Naya Diganta

কোরবানি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা ও এর জবাব

ইসলামবিদ্বেষীরা কৌশলে ইসলামী বিধিবিধানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। কোরবানি নিয়েও কিছু নেতিবাচক প্রচারণা চলাতে চেষ্টা করছে, যেমন-কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলছেন, কোরবানিতে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তা না করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সে অর্থ দান করলে বেশি কল্যাণকর হতো। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের কথায় যুক্তি আছে মনে হলেও আল্লাহর দেয়া বিধানের প্রত্যেকটিতে রয়েছে মানবকল্যাণ, একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে তা বোঝা যাবে।

কোরবানির কথাই ধরা যাক। কিছু খামার ছাড়া বেশির ভাগ পশু পালন করে গ্রামের দরিদ্র মানুষ। গৃহিণীরা ভাতের মাড়, তরকারির খোসা ফেলে না দিয়ে সেই সাথে কিছু খৈল ভুসি খাইয়ে গরু পালন করে। ধরা যাক একজন দরিদ্র লোক ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে এভাবে লালন পালন করে এক বছর পর কোরবানির সময় এক লাখ টাকায় সেটি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা বাড়তি পেল, যদি ৩০ হাজার টাকা খরচ ধরা হয় তাহলেও সে নিট ৩০ হাজার টাকা লাভ পেল। কোরবানি এভাবে দরিদ্রদের হাতে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। পশু বেপারি যারা তারা ও সাধারণত দরিদ্র মানুষ, কোরবানি উপলক্ষে পশুর ব্যবসায় করে তারাও লাভবান হচ্ছে। অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে ট্যাক্স আদায় না হলেও কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে ৪-৫ শতাংশ হারে হাসিল দিতে হয়, ইজারাদার যেমনি লাভবান হচ্ছে, সরকারি কোষাগারেও কোটি কোটি টাকা জমা হচ্ছে।

কোরবানির চামড়ার অর্থ সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দেয়া হয়, যদিও দীর্ঘদিন থেকে চামড়ার সঠিক মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এক জোড়া চামড়ার জুতার দাম দুই হাজার টাকা কিন্তু আস্ত একটি গরুর চামড়া ২০০-৩০০ টাকা মাত্র। এ কারসাজি বন্ধ হলে দরিদ্ররা আরো বেশি উপকৃত হতো। কোরবানির পশু কোরবানির চামড়া পরিবহনে পরিবহন শ্রমিক, ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকরা উপকৃত হয়। চামড়া, হাড়, শিং দিয়ে তৈরি সামগ্রী বিক্রেতাসহ সবাই লাভবান হয়। পশুর কিছু বর্জ্য সরাসরি জমিনের উর্বরতা বাড়ায়, কিছু বর্জ্য মাছের খাদ্য তৈরিতে কারখানায় ব্যবহার হয়। কোরবানি উপলক্ষে কোটি কোটি টাকার পশু ক্রয়-বিক্রয়ে যে লেনদেন হয় অর্থনীতির ভাষায় তাকে বলে সার্কুলেশন অব মানি, যা প্রবৃদ্ধির একটি সূচক ও দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর।

কোরবানির গোশত সাধারণত তিন ভাগ করে একভাগ দরিদ্রদের দেয়া হয়, আমিষ তথা প্রোটিন মানবদেহের কোষ গঠনের জন্য ও বয়স্কদের কোষ রক্ষায় খুবই প্রয়োজনীয়। গোশত ডাল আমিষের প্রধান উৎস। একজন দরিদ্রের পক্ষে ৬০০- ৭০০ টাকা ব্যয় করে সারা বছরেও হয়তো গোশত খাওয়া হয় না। ফলে তারা অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। কোরবানির গোশত বেশ কিছু দিন তাদের প্রোটিনের অভাব মেটায় যা তাকে কর্মক্ষম রাখে। দুর্গাপূজায় লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিমা সাজিয়ে পানিতে ফেলে দেয়া হয়, অন্যান্য অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেক টাকা খরচ হয় তাকেও অপচয় বলা যাবে না। কারণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানুষকে ধর্মভীরু হতে সহায়তা করে, যেকোনো ধর্মের লোক হোক না কেন ধর্মভীরু লোক ভালো লোক হয়, আজকের সমাজে ভালো লোকের বড়ই অভাব। আমাদের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ফুল ও আতশবাজিতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়, এটাকেও অপচয় বলা ঠিক হবে না। কারণ, এতে দেশপ্রেম সৃষ্টি হয়, দেশপ্রেমিক দেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করে। ভালোবাসা দিবসসহ অনেক ক্ষেত্রে অপচয়ের বিষয়ে কিছু না বলে খোদাভীতি সৃষ্টিকারী দরিদ্রদের জন্য উপকারী কোরবানি বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তা ছাড়া এই অর্থ চেয়ারম্যান-মেম্বার, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতরণ করা হলে যথাযথভাবে পৌঁছার ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকলেও কোরবানির মাধ্যমে সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই।

কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলছেন, কোরবানির নামে পশুহত্যা না করে নিরামিষভোজী হওয়া উত্তম। অনেকে কোরবানিকে জীবহত্যা ও নিজকে নিরামিষভোজী হিসেবে পরিচয় দেন। এ ধরনের লোকের জানা দরকার, আল্লাহ পৃথিবীর সব কিছু মানুষের উপকার ও ভোগ, ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। নিরামিষভোজী শাকসবজি খান, শাকসবজি গাছের কি জীবন নেই? গাছ কি খাদ্য খায় না? গাছ মাটি থেকে তুলে রাখলে সেটি কি মরে যায় না? ধরুন তিনি কচি লালশাক পছন্দ করেন, খাওয়ার জন্য তা তুলে নিতে লালশাক গাছ যদি তাকে প্রশ্ন করে- আমি আরো বড় হতাম, আমার পরাগায়ন হতো, আমার বীজ হতো, আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যেতাম, তুমি কেন আমায় তুলে মেরে ফেললে? তিনি কী জবাব দেবেন? তিনি যদি বলেন গাছের জীবন সচল নয়। তার জবাবে বলা যায়, ধরা যাক তার একজন ভাই আছেন যে অন্ধ লেংড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ, অচল। তাকে যদি কেউ হত্যা করে হত্যাকারী অপরাধী হবে কি না? তাহলে অচল হলেও গাছের প্রাণ হরণকারী সে দৃষ্টিতে অপরাধী হবে না কেন?

আল্লøাহ পৃথিবীতে তৃণভোজী প্রাণী, মাংসাশী প্রাণী, মাংস ও তৃণ উভয়টি খায় এমন প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। তৃণভোজী গরু ছাগল ইত্যাদি প্রাণীর সামনের সবগুলো দাঁত কর্তন দাঁত, তারা ঘাস লতাপাতা দাঁতে কেটে খায়। মাংসাশী প্রাণী বাঘ সিংহের সূচালো ছেদন দাঁত, তারা শিকারকে কামড়ে ধরে রাখতে পারে ও মাংস ছিঁড়ে খায়, তাদের থাবা ও নখ শিকার আঁকড়ে ধরার মতো। মানুষের সামনে কর্তন দাঁত, তার সাথে আবার দু’পাশে ছেদন দাঁত, কারণ মানুষ শাকসবজি খাবে আবার গোশতও খাবে। আল্লøাহ যার যার খাদ্য উপযোগী করে কেন সৃষ্টি করলেন? আর আমরা সে উপযোগিতার বিপরীত কথা বলছি।

গরুকে গোশত খাওয়ালে তার পাকস্থলী তা হজম করতে পারবে না, অসুস্থ হয়ে সে মারা যাবে। বাঘ-সিংহকে ঘাস খাইয়ে বাঁচানো যাবে না কিন্তু মানুষের পাকস্থলীতে উদ্ভিদ যেমন হজম হয়, গোশতও হজম হয়। আল্লাহ আমাদের পাকস্থলীকে কেন উভয়টি হজমের উপযোগী করলেন? এ খাদ্যচক্রের মধ্যে রয়েছে পরিবেশের ভারসাম্য। বাঘ-সিংহে দু’-চারটি করে বাচ্চা দেয়, একটি হরিণ সাধারণত একটি বাচ্চা দেয়, বাঘ-সিংহ কেউ খায় না কিন্তু হরিণকে বাঘ-সিংহ খায়, তবুও হালাল প্রাণী হওয়ার বরকতে বনে হরিণের সংখ্যা বেশি। বাঘ কেন হরিণ খায়? বাঘ যদি হরিণ না খেতো তাহলে বনে হরিণের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত, ফলে হরিণ সব চারাগাছ খেয়ে সাবাড় করে দিত, এক সময় বয়স্ক বড়গাছগু মরে গেলে গাছশূন্য হয়ে বনভূমি ধ্বংস হয়ে যেত। মানুষ যদি গরু-ছাগল না খেতো তবে গরু ছাগলের সংখ্যা বেড়ে সব শাকসবজি খেয়ে সাবাড় করে দিত, ফলে নিরামিষভোজীরা শাকসবজি খুঁজে না পেয়ে না খেয়ে মরে যেত।

আল্লাহর সব বিধান মানুষের কল্যাণের জন্য তা না বোঝাই এ ধরনের প্রশ্নের অবতারণা। খ্রিষ্টাদের একটি অংশ নববর্ষে শত শত পাখি হত্যা করে ভোজ করে। স্পেনে খেলা হিসেবে শত ষাঁড়কে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। কোনো কোনো দেশে উৎসবে শত শত ডলফিনকে হত্যা করে সাগরের পানি লাল করা হয়। অথচ ইসলামের নবী মানবতার নবী বলেছেন, ‘কেউ যদি খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া বিনা কারণে একটি চড়ুই পাখিও হত্যা করে কিয়ামতের দিন তাকে জবাবদিহি করতে হবে’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। কোনো কোনো দেশে পশুকে বেঁধে তার মাথার পেছনে আঘাত করে হত্যা করা হয়, এতে রক্ত বের না হয়ে গোশতের সাথে মিশে ওজন বাড়ে, ফলে ব্যবসায়ী কিছু লাভবান হয়। এতে রক্তের দূষিত উপাদান গোশতে মিশে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, অপর দিকে পশুর প্রাণ বের হতে কষ্ট বেশি হয়। অথচ নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়াকে সব কিছুর উপর স্থান দিয়েছেন, তোমরা পশু জবাইয়ের সময় ছোরা ভালোভাবে ধার দাও, সুন্দরভাবে জবাই করো যেন সহজে প্রাণ বের হতে পারে’ (মুসলিম)। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়ও দেখা গেছে, জবাইকালীন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রক্ত বের হয়ে যাওয়ার কারণে পশুর বোধশক্তি চলে যায়, সে বেহুঁশ হয়ে যায়, ফলে সে কষ্ট পায় না। তারপরও কি কোরবানির বিধানকে পশুহত্যা বা অমানবিক বলা যাবে?

লেখক : অধ্যক্ষ ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা