Naya Diganta
মংলা চ্যানেলের ইনার বার ড্রেজিং

ঠিকাদার নির্বাচন ও জমি হুকুমদখল বিলম্বে প্রকল্পের ধীরগতি

মংলা চ্যানেলের ইনার বার ড্রেজিং

নির্ধারিত আড়াই বছরেও শেষ হচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ মংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারের ড্রেজিং কার্যক্রম। যথাসময়ে শেষ করতে না পারার কারণে এখন খরচ বাড়ছে ৩১ শতাংশ বা প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা। আর ঠিকাদার নিয়োগে সাত মাস, জমি হুকুমদখলে ছয় মাস বিলম্ব এবং জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানে দেরি হওয়াতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চলছে ধীরগতি। ফলে দুই বছর দুই মাসে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মূলত ৩৫ শতাংশ। বিলম্ব হওয়ার কারণে প্রতি লাখ ঘন মিটার ড্রেজিংয়ে এখন খরচ ৪৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৩৩ লাখ ঘন মিটারের বেশি ড্রেজিংয়ের স্থলে প্রকৃত কাজ হয়েছে মাত্র ২৭.২৮ লাখ ঘন মিটার ড্রেজিং। মংলা বন্দরের তথ্য থেকে এসব জানা গেছে। অন্য দিকে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রথমপর্যায়ের ড্রেজিং কাজই শেষ হয়নি, এর সাথে নতুন করে কাজ যুক্ত হয়েছে। ফলে এক বছরের মধ্যে এসব কাজ সমাপ্ত হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দেয়া সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩১ কিলোমিটার উজানে পশুর নদীর পূর্ব তীরে মংলা বন্দর অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর থেকে চ্যানেলের প্রবেশমুখ যা আউটার বার নামে এবং হারবাড়িয়া থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত যা ইনার বার নামে পরিচিত। আউটার বার সম্প্রতি ড্রেজিং করায় মংলা বন্দরের হারবাড়িয়া অ্যাংকোরেজ এলাকা পর্যন্ত ৯.৫ থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারছে। হারবাড়িয়া অ্যাংকোরেজ থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩.৪ কিলোমিটার নদীতে নাব্যতা পাঁচ-ছয় মিটার। ইনার বারে ৮.৫০ মিটার সিডি (চার্ট ডেটাম) গভীরতায় ড্রেজিং করা হলে মংলা বন্দরের জেটিতে স্বাভাবিক জোয়ারের সহায়তায় সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটারের অধিক ড্রাফটের জাহাজ নির্বিঘেœ হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরেও সর্বোচ্চ ৯.৫০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডেল করা হচ্ছে। সে বিবেচনায় পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং করা হলে মংলা বন্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি কার্যকর বিকল্প বন্দরে পরিণত করা সম্ভব হবে।
মংলা বন্দরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত নানাবিধ উদ্যোগের মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ, খুলনা-মংলা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন, খানজাহাজন আলী বিমানবন্দর নির্মাণ, মংলা বন্দরের সন্নিকটে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, বন্দর এলাকায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ইপিজেড সম্প্রসারণসহ নানা প্রকল্প প্রহণ করা হয়েছে। আশা করি ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে উল্লিখিত প্রকল্পের কার্যক্রমের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হবে এবং মংলা বন্দরের চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ফলে মংলা বন্দরের সম্ভাব্য বর্ধিত চাহিদা সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা ও বন্দর এলাকায় ১০ মিটারের অধিক ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং প্রকল্পটি ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের আওতায় মূল কাজ হলো, ৭৯৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১৬.০৯ লাখ ঘন মিটার ড্রেজিং করা। প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ করার জন্য নির্ধারিত ছিল। ড্রেজিং কাজটি সম্পন্ন হলে মংলা বন্দরের জেটিতে ৯.৫ থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ।
জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত জমিগুলো দুই বছরের জন্য ড্রেজিং মাটি ফেলতে ব্যবহৃত হবে। এই দুই বছরের জন্য নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। জমির ব্যবহার শেষে জমির মূল মালিকরা তাদের মালিকানা ফেরত পাবেন। পশুর নদী সুন্দরবন বেষ্টিত হওয়ায় এবং সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হওয়ায় ড্রেজিং মাটি কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবনের মধ্যে ফেলা যাবে না। তাই বৃহত্তর জনস্বার্থে অনিবার্য কারণে ড্রেজিং মাটি সুন্দরবনের বাইরে পশুর নদীর তীরবর্তী জমিগুলোয় ফেলতে হচ্ছে। পশুর নদীর মাটি পলি মিশ্রিত হওয়ায় ড্রেজিং মাটি ফেলার পর সেখানে ফসলের উৎপাদনশীলতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া এই জমির মধ্যে কোনো বসতি না থাকায় কোনো পরিবার বাস্তুহারা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিলম্ব হওয়ার কারণ তুলে ধরে মংলা বন্দর এই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি অনুমোদনের পর ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। সাত মাস পর ঠিকাদার নির্বাচন করে আগস্টে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলতে এক হাজার একর জমি হুকুমদখলের জন্য নির্ধারিত ছিল। সাত শ’ দশমিক ৫ একর জমি হুকুম দখলের জন্য বাগেরহাট জেলা প্রশাসককে ২০২১ সালের ৯ মার্চ রিকইজিশনের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। চার মাস পর ডিসি প্রস্তাবটি ২০২১ সালের ১৮ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। হুকুমদখলের অনুমোদন মন্ত্রণালয় থেকে পেতে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এক মাস পর ১৬ সেপ্টেম্বর ডিসি অফিস থেকে হুকুমদখলের আদেশ জারি করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর জমি হস্তান্তর করা হয়। এই কাজে ছয় মাস বিলম্ব হয়। এই কারণে ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। অন্য দিকে হুকুমদখলের টাকা জেলা প্রশাসক থেকে জমির মালিকদের পরিশোধেও বিলম্বিত হয়। যার কারণে ড্রেজিং কাজেও বিলম্ব হয়।
মূল প্রকল্পে সাড়ে ৮ মিটার সিডি গভীরতা অর্জনের জন্য কাটার সাকশান ড্রেজার এবং ট্রেলিং সাকশান হপার ড্রেজার দিয়ে মোট ২১৬ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করার কথা। বিলম্ব হওয়ার কারণে জমির হুকুমদখলের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে এ খাতে ব্যয় বাড়বে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এ খাতে ব্যয় বাড়বে। ফলে প্রকল্পের মূল ব্যয় ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ৩৯ কোটি ৩০ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: মামুন আল রশীদের সাথে গতকাল মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, প্রকল্পটি প্রথমে অনুমোদনের সময় যে পরিমাণ ড্রেজিংয়ের কথা ছিল, এখন তা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে তারা। তাহলে আগে কী সমীক্ষা করল, কী হিসাব তারা করল? এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব। আর প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি অনুযায়ী এক বছরে বাকি কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব নয়।