Naya Diganta

বাজেটোত্তর অর্থনীতিতে চাপ

করোনা মহামারী শেষ হতে না হতেই রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ দেশের অর্থনীতিই চাপে পড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না, অধিকন্তু বিশ্বের আরো কিছু সংবেদনশীল অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বলা যায়, বিশ্ব এখন ক্রমেই বিভক্তির পথে এগোচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব বিনির্মাণের পথে পৃথিবীকে এগোতে হবে। একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করছেন চীনা নেতা শি জিনপিংও। বিপরীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার উদার গণতান্ত্রিক মিত্রদের দিয়ে একের পর এক জোট করে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
বৈশ্বিক এই পরিবেশের প্রভাব পড়ছে দেশে দেশে। ইউক্রেন সঙ্কটের প্রত্যক্ষ প্রভাব ইউরোপে বেশি দৃশ্যমান হলেও বিশ্ববাজারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি আর বিনিয়োগ প্রত্যাহার প্রবণতার কারণে মিসরসহ বেশ ক’টি নিম্নমধ্য আয়ের দেশ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছে। শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো কিছু দেশের অর্থনীতি তীব্র কাঠামোগত চাপে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিও নানামুখী চাপে।

চ্যালেঞ্জের মধ্যেই শুরু নতুন অর্থবছর
একধরনের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন শুরু করেছে। প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে অনুমোদনের সময় বড় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বাজেটের লক্ষ্যগুলোর সাথে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণভাবে যে ধরনের অর্থনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিপ্রণেতাদের জন্য খুব বেশি বিকল্প খোলা নেই। সরকারকে এখন ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা, জরুরি সরবরাহ বজায় রেখে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সমন্বয় করা, রফতানি প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখে রেমিট্যান্স আবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরানো এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ভারসাম্য যথাসম্ভব স্থিতিশীল রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে একটি বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যপরিস্থিতি। দেশী-বিদেশী নানা বিষয় মূল্যপরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য অব্যাহত থাকায় এ খাতে আমদানি খরচ ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। একই অবস্থা সৃষ্টি গমসহ কিছু খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে।

রফতানিতে রেকর্ড, বাড়ছে লেনদেনের ঘাটতি
বাংলাদেশের রফতানি আয় সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে অস্থির বৈশ্বিক পণ্যবাজার ও আমদানি ব্যয় আরো বেশি বাড়ার কারণে বাণিজ্যঘাটতি প্রসারিত হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে রেমিট্যান্স ১৫ শতাংশ হ্রাস পাওয়ায় একই সাথে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ঘাটতিও। এতে বিনিময় হার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভও চাপে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) আমদানি ব্যয় ৮১.৪৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা একই সময়ে রফতানি আয়ের চেয়ে ৩৪.৩২ বিলিয়ন ডলার বেশি। এতে বাণিজ্যঘাটতির অঙ্ক সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বিস্তৃত বাণিজ্যঘাটতি বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের ওপর চাপকে আরো তীব্র করেছে আর চলতি হিসাবের ভারসাম্যের খারাপ অবস্থা স্থানীয় বাজারে ডলার সঙ্কটও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিদায়ী অর্থবছরের শেষে ছিল ৪১.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৪৬.৩৯ বিলিয়ন ডলার। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি দর, ব্যাংকের লেনদেনের দর এবং খোলা বাজারে ডলারের দর- সবটাই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি হিসাব ঘাটতি ২০২২ অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১৭.২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা একই বছরের জুলাই-এপ্রিল থেকে ১২ শতাংশ বেশি।
পোশাকের রেকর্ড শিপমেন্টই বার্ষিক রফতানিকে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৫২.০৮ বিলিয়ন পর্যন্ত নিয়ে গেছে। হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য এবং ঐতিহ্যবাহী পাট ও পাটজাত পণ্যও রফতানিতে ভালো করেছে। ইপিবির তথ্য অনুসারে, বিদায়ী বছর পণ্য চালান থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪৩.৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থবছরের শেষে অতিরিক্ত ৮.৫৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। আট বিলিয়ন ডলার মূল্যের সেবা রফতানির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হলে অর্থবছর শেষে রফতানি ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।
জুন মাসে রফতানি গত অর্থবছরের একক মাসে সর্বোচ্চ ৪.৯০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড করেছে। এই আয় আগের বছর জুনের তুলনায় ৩৭% বেশি। জুলাই-জুন মাসে, দেশের পোশাক খাত থেকেই ৮১ শতাংশের বেশি (৪৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের পণ্য রফতানি হয়েছে।
বিকেএমইএ তিনটি কারণে পোশাকের রফতানি ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছে। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পণ্যের দামের ওপর প্রতিফলিত হয়েছে, কোভিড ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে বাড়তি অর্ডার এসেছে এবং ইতিবাচক বৈশ্বিক ভূরাজনীতি রফতানির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জন্য সামনে আরো সুযোগ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ চীনের পাশে আরেকটি নির্ভরযোগ্য সোর্সিং গন্তব্য খুঁজছে।
এবারের মুদ্রানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির বলেন, চলতি অর্থবছরে বিনিময়হার স্থিতিশীল রাখাই হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বন্ধে সবধরনের ব্যবস্থা নেবে। বাস্তবে তা কতটা সম্ভব হয় সেটিই দেখার ব্যাপার। রফতানির নতুন ঋণপত্র পর্যালোচনা করা হলে খুব দ্রুত আমদানি ব্যয় কমবে বলে মনে হয় না। বাণিজ্যঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেই আমদানি ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতিতে কাঁচা তুলা, সুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী, ফার্মাসিউটিক্যাল ইনপুট, সার, প্লাস্টিক এবং রাবার সামগ্রীসহ শিল্প কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিকে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পণ্যের দাম না কমলে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না।

আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ
বাজেটোত্তর বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার ঋণ পরিশোধে অব্যাহতভাবে নীতি শিথিলকরণের কারণে বিপুল অঙ্কের অনিয়মিত ঋণ নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে। কিস্তি ফেরত আসা ছাড়াই এসব ঋণের লাভ হিসাব করায় ব্যাংকগুলোর দৃশ্যমান মুনাফা বেশি হয়েছে। আর সেই মুনাফার কর সরকারের তহবিলে জমাও হয়েছে; কিন্তু মূলধন পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যাংকগুলোর কাঠামো নড়বড়ে হতে শুরু করেছে।
গত বছরের মতো চলতি বছরেও শর্তসাপেক্ষে ঋণ আদায়ে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। একই সাথে কমানো হয়েছে আমানতের সুদহার। আর এ ছাড়ের মধ্যেই ২০২২ অর্থবছরের শেষার্র্ধেও বেড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। এবার বলা হয়, বকেয়া কিস্তির ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই খেলাপি করা যাবে না। খেলাপি না হলে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় না। আর প্রভিশন সংরক্ষণ কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকেরই বেড়েছে পরিচালন মুনাফা। ঋণ আদায় না করেও কৃত্রিম আয়ের ওপর ভর করেই গেল বছর বেশির ভাগ ব্যাংক নগদে লভ্যাংশ বিতরণ করেছে। এতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের মূলধন।

ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশ এখন চলে যাচ্ছে দুর্নীতির দায়ে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের দায় মেটাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো আদায় হচ্ছে না। ফলে এগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর বাইরেও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় দেখিয়ে, আমানতের সুদের বিপরীতে সংরক্ষিত প্রভিশন ও ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য সুদকে আয় হিসেবে দেখিয়ে মুনাফা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বেআইনিভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করে মুনাফার অঙ্ক বাড়াচ্ছে। অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়ার পর এগুলো ফেরত দেয়ার নজিরও রয়েছে।
কোনো ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় না হলে তা আয় হিসেবে দেখাতে পারে না ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতেও কোনো আয় দেখাতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সুদ হিসাব করে আলাদা একটি হিসাবে জমা রাখতে হয়। কেবল আদায় হলেই তা আয় খাতে নেয়া যাবে, এর আগে নয়; কিন্তু ব্যাংকগুলো সুদ আদায় না করেই কাগুজে আকারে মুনাফা আয় খাতে নিয়ে যাচ্ছে।
বছরের শুরুতে পরিচালকরা ব্যাংক নির্বাহীদের বিভিন্ন খাতে ব্যবসার একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেন। এটি অর্জন করতে না পারলে পদোন্নতি আটকে যায়, প্রোফিট বোনাস কম পাওয়া যায়। এসব কারণে ব্যাংকাররা পরিচালকদের চাপে অনেকসময় বাড়িয়ে দেখানোর নজিরও অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বের হয়ে আসে।
একটি শীর্ষ দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংক শত কোটি টাকার কাছাকাছি মুনাফা দেখিয়েছে ২০২১ সালে, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংকটি শুরু থেকে যে ঋণ দিয়ে এসেছে তার ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জামানত বা দলিলপত্র রাখা হয়নি। এমনকি ভল্টের হিসাবের মধ্যেও নয়-ছয় এর ঘটনা ঘটেছে। এই প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংকটির ৯৫ ভাগ ঋণ যদি কুঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে তবে অচিরেই এটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠান হবে। এ ধরনের অবস্থা যদি আরো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তাহলে নতুন অর্থবছরের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে এটি হয়ে উঠতে পারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ঝুঁকি।

রাজস্ব আয়ে সঙ্কট
বাজেটের কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন নতুন অর্থবছরের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বর্ধিত আমদানির কারণে কিছুটা হলেও রাজস্ব আয় বাড়বে; কিন্তু সেটি দিয়ে সংশোধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। অর্থবছরের ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মাত্র ১৪.৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছে। এতে শেষ মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এনবিআরকে রাজস্ব আদায় করতে হবে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ সারা বছরের লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশ। এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর ফলে নতুন অর্থবছরের বাস্তব রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো ৪০ শতাংশের কোঠায় চলে যেতে পারে। অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থায় যা অর্জন করা অনেকটাই অসম্ভব।
রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে সরকারের অনুন্নয়ন-উন্নয়ন বাজেটে পড়তে পারে। এবার রেকর্ড বাজেট ঘাটতি সংস্থানের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা ও বৈদেশিক খাতের ওপর বেশি নির্ভর করা হয়েছে। অর্থবছরের শেষদিকে ব্যাংক ব্যবস্থার ঋণ বেশ খানিকটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার অর্থ হলো হার্ড কারেন্সির প্রচলন বেড়ে যাওয়া, যার প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর সরাসরি পড়ে।
ঘাটতি অর্থায়নের সাথে আরেকটি বিষয় সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে, সেটি হলো ৬-৯ শতাংশ সুদের হার। বাংলাদেশে ঘোষিত মূল্যস্ফীতি যেখানে ৬ শতাংশ এবং টাকার অবমূল্যায়ন কয়েক মাসে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে সেখানে ব্যাংক আমানতকারীদের ৬ শতাংশ সুদ দেয়া, যা কর কাটার পর ৪ শতাংশে ঠেকে, আমানতকারীদের মূলধনকে প্রকৃত অর্থে অব্যাহতভাবে ক্ষয় করছে। এ কথা ঠিক ৯ শতাংশে ব্যাংক বিনিয়োগ পেলে উদ্যোক্তাদের জন্য তা লাভজনক হবে; কিন্তু বাস্তব অবস্থা যতটা জানা যায়, ব্যাংকের তহবিল নামে-বেনামে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর হাতেই চলে যাচ্ছে, যারা ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেরা গ্রহণ করেছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য থেকে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাচ্ছে না আর স্বল্প সুদের আমানতে সাধারণ মানুষ মূলধন হারাচ্ছে।

কৌশলগত শঙ্কা
বৈদেশিক খাতের যে সঙ্কট তার পেছনে কৌশলগত বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয় অন্যান্য দেশও এর সম্মুখীন হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধিতে জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেল আমদানির চাপ ভারতেও তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। যার ফলে দেশটির জাতীয় মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে অব্যাহতভাবে কমছে। নয়াদিল্লী এ চাপ সামলানোর জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি ও ভোজ্যতেল আমদানি করছে। রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর সুইফটের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত দেশটির সাথে স্বাভাবিক ব্যাংকিং চ্যানেলে বাণিজ্য করতে পারছে না। আবার একই সাথে ব্রিকস ও ইন্দোপ্যাসিফিক জোটের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে রুবলে বাণিজ্য করার ঝুঁকিও নিতে চাইছে না। ফলে ব্যাংক অব রাশিয়ার প্রস্তাব সত্ত্বেও কারেন্সি সোয়াপের অ্যারেজমেন্ট যতদূর জানা যায় চূড়ান্ত হয়নি। এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সুইফটের বিপরীতে চীনা বাণিজ্য তথ্য পরিষেবা ‘চিপস’-এর মাধ্যম ইউয়ানে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন করছে দিল্লি। চীনের সাথে ভারতের দৃশ্যমান কৌশলগত সঙ্ঘাত সত্ত্বেও ভেতরে ভেতরে তাদের ব্রিকস বন্ধন এত জোরালো যে, পাশ্চাত্যের অবরোধ এড়িয়ে যেতে চীনা মুদ্রায় রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য লেনদেন করছে দেশটি।


কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন রাশিয়ার সস্তা তেল ও গম পেতে কিভাবে লেনদেন করতে হবে তার নির্দেশনার জন্য ভারতের সহায়তা চেয়েছিলেন। দিল্লির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পাওয়া গেছে কি না তা জানা যায়নি। তবে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে ব্যাংক অব রাশিয়া বাংলাদেশকে কারেন্সি সোয়াপ ও বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একটি চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে রেখেছে।
এ ব্যাপারে চুক্তি সম্পন্ন করে ভারতের মতো সস্তায় তেল ও গম কিনতে পারলে বাংলাদেশের আমদানি খরচের বড় রকমের সাশ্রয় হতে পারত। চীনের সাথে বাংলাদেশের যেহেতু ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে তাই রাশিয়ার সাথে চীনা ‘চিপস’ ব্যবহার করে ইউয়ানে বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেন করা সম্ভব হতো। এ ক্ষেত্রে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে ভারতের ধাক্কা সহ্য করার যে ক্ষমতা সেটি বাংলাদেশের কতটা রয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরে বাংলাদেশ ইউরোপীয় বাজারে রেয়াতি সুবিধা আর পাওয়ার কথা নয়। তবে ইউরোপীয় কমিশন থেকে শর্ত সাপেক্ষে ২০২৮ সাল পর্যন্ত এই জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার ব্যাপারে একটি মৌখিক আশ্বাস ছিল। গত ২৮ জুন বাংলাদেশের ইউরোপীয় কমিশনের সাথে কৌশলগত সংলাপের একটি সূচি ছিল। যতদূর জানা যায়, অজ্ঞাত কারণে সেটি আগামী নভেম্বর নাগাদ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ইউরোপিয়ান কমিশন সস্তা দামের কম মানের পোশাক আমদানির ওপর একধরনের বিধিনিষেধ আরোপের বিষয় বিবেচনা করছে। এটি সত্য হলে ইউরোপে পোশাক রফতানির ওপর এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এতটাই সঙ্ঘাতমুখর হয়ে উঠেছে যে, এতদিন অনুসৃত সবার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের এজেন্ডা হলো রাশিয়া-চীনকে কৌশলগতভাবে আটকাতে হবে। ন্যাটোর সদ্য সমাপ্ত শীর্ষ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়াকে সরাসরি ঝুঁকিযুুক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে এক দিকে আকসা, জিসুমিয়া প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর আর ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগ দেয়ার চাপ, অন্য দিকে এসব না করতে চীন-রাশিয়ার চাপ সত্যিকারের এক ডিলেমা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় খুবই সতর্কতার সাথে এগিয়ে বৈদেশিক খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে।
mrkmmb@gmail.com