Naya Diganta
চলতে ফিরতে দেখা

এ কেমন ঘাতক মনোবৃত্তি

চলতে ফিরতে দেখা

দেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল গত দুই সপ্তাহ ধরে বন্যার পানিতে ডুবে আছে। কোথাও কোথাও পানি কিছুটা কমলেও উজানের ঢল ও বৃষ্টিতে তা আবার তলিয়ে গেছে। এখন দরকার ত্রাণ, শুকনো খাবার কিংবা রান্না করা খাবার ও সুপেয় পানি। সরকারের তরফ থেকে ত্রাণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। মন্ত্রী-এমপিরা তো কাপড় ভিজিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে যেতে পারেননি। ফলে তাদের বন্যার্ত এলাকায় দেখা যায়নি। কেউ প্রশ্নও করেনি। আসলে এসব তথাকথিত জনপ্রতিনিধির জনগণের প্রতি কোনো দায় নেই। কারণ তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। প্রশাসন তাদের নানা চালবাজির মতোই সরকারি নির্দেশে নির্বাচিত ঘোষণা করে দিয়েছে। ফলে জনগণ নয়, প্রশাসন তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলাকার মানুষ যদি বলে পানিতে ডুবে মরলাম, দিনের পর দিন না খেয়ে আছি, ত্রাণ চাই। তখন প্রশাসন বলে এগুলো ওদের ভড়ং। তারা প্রচুর ত্রাণ পেয়েছে। গরিব মানুষ, বোঝেন না? আরো ত্রাণ জমাতে চায়। কেউ কেউ ত্রাণ দু’বার তিনবারও পেয়েছে। তখন তথাকথিত জনপ্রতিনিধি প্রশাসনের কথায় সায় দেন। তাই তো! এতদিন ধরে বন্যা হচ্ছে, সরকার কি কোনো ত্রাণ দিচ্ছে না? ছোটলোকদের চেয়ে খাবার এই বদস্বভাব এখনো গেল না। সে কারণে তারা কেবল চাইতেই থাকে। এখন এমন হয়েছে, নৌকা দেখলেই সাধারণ মানুষ ঘটিবাটি থালা-বাসন নিয়ে গলা পানিতে এসে দাঁড়ায়। হোক সে নৌকা ত্রাণের কিংবা টিভি ক্রুদের কিংবা পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়েছেন এমন তরুণ-তরুণীদের।
আমরা আগেও বেলছি, দুর্গত এলাকার মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না। প্রত্যন্ত এলাকায় তো নয়ই। ত্রাণ বিতরণকারীরা প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছাতেই পারেননি। তার আগেই এগিয়ে আসে শত শত মানুষ। ত্রাণ চায়, সুপেয় পানি চায়। এ অভাব শুধু মানুষেরই নয়, তাদের পোষা গবাদিপশুর জন্যও। গ্রামাঞ্চলের মানুষ পোষা প্রাণীকে সন্তানসম স্নেহ করে। এ নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প আছে ‘মহেষ’। সুতরাং, নিজেদের পাশাপাশি পশুদের আশ্রয় ও খাদ্যের কথা তাদের ভাবতে হয়। কিন্তু তার কোনো কিছুই নেই।
বন্যাদুর্গত এলাকায় এমনি একটা পরিস্থিতি চলছে। যেন আমরা এ পর্যন্ত যা দেখতে পাচ্ছি, তা হলো বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো আর জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো। এ ছাড়াও মসজিদে, মসজিদে চাঁদা তুলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তাদের কোনো দল নেই। কিন্তু সেটি ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনগুলোর। তারা ত্রাণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এমন কোনো খবর নেই। কিন্তু ভিন্ন খবর আছে। ফেনী ফুলগাজীর দৌলতপুর গ্রামে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ দেয়ার কর্মসূচি ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির; কিন্তু তাদের অভিযোগ, শনিবার সকাল থেকে ফুলগাজী যাওয়ার পথে কয়েক স্থানে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ব্যারিকেড বসিয়েছে। সে কারণে দৌলতপুর পৌঁছাতে পারেননি বিএনপির ত্রাণকর্মীরা।


এই সুখবরটার সাথে যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা যেকোনো হৃদয়বান মানুষের বুকে ঘা দেবে। সড়কের মাঝখানে টেবিল, দু’দিকে চেয়ার পেতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে আছে ছাত্রলীগ, যুবলীগের লড়াকু কর্মীরা। তাদের সাথে লাঠিসোটা, দা বল্লম বা অন্য কোনো দেশীয় কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র আছে কি না দেখা যাচ্ছে না। এগুলো তো ছাত্রলীগ, যুবলীগের নিত্যসঙ্গী। বিএনপির লোকেরা গিয়েছিল ত্রাণ দিতে, যুদ্ধ করতে নয়। ফলে তারা এই সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি হতে চাননি। বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মজনু জানান, ফেনী মহিপাল ফ্লাইওভারের কাছে তাদের বহর থামিয়ে দেয়। পুলিশ জানায়, ফুলগাজীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সুতরাং, বিএনপির ত্রাণ দল যেন ঢাকায় ফেরত যায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয় নেতাদের সাথে পরামর্শ করে ফুলগাজী না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আরত্রাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য জেলা বিএনপি নেতাদের হাতে তুলে দেন।
এ দিকে দৌলতপুরসহ প্রতিটি গ্রামে বিএনপি নেতাদের বাড়িতে শুক্রবার রাতে যুবলীগ ছাত্রলীগ কর্মীরা অভিযান চালায়। বিষয়টি জানতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নাম্বারে ফোন করে তাদের পাওয়া যায়নি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ স্বীকারই করতে চায় না যে, দেশে বন্যা হয়েছে। মানুষ কষ্ট করছে এটা বললেই, পদ্মা সেতুর নামে যে রকম ঢাক-ঢোল পেটানো হয়েছে সেটি ম্লান হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়ে ঘোরেন কিন্তু কোনো দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় যাননি। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই ফুলগাজীতে যাইনি।
বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ বিতরণ একটি মানবিক কাজ। ১৯৭৪ সালে বন্যার সময় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে মিরপুর এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও কলেরার ইঞ্জেকশন দেয়ার কাজ দলবেঁধে করেছি। তখন ছাত্রলীগ ছাত্র-ইউনিয়ন ভেদাভেদ ছিল না। কত বেশি লোকের কাছে ত্রাণ ও ইঞ্জেকশন পৌঁছে দেয়া যায় সেটিই ছিল আমাদের লক্ষ্য। কেউ বাধা দেয়নি।
বিএনপির ত্রাণ বিতরণে ছাত্রলীগ কেন বাধা দিলো? পুলিশ কেন ১৪৪ ধারা জারি করল? ত্রাণ বিতরণে বাধা দেয়ায় পুলিশ কেন লাঠিচার্জ করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সরিয়ে দিলো না, সে প্রশ্ন সর্বত্র। আমরা তো বলতে চাই যে, সরকারদলীয় লোকেরাই ছাত্রলীগ-যুবলীগকে লেলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কী এর উদ্দেশ্য? আওয়ামী লীগ সম্ভবত ভেবেছে দুর্গত এলাকায় তারা তো যাচ্ছে না, কিন্তু বিএনপি যদি যায় তবে বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে। জনপ্রিয়তা বাড়বে কী কমে যাবে সেটি তো ইস্যু নয়, ইস্যু হলো দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান, অনাহারী মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। আর বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়লে ছাত্রলীগ যুবলীগের কী ক্ষতি? কারণ বাংলাদেশে অনেক দিন সুষ্ঠু কোনো নির্বাচন হচ্ছে না, যেটা হচ্ছে সেটি ভোট ডাকাতি। এ ব্যবস্থায় মানুষের তো কোনোই ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। তাহলে উনিশ-বিশ কী হলো? এ পর্যন্ত যা বোঝা গেল, তাতে দেখা যাচ্ছে বিএনপি যত ভোটই পাক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবেই। তাহলে নিরন্ন মানুষের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নিতান্তই পৈশাচিকতা। আর পুলিশ ত্রাণ গমনের পথে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রমাণ করল যে, আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনতে তারা তৈরি।
এ রকম ব্যবস্থার ফলে অনাহারী মানুষ ত্রাণ বিতরণকারীদের প্রতিরোধের জন্য তাদের শুধু ঘৃণাই করবে আর অভিসম্পাত দিতে থাকবে। হে আল্লাহ, তুমি এসব বিপন্ন মানুষকে রক্ষার বন্দোবস্ত করো।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com