলানো স্পিনিং বল যেমন ঝানু ব্যাটসম্যানও ঠাওর করতে পারে না তেমনি করোনার পথনকশা নিয়ে অসহায় দেখা যায় শুধু বাংলাদেশের কেন বিশ্ব স্বাস্থ্য দফতরকেও। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্তাব্যক্তিরা কখনো মনে হয় নির্ভার, কখনো উদ্বিগ্ন প্রকাশেই সার; টিকা ব্যবসায়ীরা ফন্দিফিকিরে রত, আর অপকর্মের নথির হদিস ভোলাতে ব্যস্ত সমস্ত মুনশি মুৎসুদ্দি।

এবার করোনা ভিন্ন মেজাজে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের শক্তিমান মাতবরও করোনায় যখন আক্রান্ত, বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে সহযোগী ব্যাটসম্যান পেয়ে করোনা তখন সরকারের স্বাস্থ্য দফতর এবং উত্তরের মেয়র মহোদয়কে কথার সুর পাল্টানোর সুযোগ এনায়েত করছে। ডেঙ্গু যে করোনার চেয়ে ভয়াবহ সেটি বুঝলাম মার্কিন মুলুক থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসা আমার সাত বছরের নাতির ফিরে যাওয়ার টিকিট ক্যানসেলের ঘটনায়। মশহুর শিশু বিশেষজ্ঞ বললেন, করোনা নিয়ে আপনি ফ্লাই করতে পারেন কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ে নয়। করোনা সংক্রামক বটে কিন্তু এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু হঠাৎ অঘটনঘটনপটায়সী। সে কারণে করোনার সঙ্গী ডেঙ্গু। এখানেও করোনার রাজনৈতিক স্বার্থ বেশি। করোনা দেখছে, বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় ফিফথ স্ট্যান্ড করার আত্মতৃপ্তিতে বিভোর, বাজেট বক্তৃতার শেষ প্রচ্ছদে মেরিট লিস্ট ছাপিয়ে দিয়েছে। এখন সে দেখছে ওমিক্রনকে তার ওপর ঠাঁই দেয়ার চলছে পাঁয়তারা। করোনার স্বগতোক্তি কখন কিভাবে কাকে কার চেয়ে বড় ছোট করা যায় সেই খাসলত ছাড়তে না পারার জন্যই আজ ওমিক্রন ডেল্টা ডেলামিক্রমের নাম বেশি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, আমি করোনা, আমিই যে আসল মূলধারা, স্থপতি আর ওরা যে ‘বাঁশের চাইতে কঞ্চি বড়’ তা যেন ভুলানোর চেষ্টা চলছে। কখনো বলা হচ্ছে ওমিক্রন স্বভাবে প্রভাবে বেশ শক্তিশালী আবার কখনো বলা হচ্ছে ও তেমন কিছু না, সেখানে আমি কোথায়? এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যাওয়া? যেন কিছু ঘটেনি এতদিন, গত দেড় দু-বছরে। কত বিদ্বজ্জন, কৃতী ব্যক্তিত্ব, অতি আপনজন হারিয়েছেন যারা; তারা জানেন আমার সম্পর্কে। আর আমজনতার অর্থনীতির যে হাল হয়েছে তা যেন দেখেও না দেখার ভান করা হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বলেছেন, ‘বিপদে পড়লে সবাই তারস্বরে তাঁকে ডাকে, আর বিপদ কেটে গেলে তারা সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যায়, যায় এমনভাবে যে যেন তারা বিপদে পড়েইনি।’ করোনার আফসোস-অকৃতজ্ঞতার এবং শিক্ষা না নেয়ার এ স্বভাবেও পরিবর্তন আসেনি। সেই স্বভাবে ধাক্কা দিতে ডেঙ্গুও আজ তার সহযাত্রী।

দুই. করোনার প্রতিরোধ ও নিরাময়করণের ক্ষেত্রে স্বার্থান্ধ সাজার চেষ্টা প্রচেষ্টা থামেনি, কমেনি বরং বেড়েছে। ভেদ বুদ্ধি সম্পন্নদের মনশ্চক্রবালের বলয় প্রসারিত হয়েছে দেখে হতভম্ব করোনা। ব্যবসা এবং ভূরাজনীতির ব্যাপ্তি বেড়েই চলেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসল কাজে ব্যয় না বাড়িয়ে, দক্ষতা সক্ষমতা বাড়ানোর পথে না থেকে কিভাবে এভাবে সেভাবে অপব্যয় অপচয়ের সুযোগ পাওয়া যায় সেদিকে নজর যেন বেশি। বিদ্যুৎ বিভ্রাট পরিবেশে পরিস্থিতির আসল কারণের দিকে নজর যাতে না যায় সেজন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে জ্বালানি সঙ্কটের হোতা বলার সুযোগ নিচ্ছে অনেক দেশ। করোনার কারণে ১০-১১ মাস অর্থ পাচার বন্ধ ছিল, বরং রেমিট্যান্স বেড়েছিল, দেশের টাকা দেশে রাখার যুক্তি দেখিয়ে ন্যায়নীতির বাঁধন আলগাও হলো, বিদেশী বিনিয়োগে রোডশো করার পাশাপশি বিদেশে বিনিয়োগের সুপথ খোলা হলো। এদিকে করোনা যেই একটু বিশ্রামে গেল, সেই দেশের টাকা বিদেশে এমনভাবে উড়াল দিতে শুরু করে যে গন্তব্য দেশের অর্থবাজারে শৃঙ্খলা ভেঙে ভারসাম্য হারাবার উপক্রম। তারাই এটা যখন থামাতে চাইছে, তখন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে পাচারের অর্থের উৎসের সুনাম সুরক্ষার চেষ্টা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। করোনার আশঙ্কা এতে বিশ্ব অর্থবাজারে ঘাত প্রতিঘাত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে। আমরাও দেখে নেব- এ ধরনের একটি শীতল যুদ্ধ গরম হচ্ছে ইউক্রেন ঘিরে। ইতিহাস ভুগোল ভ‚রাজনীতি নেগোশিয়েশন কূটনৈতিক অর্থনীতি সব ব্যাপারে করোনার কাণ্ডজ্ঞান দেখে বিস্মিত হতে হয়।

করোনার পথনকশার কোনো সার্টিফাইড কপি সংগ্রহের চেষ্টায় না গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম এবারের মিশনে কোন পর্যায়ে আছে সে? জানাল, আগেও বলেছি বল তো স্ব স্ব দেশের কোর্টে। নিজেদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি বিরূপ আচরণ, নাফরমানি সৃষ্টিকর্তার প্রতি, নিজেরাই নিজেদের শত্রু বনে যাওয়ার প্রবণতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি দুরাচারের ভিড়ে সুনীতি ও সদাচার কোণঠাসা করে ফেলা, নিজের দোষ অন্যের ঘারে চাপানোয় চতুরতায় তৃপ্তি লাভ এবং নিজেদের নিরাপদ ভাবার ব্যূহ তৈরির মাধ্যমে বোকার স্বর্গে বসবাস যত দিন চলমান বহমান থাকবে তত দিন আমি করোনা স্বভাবগতভাবে আছি, থাকব। নিজেরা সম্মোহিত হয়ে সবাই দুষছে আমাকে, ক্রেমলিন- কিয়েভ যুদ্ধকে। সঙ্গত কারণে মহামারী প্রতিরোধ, মোকাবেলা বা নিরাময়ের কোনো বাধাধরা পদ্ধতি প্রক্রিয়া কিংবা সময়সূচি থাকে না। সবাই সম্মোহনে আছে বলেই নিজ স্বার্থে করোনাকে কখনো কঠিন করা হচ্ছে, আবার সহজ ভাবা হচ্ছে। অথচ সেদিন এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যথার্থই বলেছেন, প্রতিটি ঘরে যখন তখন জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্তরোগী আছে বা বাড়ছে। তবে এটি নিছক মৌসুমি ফ্লু নয়- বেশির ভাগ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মৌসুমি ফ্লুএবং ওমিক্রনের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো প্রায় একই রকম হওয়ায় সবাই বিষয়টি হালকাভাবে নিচ্ছেন। অনেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। অনেকে ফার্মেসি থেকে কিনে ওষুধ এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকও খাচ্ছেন, যা মোটেও সমীচীন নয়। এ ধরনের উপসর্গগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। অনেকে এখনো ওমিক্রনকে ‘মাইল্ড’ বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ ভাইরাস ‘সিরিয়াস’ হতে সময় লাগবে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রতিকার ও প্রতিরোধ মোক্ষম পন্থা। স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে। সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে। যার যখন সময় আসবে তাকে করোনা প্রতিরোধী টিকা অবশ্যই নিতে হবে। পরিস্থিতি হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।

ডেনমার্কে এসে যা জানলাম এবং দেখলাম করোনা ও জ্বালানি এবং বিদ্যুৎসঙ্কট মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে স্বপ্রণোদিত পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া দরকার। করোনা প্রতিরোধ ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা বা নিরাময় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবার স্বতঃস্ফূর্ত সজ্ঞান সহযোগিতা প্রয়োজন। দায়মুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার নামে ব্যয়িত বিপুল অর্থ (করের টাকা, বিদেশী অনুদান ও ধারকর্জের টাকা) বেহাত হয়েছে এ ধরনের গুজব কেন রটবে? টিকার দরদাম ও সরবরাহ নিয়ে শ্বেতপত্র দেয়া দরকার ছিল। শিক্ষায় যে আসল বিনিয়োগ সেখানে অমনোযোগিতা দেশের ভবিষ্যৎ ইমিউন ক্ষমতা খর্ব করতে পারে এই উপলব্ধি শানিত করতে না পারাটাই এ মুহূর্তের সমস্যা। সব ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ সৃজন বা বৃদ্ধি ছাড়া বিদ্যুৎ, ডলার সাশ্রয়, বিলাসবহুল গাড়ি ও সামগ্রী আমদানি বন্ধ এবং সর্বোপরি ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচির কার্যকর সুফল বা স্বাস্থ্যবিধি মানানোর প্রয়াস সফল হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ‘ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ প্রকাশনাটির WINTER 2021 : THE HEALTH ISSUEmsL¨viDenmark: It’s a matter of trust লেখাটা পড়ার পরামর্শ পাচ্ছি। দুর্নীতি সূচকে সবার নিচের দেশ ডেনমার্কের জনগণ সে দেশের সরকার গৃহীত অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা (জীবন ও জীবিকা) কর্মসূচির প্রতি আস্থাবান হয়ে সাড়া দিয়েছে। আইএমএফের পর্যবেক্ষণ Ô.. social trust is paramount in Denmark. Citizens trust that the government will enact policies in the public’s interest. Government trusts that citizens will maintain the social fabric. People trust that their fellow Danes will do what is required for the greater good. This social phenomenon played out during the pandemic, leading to a remarkably successful effort at stemming the virus at a relatively low human cost. আজ এ পর্যন্তই।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
mazid.muhammad@gmail.com