Naya Diganta

প্রেসক্লাব চত্বরে কেন গায়ে আগুন দিলেন ব্যবসায়ী?

গাজী আনিস

ঢাকার প্রেসক্লাব চত্বরে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন এক ব্যবসায়ী। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলেও মঙ্গলবার সকালে তার মৃত্যু হয়।

সোমবার প্রেসক্লাবের সামনের খোলা চত্বরে হঠাৎ করেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন ওই ব্যবসায়ী। তান নাম মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ওরফে গাজী আনিস (৫০)।

অনেকেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছেন।

এমন একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হাত পা ছড়িয়ে নিথর পড়ে আছেন। তার সারা শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এসময় আশেপাশে লোকজন ছুটে গিয়ে তার গায়ে পানি ঢেলে আগুন নেভান। যদিও ততক্ষণে তার শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়।

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে, পরিধেয় কাপড় পুড়ে গিয়ে উলঙ্গপ্রায় হয়ে আছেন তিনি।

এরপর তাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার ভোরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

তার দেহের ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ইন্সটিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।

কেন গায়ে আগুন দিয়েছেন?

গাজী আনিসের একজন বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক এবং তার স্ত্রীর সাথে ২০১৬ সালে তার পরিচয় হয়েছিল। এরপর তাদের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তারা এক সঙ্গে ভারতে একাধিক ট্যুরেও গিয়েছিলেন।

সেই সম্পর্কের খাতিরে ব্যবসা করার জন্য এক কোটি ২৬ লাখ টাকা নিয়েছিলেন ফাতেমা আমিন।

প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা করে দেয়ার কথা ছিল। দুই বছর পর একবারে তিন কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল।

দুই তিনমাস ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েছিলেন। এরপর তারা সেটা বন্ধ করে দেন, বিবিসিকে বলছিলেন তৌহিদুল ইসলাম।

তিনি জানান, বড় ভাইয়ের এলপিআরের টাকা, বন্ধু এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার দেনা করে এসব টাকা নিয়েছিলেন গাজী আনিস। লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা এনেছিলেন। তারাও টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।

সেই টাকা উদ্ধারের জন্য তিনি ঢাকায় একাধিক সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সম্প্রতি। নানাজনের কাছে ধর্না দিয়েছিলেন।

অনেক চেষ্টার পর ৭৭ লাখ টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু লভ্যাংশসহ বাকি টাকা ফেরত পাননি।

আনিসুর রহমানের ভাই নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তার ভাই প্রথমে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে সেটা ছেড়ে হেনোলাক্সের মালিকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর সোমবার নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

ফেসবুক স্ট্যাটাস

গাজী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালির পান্টি গ্রামে। তিনি ১৯৯৩ সালে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন।

তার প্রকাশিত কয়েকটি বইও রয়েছে।

তার ফেসবুক ঘেঁটে অনেক কবিতা ও ছবি সম্বলিত পোস্ট দেখা গেছে। সেসব কবিতায় তার হতাশার বিষয়টি পরিষ্কার বেরিয়ে এসেছে।

গত ৩১ মে ফেসবুকে সর্বশেষ তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দুই হাজার আঠার সালে কলকাতা হোটেল বালাজীতে একইসাথে অবস্থানকালে উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরো ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে নেয়া)।

বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে।

বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন।

এক পর্যায়ে উনারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন এবং কয়েকবার উনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্তা ব্ল্যাক মেইল করেন এবং করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশ'সহ আমার ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার অধিক।’

তৌহিদুল ইসলাম বলছেন, গাজী আমিনের এসব লেনদেনের কোনো ব্যাংক ডকুমেন্ট ছিল না। সরল বিশ্বাসের ভিত্তিতে টাকা দিয়েছিলেন।

এসব ঘটনায় কুষ্টিয়ার আদালতে হেনোলাক্সের মালিক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলাও করেছিলেন গাজী আনিস।

এর একটি চেক ডিজঅনার এবং আরেকটি হুমকি দেয়ার অভিযোগ।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক এবং তার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিবিসি।

তাদের দু’জনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনেই যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তাদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করেছে বিবিসি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।

এই আত্মহত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত শাহবাগ থানায় কোনো মামলা বা সাধারণ ডায়রি হয়নি।

মামলা হলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সূত্র : বিবিসি