Naya Diganta

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা এবং অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা এবং অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ

দুটোই গুরুত্বপূর্ণ বাণী এবং মানবজাতির ইতিহাসে হাজার বছর ধরে দেশকাল-সমাজকে প্রভাবতি করে আসছে। একটি বাণী হলো, বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য এবং অন্যটি হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ। বাণী দুটোর বক্তব্য খুবই সহজ সরল এবং সাধারণের বোধগম্য। অর্থাৎ এগুলো বোঝার জন্য পাণ্ডিত্যের দরকার নেই। তবে এগুলো মান্য করা বা অনুশীলন করার জন্য অতি উঁচুস্তরের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, সাহস, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং লোভ-লালসাহীন মন-মস্তিষ্ক ও শরীর প্রয়োজন। এসব ব্যাপারে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করার পর আজকের শিরোনামের বিষয়বস্তুর সাথে রাষ্ট্রক্ষমতার কী সম্পর্ক তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে।

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য বাক্যটির জনক মহামতি চানক্য। আমাদের সমাজে অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে তরুণীদের বিয়ে করার জন্য রীতিমতো পাগলামো শুরু করেন এবং সেই আদিকাল থেকেই এ ধরনের অসম বিয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌত‚হলও কম নয়। কোনো আশি বছরের বৃদ্ধ যদি কুড়ি বছরের মেয়েকে বিয়ে করে বসেন তবে এলাকাবাসীর আনন্দের সীমা থাকে না। আর বিবাহিত বৃদ্ধ প্রথম কয়েক দিন আনন্দে লাফালাফি করলেও কিছু দিন পর তিনি বুঝতে পারেন কতবড় সর্বনাশের কবলে তিনি পড়েছেন। তরুণী বধূর আবদারে বৃদ্ধ যখন যুবক হওয়ার চেষ্টা করেন তখন তার ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। চুল দাঁড়িতে রং লাগানো। বউয়ের কথা মতো নিত্যনতুন স্টাইলের জামা কাপড় পরিধান এবং অহেতুক হাস্যরস করতে গিয়ে বৃদ্ধ তার সারা জীবনের অর্জিত মানসম্মান হারিয়ে সমাজে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হন।

বুড়ো বয়সে যুবতী বউয়ের বাহারী চাহিদা মেটানোর আর্থিক ও মানসিক সক্ষমতা না থাকলে বৃদ্ধের আয়ু হু হু করে কমতে থাকে। তার মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে যা কিনা তাকে আরো বৃদ্ধ বানিয়ে ফেলে। কোনো বৃদ্ধ যদি তার তরুণী বধূর সাথে সুখময় দাম্পত্যের জন্য বেশি খাওয়া দাওয়া, হাসি-তামসা শুরু করে তাও লোকটির জন্য হিতে বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অধিকন্তু শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় যদি কোনো উত্তেজক ওষুধ সেবন করেন তবে শরীরে রক্ত প্রবাহের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হার্ট অ্যাটাকসহ মলদ্বার দিয়ে তাজা রক্ত বের হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। অন্য দিকে, অক্ষম বৃদ্ধের সামনে যৌবনবতী স্ত্রী যখন ঘোরাফেরা করে তখন রাজ্যের হতাশা-অবিশ্বাস-ঈর্ষা ইত্যাদির কারণে যমদূত বৃদ্ধের চার পাশে কিভাবে লাফালাফি করে তা বিখ্যাত চলচ্চিত্র অন্তর্জ্বলী যাত্রায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বৃদ্ধের তরুণী ভার্ষা যে কিভাবে বিষতুল্য হয়ে ওঠে এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখলে তা রীতিমতো মহাভারতের আকৃতি ধারণ করবে। সুতরাং ওদিকে না গিয়ে এবার দ্বিতীয় বাণীটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ’ এই বাণীটির রচয়িতা হলেন বিখ্যাত মরমি সাধক এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক মহামানব মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী। মাওলানা রুমির মর্ম কথা হলো, জীবনের জন্য ন্যূনতম যা প্রয়োজন তার একটি সীমারেখা তৈরি করা সব মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। মানুষ যখন প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু আশা করে বা পাওয়ার জন্য চেষ্টা তদবির করে অথবা বিভিন্ন ছলাকলায় তা হাসিল করে নেয় সে ক্ষেত্রে প্রতিটি জিনিসই তার জীবনে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষের ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, ক্ষমতা, খাদ্য-পানীয়সহ বিভিন্ন বিলাসসামগ্রী, রাজনৈতিক-সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষমতা এবং লোভ-লালসা সব সময়ই মানব জীবনে ভয়ানক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে।

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর বক্তব্য এতটাই সর্বজনীন যে, তার বাণীর মর্মার্থ জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় এবং সেই আদিকাল থেকে আজ অবধি সারা দুনিয়ার রাজনীতিতে যে মহাবিপর্যয়গুলো ঘটেছে তার সবই হয়েছে সীমা অতিক্রম করার জন্য। সিংহাসনে আসীন রাজা মহারাজা এবং তাদের চ্যালা চামুন্ডারা যখনই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছু করার চেষ্টা করেছেন ঠিক তখনই তাদের জীবনে সে মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে যা যেকোনো বিষের চেয়েও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছে। ভারতবর্ষে তৈমুর লংয়ের আক্রমণ, নাদির শাহের আক্রমণ এবং লাখ লাখ লোকের প্রাণহানির পেছনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের সীমাহীন বিলাসব্যসন দায়ী ছিল। অন্য দেশের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতিগুলো মনে করত ভারতবর্ষ জয় করতে পারলে প্রভূত ধনসম্পদ লাভ করা যাবে।

ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকদের মতো আব্বাসীয় খলিফারা যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জাঁকজমক এবং সীমা অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয় শুরু করেছিলেন তখন সাম্রাজ্যের আমলা, কামলা, সেনাবাহিনী ও আমির ওমরাহরা দুর্নীতিপরায়ণ, অলস, কলহপ্রিয়, বিলাসী এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা সরকারি কাজকর্ম ফেলে যে যার অবস্থান থেকে সারাক্ষণ শুধু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মনোরঞ্জনের জন্য তেলবাজি করত এবং খলিফাকে অতিমানব বানানোর জন্য নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে পুরো রাজদরবারকে ভাঁড়দের আশ্রয়খানা বানিয়ে ফেলেছিল। ফলে যেদিন হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করলেন তখন খলিফা মুতাসিম বিল্লার সেনাবাহিনী যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করল এবং খলিফাকে বন্দী করে হালাকু খানের কাছে সমর্পণ করল। প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজপরিবারের প্রতিভূকে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান যে অপমান-লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা দিয়ে হত্যা করেছিলেন অমন নজির মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।

হালাকু খানের দাদা চেঙ্গিস খানের হাতে আরেকটি বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। আজকের পুরো মধ্য এশিয়া অর্থাৎ আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, উজবেকিস্তান-কিরঘিজিস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তানসহ ইউক্রেন ও রাশিয়ার কিয়দংশ, পুরো ইরান, চীনের কিয়দংশ বিশেষ করে ইউনান প্রদেশসহ তুরস্কের অর্থাৎ আনাতোলিয়ার বিশাল অংশ নিয়ে যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার আয়তনের সাথে তুলনীয় কোনো সাম্রাজ্য তখনো দুনিয়ার কোথাও ছিল না এবং পরবর্তী কালেও হয়নি। এমনকি চেঙ্গিস খান এবং কুবলাই খানের সাম্রাজ্যের আয়তন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের মতো বিশাল ছিল না। এই সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব কাল ছিল ১০৭৭ থেকে ১২৩১ সাল পর্যন্ত।

সুলতান মুহাম্মদ শাহ যখন এই সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসলেন তখন তিনি সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি শুরু করলেন। রাজধানী গুরগাওকে বানালেন বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নের মডেল। রাজদরবারে আনন্দ ফুর্তি। আমির ওমরাহদের দুর্নীতি ও বিলাসী জীবন। রাজপরিবারের সদস্যদের বিত্ত-বৈভব-চুরিচামারী এবং রাজধানীর পতিতালয় ও সরাইখানাগুলোর গল্প সারা দুনিয়ায় মশহুর হয়ে পড়ল। বিভিন্ন দেশের আমির ওমরাহ, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং লম্পটেরা ভোগ বিলাসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য রাজধানী গুরগাওয়ে দলবেঁধে আসতে আরম্ভ করল। এ অবস্থায় চেঙ্গিস খানের রাজধানী কারাকোরাম থেকেও কিছু ব্যবসায়ী গুরগাওয়ে এসে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হলেন। খবরটি চেঙ্গিস খানের কানে গেল। তিনি খাওয়ারিজম সম্রাট মোহাম্মদ শাহের দরবারে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়ে ঘটনার বিচার দাবি করলেন। কিন্তু উদ্ধত ও অহঙ্কারী সম্রাট তার চাটুকারদের প্ররোচনায় চেঙ্গিস খানের দূতকে হত্যা করে ফেলল।

ফলে চেঙ্গিস খান খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে রাজধানী গুরগাওকে এমনভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন যে, মধ্যযুগের পৃথিবীর একনম্বর কসমোপলিটান শহরটি আসলে কোথায় ছিল তা আধুনিককালের আর্কিওলজির সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়েও বের করা সম্ভব হয়নি।

বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা রাজনীতির জন্য কিরূপ ভয়ঙ্কর বিষ হতে পারে তার কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আজকের নিবন্ধের উপসংহারে চলে যাই। বিশ্বের সর্বকালের সেরা দু’জন মিলিটারি অ্যান্ড পলিটিক্যাল জিনিয়াস ছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং তার বন্ধু মহাবীর মার্ক অ্যান্টনি। দু’জনই ভুবনজয়ী সুন্দরী ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে জীবন যৌবন-সাম্রাজ্য সবকিছু হারিয়েছিলেন। অন্য দিকে কিংবদন্তির রোমান সম্রাট মার্কাস অরলিয়াসের জীবনেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। কুপুত্র কমোডাসের হাতে প্রাণ হারানো এই মহান শাসকের জীবনের একাংশ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র দ্য গ্লাডিয়েটর দেখলে আপনি চোখের পানি সংবরণ করতে পারবেন না। অন্য দিকে, ইতিহাসের কুখ্যাত সম্রাট নিরো যিনি কিনা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের পরকাষ্ঠা দেখানোর জন্য রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই সম্রাটের ধর্মপিতা সম্রাট ক্লডিয়াস যখন দুশ্চরিত্রা জুলিয়া এগ্রোপিনার প্রেমের ফাঁদে পড়েন তখন থেকেই তার পতন শুরু হয়। জুলিয়ার আগের স্বামীর ঔরশজাত সন্তান নিরো যিনি কিনা ছোটকাল থেকেই অটিস্টিক ছিলেন, তাকে ছলে বলে কৌশলে সম্রাট ক্লডিয়াসের উত্তরাধিকারী বানানো হয়।

নিজের শিশুপুত্রকে উত্তরাধিকার বানানোর পর কুচক্রী জুলিয়া এগ্রোপিনা এক রাতে বৃদ্ধ সম্রাট ক্লডিয়াসকে সেবা করার নামে খুন করে বসেন এবং নিরোকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজেই বিশাল রোমান সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। সম্রাট ক্লডিয়াসের এই তরুণী ভার্যা জুলিয়া প্রাচীন দুনিয়ার রাজনীতিতে কতটা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলেন যার পরিণতিতে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং অক্সিডিয়াস সিজার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জুলিয়া তার পুত্র নিরো কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন এবং নিরো গণবিক্ষোভের মুখে আজকের শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের মতো পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ আত্মহত্যা করেছিলেন।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমরা যদি মহামতি চানক্য এবং মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর অমীয় বাণীর মর্ম কথার আলোকে ২০২২ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাব অযোগ্য ও অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এমন সব কর্মকাণ্ড করছেন যা বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার সাথে রমণ করার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
ফলে চানক্যের নীতিকথার বিষময় ফলাফল আমাদের চার পাশে কিলবিল করছে। অন্য দিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কর্মকাণ্ড, হাঁকডাক, প্রচার-প্রপাগান্ডা, হম্বিতম্বি-অহঙ্কার যে আমাদের রাজনীতির জন্য কতটা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এবং অনাগত দিনে যখন আরো টের পাব তখন বিষ নামানোর জন্য কোনো ওঝা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য