Naya Diganta

মহানবী সা:-এর সাথে আয়েশা রা:-এর বিবাহ ও প্রসঙ্গ কথা

মহানবী সা:-এর সাথে আয়েশা রা:-এর বিবাহ ও প্রসঙ্গ কথা।

মহানবী সা:-এর সম্মান ও সামাজিক অবস্থান সাধারণ মানুষের মতো নয়; তিনি বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালার বিশেষ প্রতিনিধি ও তাঁর মুখপাত্র। মহানবী সা:-এর ওঠা-বসা, চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধু ও শত্রুর সাথে তার মনোভাব-আচরণ, তাঁর সফর-অবস্থান ও তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মানবতার জন্য বিরাট শিক্ষা ও উপদেশ-এমনকি তাঁর নিরবতাও।

মহানবী সা: পর্যন্ত এসে নবুওত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণ হয়েছে। তাঁর পরে কোনো নবী আসবে না; বরং আসতেও পারবে না। এজন্য বিশ্বনবী মোহাম্মদ সা:-এর ব্যক্তিসত্তা ও চারিত্রিক গুণাবলি এক শ’-দুই শ’ কিংবা এক হাজার-দুই হাজার বছরের জন্য নয়; বরং কেয়ামত ও মহাপ্রলয় পর্যন্ত অনুসরণীয়। তাঁর সীরাত ও সুন্নাত পরিপালনে আখেরাতে যেমন পুরস্কার রয়েছে, ঠিক তেমনি দুনিয়ার সাফল্যও নিহিত রয়েছে তার মধ্যে।

মানবজীবনের অন্যতম একটি অধ্যায় হলো-দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন। প্রতিটি মানুষই এই দুই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। বিভিন্ন মানুষের পেশা ও জীবনধরণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও যে জায়গাটায় সবাই এক, তা হলো- সে কোনো না কোনো পরিবারের অংশ, তাকেও বিয়ে-শাদী পর্ব অতিক্রম করতে হয়। আর এর মাধ্যমে শুরু হয় আরেকটি নতুন পরিবারের পথচলা। ওই পরিবারে যেমন পুরুষের অংশীদারিত্ব থাকে তেমনি থাকে নারীরও। যখন একটি পরিবারের সূচনা হয়, তখন পরিবারটিকে সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যাপারও আসে। সেজন্য মহানবী সা:-কে সাধারণ মানুষের বিপরীতে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তিনি পৃথক পৃথক গোত্রের নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মাধ্যমে ইসলাম প্রসারের পথ সুগম হয়। মহানবী সা:-এর স্ত্রীরা আপন আপন গোত্ররীতি ও আচরণ সম্পর্কে তাঁকে বিশদভাবে জানাতেন। মহানবী সা:-এর সর্বমোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে হজরত আয়েশা রা: ব্যতীত অন্য সবাইকে আল্লাহর রাসূল সা: বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা অবস্থায় বিবাহ করেন।

মহানবী সা: সর্বপ্রথম বিবাহ করেন হজরত খাদিজা রা:-কে। যিনি তাঁর চেয়ে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। একইসাথে তিনি ছিলেন বিধবা। ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত মহানবী সা:-এর এই একজন স্ত্রীই মাত্র ছিলেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত বাকি ৮ বছরে তিনি অন্য স্ত্রীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

মহানবী সা: যখন ২৫ বছরের টগবগে যুবক, তখন ৪০ বছরের এক নারীকে বিয়ে করেন। একজন স্ত্রী বাদে অন্য স্ত্রীগণ সবাই হয়ত তালাকপ্রাপ্তা কিংবা বিধবা ছিলেন। মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় যৌবনকাল; তখন তিনি একটি মাত্র বিবাহ করেন আর বাকি বিয়েগুলো করেন জীবনের পড়ন্ত বেলায়। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো যদি বিবেচনায় রাখা যায়, তাহলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে, যেসব ভুল ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে মুসলিমদের ওপর আপতিত হয়। ওই ভুলগুলোর একটি- হজরত আয়েশা রা:-কে আল্লাহর রাসূল সা:-এর বিয়ে করা।

বাস্তবতা হলো- হজরত আয়েশা রা:-এর বিয়ে সর্বপ্রথম জুবায়ের ইবনে মুতঈম রা:-এর ছেলের সাথে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তখন পর্যন্ত জুবায়ের ইবনে মুতঈম রা:-এর বংশের লোকেরা ইসলামে দীক্ষিত হয়নি। ছেলের সাথে আয়েশা রা:-এর বিয়ের বিরোধিতা করেন জুবায়েরের স্ত্রী। তিনি বললেন, যদি আবু বকরের মেয়ে আমাদের ঘরে এসেই পড়ে, তাহলে আমাদের ঘরও ‘বদদ্বীন ও ধর্মহীন’ হয়ে যাবে। এজন্য আমি এই সম্মন্ধ মানতে পারছি না। (মুসনাদে আহমাদ, ৬/২২১) স্ত্রীর আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে জুবায়ের ইবনে মুতঈম বিয়েটি বাতিল করে দেন।

হজরত খাদিজা রা: ইন্তেকাল করলেন। তখন হজরত খাওলা রা: মহানবী সা:-এর কাছে হজরত সাউদা ও হজরত আয়েশা রা:-এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। হজরত সাউদা রা: ছিলেন আল্লাহর রাসূল সা:-এর সমবয়সী। মহানবী সা: সাউদা রা:-কে বিয়ে করলেন। একইসাথে গায়বের ইঙ্গিতে হজরত আয়েশাকেও স্ত্রী হিসেবে গ্রহণে সম্মত হলেন এবং খাওলা রা:-কে আয়েশা রা:-কে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা সামনে আগানোর পরামর্শ দিলেন। তখন খাওলা রা: হজরত আবু বকর রা:-এর কাছে এই প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। আর প্রস্তাবের পর আবু বকর রা:-ও মনেপ্রাণে এটি চাইছিলেন কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়- বিয়ের রীতিতে। কেননা, জাহেলি সমাজে মুখে বলা ভাইয়ের সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়াকে হারাম মনে করা হতো। তাই তিনি তখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসলেন না; বরং চিন্তা করতে লাগলেন কী করা যায়? যখন হজরত খাউলা রা: ব্যাপারটি আল্লাহর রাসূল সা:-কে জানালেন, তখন তিনি বললেন, আবু বকর আমার দ্বীনি ভাই; আপন নয়। এজন্য তার মেয়ের সাথে আমার বিবাহে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তখন আবু বকর রা:-এর মন থেকে জাহেলি সমাজের প্রচলিত ভুল ধারণায় যে খটকা তৈরি হয়েছিল তা দূর হয়ে গেল। এরপর হজরত আয়েশার সাথে আল্লাহর রাসূল সা:-এর বিয়ে সম্পন্ন হলো। প্রসিদ্ধ মতানুসারে বিয়ের সময় হজরত আয়েশা রা:-এর বয়স ছিল ৬ বছর। আর তিনি রাসূল সা:-এর সাথে সংসার শুরু করেন ৯ বছর বয়স থেকে। ইমাম বুখারী রহ: এই মতটি তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আরেকটি মতে- যখন আয়েশা রা:-এর বিবাহ হয়, তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর।

হজরত আয়েশা রা:-কে রাসূল সা: বিয়ে করার কারণে বেশ কিছু উপকার লাভ হয়। এই বিয়ের মাধ্যমে প্রথমে তো জাহেলি সমাজের এই রেওয়াজ দূর হয়ে গেল যে, মুখে বলা ভাই আপন ভাইয়ের মতো এবং একইসাথে ওই ভাইয়ের মেয়েকেও বিয়ে করা যাবে না। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা: নিজে আয়েশা রা:-কে বিয়ে করার মাধ্যমে ওই জাহেলি কুসংস্কার রহিত করে দিলেন। যদি তিনি বিষয়টি মুখে বলে নিষিদ্ধ করতেন, তাহলে এমনও হতে পারত যে, খুব সহজে পাতানো ভাই ও ভাতিজির সম্পর্ক সমাজ থেকে নির্মূল হতো না। কিন্তু তিনি নিজে যখন মুখে বলা ভাই আবু বকর রা:-এর মেয়ে আয়েশা রা:-কে বিয়ে করলেন, তখন চিরদিনের জন্য জাহেলি সমাজের প্রাচীন এই রীতি বাতিল হয়ে গেল।

মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত আয়েশা রা:-কে প্রচুর মেধা দান করেছিলেন। ৩৫০ জন সাহাবি ও তাবেঈন তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং তাদের থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ২/১৩৯) সাতজন বিশেষ সাহবি রয়েছেন যাদের হাদিস বর্ণনাকে ‘মুকাচ্ছিরিন’ আখ্যায়িত করা হয়। যারা রাসূল সা: থেকে এক হাজার কিংবা তারও বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে ছয়জন তো পুরুষ সাহাবি, বাকি একজন নারী। তিনি হলেন-হজরত আয়েশা বিনতে আবু বকর রা:।

ফতোয়ার ক্ষেত্রেও আয়েশা রা:-এর দখল ছিল উঁচুতে। সাহাবাযুগে তাকেও ওইসব আহলে ফতোয়া সাহাবিদের মধ্যে গণনা করা হতো, যারা অধিক পরিমাণে ফতোয়া দিয়েছেন। ইতোমধ্যে হজরত আয়েশা রা:-এর ফতোয়া সম্বলিত ৭৬৭ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘মাওছুয়ায়ে ফিকহে আয়েশা’। এর মাধ্যমে ফিকহ ও ফতোয়ার অঙ্গনেও তার অসামান্য খেদমত আন্দাজ করা যায়।

আরবিতে ‘ইসতিদরাক’ একটি পরিভাষা। কোনো ব্যক্তির উক্তি কিংবা তার লেখায় যদি কোনো ভুল অথবা ভুলবুঝ পরিলক্ষিত হয়, তাহলে পরিভাষায় তাকে ‘ইসতিদরাক’ বলে। হজরত আয়েশা রা: আকাবিরে সাহাবা ও বড় বড় সাহাবির ইসতিদরাক করেছেন। আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়ুতি রহ: হজরত আয়েশা রা:-এর সব ইসতিদরাক জমা করে ‘আইনুস সাহাবাতি ফি-ইসতিদরাকি আয়েশা আলাস সাহাবাহ’ নামে একটি সংকলন তৈরি করেছেন। আহলে ইলম তথা ইসলামী পণ্ডিতরা সামগ্রিকভাবে ওইসব ইসতিদরাকের মধ্যে হজরত আয়েশা রা:-এর দৃষ্টিভঙ্গিকে অধিক বিশুদ্ধ আখ্যা দিয়েছেন।

হজরত আয়েশা রা:-এর মতো অধিক মেধাবী নারী হজরত রাসূল সা:-এর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে নারী ও পারিবারিক জীবন বিষয়ক নানা সমস্যার সমাধান তার বর্ণনার মাধ্যমে হয়েছে। এজন্য উম্মাহ আল্লাহর রাসূল সা: থেকে যেসব ইলমি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপকারিতা অর্জন করেছে, তা হজরত আয়েশা রা: ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা হওয়া সম্ভব ছিল না। রাসূল সা:-এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা রা: ৪৭ বছর জীবিত ছিলেন। দীর্ঘ এই সময়ে তিনি তার হেদায়েত-পরিশুদ্ধি, তালীম-তারবিয়াত ও শিষ্টাচার শিক্ষাদান অব্যাহত রাখেন।

প্রচলিত আছে যে, ২০ বছর অন্তর প্রজন্ম পরিবর্তিত হয়। সেই হিসেবে আল্লাহর রাসূলের ইন্তেকালের পর অন্তত দুইটি প্রজন্ম আয়েশা রা:-এর জ্ঞান-গরিমা, ইলম ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। আর এসবই এজন্যই সম্ভব হয়েছে যে, তিনি স্বল্প বয়সে মহানবী সা:-এর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

এগুলোর সাথে সাথে এ উপকারও হয়েছে যে, এই বিবাহের মাধ্যমে রাসূল সা: তাঁর সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী হজরত আবু বকর রা: ও তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করেছেন। চার খলিফা-ই আল্লাহর রাসূল সা:-কে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। তাদের মধ্যে দুজন হজরত আবু বকর ও ওমর রা:-এর দুই মেয়েকে বিবাহ করে তাদেরকে আলাদা মর্যাদায় উন্নীত করেছেন মহানবী সা:। আর বাকি দুজন হজরত উসমান ও আলী রা:-এর সম্মান উঁচু করেছেন তাদের উভয়ের সাথে নিজের মেয়েদের বিবাহ দিয়ে এবং এভাবেই আল্লাহর রাসূল সা: স্বীয় চার বন্ধুর আত্মত্যাগ ও কুরবানির পুরস্কার দিয়েছেন আন্তরিকতার সাথে।

মহানবী সা: হজরত আবু বকর রা:-কে অনেক সম্মান দান করেছেন। কিন্তু হজরত আয়েশা রা:-কে বিবাহের মাধ্যমে আবু বকর রা:-এর পরিবারের যে সম্মান ও সৌভাগ্য অর্জিত হয়েছে, তা আর কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য মেয়েকে অল্প বয়সে রাসূল সা:-এর সাথে বিয়ে দিয়ে না কখনো আবু বকর রা: আফসোস করেছেন বা অনুতপ্ত হয়েছেন আর না তার মেয়ে আম্মাজান আয়েশা রা:। বরং তারা এটিকে নিজেদের ইজ্জত ও গর্বের মাধ্যম মনে করতেন।

একবার মহানবী সা: তাঁর পবিত্রা স্ত্রীদের এ ব্যাপারে স্বাধীনতা দিলেন যে, তারা আল্লাহর রাসূল সা:-এর সাথে বহুত ধৈর্য ও কষ্টের সাথে জীবন অতিবাহিত করেন-এজন্য যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে যার যার অধিকার ও প্রাপ্য নিয়ে তারা আলাদা হয়ে যেতে পারবেন। তখন সর্বপ্রথম এই স্বাধীনতার বিরোধিতা করেন হজরত আয়েশা রা: এবং বলেন, সর্বাবস্থায় আপনার সাথেই থাকব। বিবাহ-সম্পর্ক স্থাপিত হয় স্ত্রীর সাথে। যখন স্ত্রীই স্বয়ং ওই সম্পর্ককে সৌভাগ্যের মাধ্যম মনে করেন এবং তা নিয়ে রীতিমতো গর্ব করেন, তখন এ বিষয়ে কিভাবে কারো প্রশ্ন তোলার অধিকার থাকে?

বিয়েতে কম বয়স নিয়ে আলোচনা হচ্ছে-এর সম্পর্ক মূলত সামাজিক রীতিনীতি, আবহাওয়া ও খাদ্যের সাথে। এজন্যই বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। আরবে অল্প বয়সী মেয়েদের বিবাহ দেয়ার প্রচলন ছিল। নবুওয়তের যুগে ও নবুওত পরবর্তীকালেও এই রেওয়াজ চালু ছিল- তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন ১০ বছরেরও কম বয়সে অনেক মেয়েদের বিবাহ দেয়া হতো এবং খুব কম সময়ে মা-ও হয়ে যেত তারা। যখন হজরত খাউলা রা: আবু বকর রা:-এর কাছে আয়েশা রা:-এর বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, তখন তিনি ‘পাতানো ভাই’য়ের আপত্তি উত্থাপন করলেন, বয়সের পার্থক্যের বিষয়টি প্রকাশ করেননি; এমনকি তা চিন্তাও করেননি তিনি। তাছাড়া হেজাজের আবহাওয়া ছিল উষ্ণ। সেই সময়ে সেখানকার প্রধান খাদ্য ছিল খেজুর ও উটনীর দুধ। এতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি। এজন্য হেজাজের অবস্থার সাথে উপমহাদেশের অবস্থা পরিমাপ করা যুক্তিযুক্ত নয়।

এছাড়া এদিকটাও লক্ষ্যণীয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মেও কম বয়সে বিবাহরীতির প্রচলন রয়েছে। মুসলিমদের বিশ্বাস মতে- হজরত মারইয়াম আ: কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। অলৌকিকভাবে তিনি হজরত ঈসা আ:-কে জন্মদান করেন। তবে খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাস হলো- জোসেফ নামে এক ব্যক্তির সাথে মারইয়াম আ:-এর বিবাহ হয়েছিল। বিয়ের সময় জোসেফের বয়স ছিল ৯৯ বছর আর মারইয়ামের মাত্র ১২। ১৯৮৩ সালে ক্যাথলিক ক্যানানাইটরা তাদের পুরোহিতদের ১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে করার অনুমোদন দেন। ১৯২৯ সালের আগে ব্রিটেনের চার্চ অব ইংল্যান্ডও ১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের অনুমতি দিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার অঙ্গরাজ্যে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মেয়েদেরে সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স ৮ বছর ও ক্যালিফোর্নিয়ায় ১০ বছর নির্ধারিত ছিল। এমনকি এমন কথাও বলা হয় যে, দেশটির আরো কিছু রাজ্যে মেয়েদের বিয়ের বয়স আরো কম। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি রাজ্য ম্যাসাচুসেটস। এখানেও মেয়দের বিয়ের বয়স ১২ বছর ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে ১৩ বছর নির্ধারিত।

আর হিন্দু ধর্মের দিকে যদি দৃষ্টিপাত করা যায়, তাহলে দেখা যায়- এটি বাল্যবিবাহের প্রতি উৎসাহিত করে। মনুসংহিতায় উল্লেখ রয়েছে- মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়া উচিৎ। (গৌতম : ১৫...২১) এবং বাবার কর্তব্য হলো- মেয়ে পোশাকহীন চলাফেরার সময়-ই তাকে বিবাহ দেয়া। আর যদি মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও ঘরেই থেকে যায়, তাহলে তার পাপ বাবার ওপর পতিত হবে। (many ix, 88,htpp:/www.payer.de.dharamshastra/dharmash083 htm) মনুসংহিতায় স্বামী-স্ত্রীর পৃথক বিয়ের বয়স উল্লেখ আছে, তাতে বলা হয়েছে- স্বামীর বয়স হবে ৩০ আর স্ত্রীর ১২ বছর অথবা স্বামীর ২৪ বছর ও স্ত্রীর ৮। মহাভারতে বিয়েশাদীর ব্যাপারে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তাতে মেয়ের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৮ ও ১০ বছর। আর শ্লোকে বিয়ের বয়স সর্বনিম্ন ৪ থেকে ৬ বছর ও সর্বোচ্চ ৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।

বর্তমান স্বদেশীয় ভাইয়েরা ‘রামজী’কে আদর্শ জ্ঞান করেন। রামায়ন থেকে প্রতিভাত হয়, রাম ও সিতার বিয়ের সময় সিতার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। (রামায়ন, আদি কাণ্ড, স্বর্গ : ৪৭, শ্লোক : ১১,৪,১০)

সারকথা হলো- অল্প বয়সে মেয়ের বিবাহ ও স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি, সামাজিক প্রথা, আবহাওয়া, শারিরীক সক্ষমতা ও প্রাপ্তবয়স্কতার সাথে সম্পর্কিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ সমাজে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে চলেছে। অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে শুধু কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার অনুমতিই দেয়া হয়নি; বরং তা পরিপালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষত হিন্দু সমাজে এটি অধিক প্রচলিত একটি ব্যাপার এবং ধর্মের পবিত্রাত্মাদের বেশিরভাগই অল্প বয়সে বিয়ে সেরেছেন।

-ভারতের প্রখ্যাত আলেম অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ইসলামী ফিকহ একাডেমি, ভারতের সাধারণ সম্পাদক মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানীর কলাম থেকে অনুদিত