Naya Diganta

চিংড়ি চাষে সাফল্য আসছে না

ছেলেবেলায় উপকূলীয় এলাকায় ধান চাষ করতে দেখেছি। কিন্তু সেই সময়ের কথা চিন্তা করলে এখন বিস্ময় জাগে। মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে মানুষের জীবনযাত্রার কী বিরাট পরিবর্তন! বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট জেলার কথা বলি। আশির দশকে এ জেলাগুলোতে বছরে একটিমাত্র বর্ষার ফসল হতো। দুই জাতের ধান বেশি দেখেছি। একটি পাটনাই আরেকটি হলো বোড়ান। স্থানীয় কৃষকদের কাছে এই নামেই পরিচিত ধানের এই দু’টি জাত। কোনো ভালো নাম আছে কি না আমার জানা নেই। তবে সে সময় কী পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো বিঘাপ্রতি, সে কথা নতুন প্রজন্মের কেউ শুনলে চমকে উঠবেন। এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ধান উৎপাদন হতো দুই থেকে তিন মণ! তারপরও কৃষকদের মুখে থাকত তৃপ্তির হাসি। এরপর এসব ধান কেনার জন্য পাইকাররা আসত অন্যান্য জেলা থেকে। তারা বড় বড় গয়না নৌকায় করে ধান নিয়ে যেত দেশের অন্য স্থানে। এসব অপরিচিত গয়না নৌকা দেখতে আমার মতো ছোট ছোট শিশুরা সেখানে ভিড় করত। স্থানীয় কিছু লোক তাদের সহায়তা করে কিছু আয় রোজগার করত। তারা ছিল দালাল। দালালরা সাধারণ মানুষের কাছে কুখ্যাত বলে পরিচিত। কারণ, অনেকের ধারণা- দালালরা মানুষ ঠকায়। তারপরও উপকূলীয় মানুষের মধ্যে তেমন কোনো অশান্তি, অস্বস্তি, অভাব-অনটন দেখিনি। কার্তিক মাসে কিছুটা অভাব পড়লেও তা ছিল সাময়িক। অগ্রহায়ণ এলেই আবার কৃষকের ঘরে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে মনপ্রাণ ভরে উঠত। কিন্তু এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আর বিশাল বিস্তৃত আকাশছোঁয়া মাঠ দেখা যায় না। ফসল উঠলে গৃহপালিত পশুগুলো ছেড়ে দেয়া হতো রাখালবিহীন অবস্থায় (স্থানীয় ভাষায় বলা হয়, উদোম)।
সারা দিন মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াত। দুপুরে যখন জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড তাপদাহ বেড়ে যেত তারা তখন আশ্রয় নিত বিভিন্ন গাছের নিচে। মৃদুবাতাসে শরীর ঠাণ্ডা করে চরে বেড়াত মাঠে মাঠে। কারো গবাদিপশু চুরি হয়েছে এমন কথা কোনো দিন শুনিনি। কিন্তু এখন গোয়ালঘরে গরু রাখার পরও অনেকে নিরাপদ মনে করে না। তালা লাগানার চল হয়েছে। সব কিছু পাল্টে গেছে।
আগে শহরের লোকেরা গ্রাম থেকে ধান কিনে নিয়ে যেত। এখন গ্রামের লোকেরা শহর থেকে চাল কিনে নিয়ে আসে। আগে শহরের লোকেরা গ্রাম থেকে জ্বালানি কিনত। এখন উপকূলীয় এলাকার লোকেরা শহর থেকে জ্বালানি নিয়ে যায়। আগে শহরের লোকেরা গ্রাম থেকে সবজি কিনে নিয়ে যেত, এখন উপকূলীয় মানুষ শহর থেকে সবজি কিনে নিয়ে আসে। সময়ের ব্যবধানে সবই পাল্টেছে।


এবার আসি যে শিরোনাম দিয়ে লেখাটি শুরু করে ছিলাম সে প্রসঙ্গে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মানুষ অনেক আতঙ্কে থাকত- কখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। তখন এই এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল খুবই নিম্নস্তরের। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করত। নব্বইয়ের দশকে শহরের কিছু মানুষ এসে উপকূলীয় এলাকায় বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু করে।
নদীর লবণাক্ত পানি দিয়ে বাগদা চিংড়ির চাষ করা হয়। এ কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। লবণাক্ততার কারণে দেশীয় প্রজাতির গাছপালা মরে যায়। কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। মরুভূমির মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও বাগদা, গলদা চিংড়ি দেশের সাদা সোনা হিসেবে খ্যাত। এ মাছ বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। অনেকে বাগদা চাষ করে আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে। আগে যারা কুঁড়েঘরে বাস করত এখন তাদের বাড়িতে বড় বড় বিল্ডিং দেখা যায়। বহু পরিবার এখন বাগদা চিংড়ির চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এ শিল্পের সাথে দেশের কয়েক কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারও প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অনেকে শুনে খুশি হবেন, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি জিআই সনদ (ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি) পেয়েছে। দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। এর পর একে একে ঢাকাই মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, নেত্রকোনার বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাংলাদেশী কালোজিরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, ইলিশ ইত্যাদি জিআই সনদ পায়।
বাগদা চিংড়ি জিআই সনদ পাওয়ায় বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় খুশি বাংলাদেশী চিংড়ি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু চিংড়ি চাষ লাভজনক হলেও এতে এখন ভাটার টান লেগেছে। কয়েক বছর ধরে এক প্রকার ভাইরাস দেখা দিয়েছে ঘেরগুলোতে। এ ভাইরাসে বাগদা চিংড়ি একটু বড় হয়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিষেধক অদ্যাবধি আবিষ্কার করা যায়নি। ১৯৯৫ সালে বাগদা চিংড়ি সঙ্কট দেখা দেয়। তখন থাইল্যান্ড থেকে বাগদা পোনা আমদানি করা হয়। তারপর থেকেই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু। অভিজ্ঞমহলের অভিমত, বাগদাপোনা আমদানির নামে ভাইরাস আমদানি করা হয়েছে।
বাগদা চিংড়ি চাষিরা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগবালাই দূর করতে পারলে বিপুলভাবে লাভবান হতে পারত। কারণ, এক বিঘা জমিতে জমির হারিসহ একজন চাষির খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ভাইরাস সংক্রমণ না হলে তাতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বাগদা মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। এক কেজি বড় বাগদার বাজারমূল্য এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। এদিকে এক শ্রেণীর কুচক্রী এ শিল্পকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। তারা অধিক লাভের আশায় বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষতিকর দ্রব্য চিংড়ির ওজন বাড়ানোর জন্য পুশ করছে। এসব পুশকৃত মাছ আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকবার ধরা পড়ার পর তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rahimkhulna8@gmail.com