Naya Diganta

যেসব আয়াতে সাজানো পবিত্র কাবাগৃহ

কাবার গিলাফের প্রধান ক্যালিওগ্রাফার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুখতার আলম শিকদার।

মক্কা মুকাররমার কাবা শরিফ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর পবিত্র কিবলা। দৈনিক অন্তত পাঁচবার এদিকে ফিরেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। কাবাগৃহের গিলাফ (কিসওয়াহ) সারা বছরই সোনার হরফে কুরআনের নানা আয়াতের ক্যালিওগ্রাফিতে সজ্জিত থাকে। ২০ বছর ধরে কাবার গিলাফের ক্যালিওগ্রাফির কাজ করছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুখতার আলম শিকদার। তিনিই গিলাফের প্রধান ক্যালিওগ্রাফার। গিলাফের চারদিকের দেয়ালগুলোর কোনটিতে কোন আয়াত লেখা হয়েছে-সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি তা জানালেন। আয়াতগুলোর বাংলা অনুবাদ ও কোনটি কোথায় লিপিবদ্ধ আছে তা তুলে ধরা হলো—

বাবে মুলতাজাম
বাবে মুলতাজাম পবিত্র কাবাগৃহের একটি অন্যতম নিদর্শন। এটির অবস্থান গৃহের পূর্ব দিকের দেয়ালের হাজরে আসওয়াদ এবং কাবার দরজার মধ্যখানে। কেউ কেউ বলেন, পুরো পূব দেয়ালটাই মুলতাজাম। এখানে সূরা বাকারার ১২৫, ১২৭ ও ১২৮ নম্বর আয়াত লিপিবদ্ধ আছে।

আয়াতগুলোর অর্থ— ‘এবং স্মরণ কর, যখন আমি কাবাগৃহকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র এবং নিরাপদস্থল করলাম এবং বললাম, মাকামে ইবরাহিমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো এবং ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে বলেছিলাম, আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী এবং রুকু ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখবে।’

‘আর (স্মরণ কর) যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের ভিত্তি তুলছিল, তখন প্রার্থনা করলো, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।’

‘হে আমাদের প্রতিপালক! ‘আমাদেরকে তোমার অনুগত করো। আমাদের সন্তানদের থেকে এমন একদল সৃষ্টি করো, যারা তোমার আজ্ঞাবহ হয় আর আমাদেরকে ইবাদাতের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দাও এবং আমাদের অপরাধ ক্ষমা করো, নিশ্চয়ই তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

হাজরে ইসমাঈল আ:
এটির অবস্থান কাবাগৃহের উত্তরে। অর্ধ-বৃত্তাকার নিদর্শনটিকে হাতিমে কাবাও বলা হয়। যদিও এটি কাবার বহিরাংশ। তবে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত—এর মধ্যে নামাজ আদায়ে কাবার অভ্যন্তরে নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। এদিকটায় সূরা বাকারার ১৮৬, ১৯৭, ১৯৮ এবং সূরা হিজরের ৪৯ নম্বর আয়াতের ক্যালিওগ্রাফি করা হয়েছে।

আয়াতগুলোর অর্থ— ‘আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে।’

‘হজ হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট মাসে, অতপর এ মাসগুলোতে যে কেউ হজ করার মনস্থ করবে, তার জন্য হজের মধ্যে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয় এবং তোমরা যে কোন সৎ কাজই কর, আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা করবে আর তাকওয়াই (আল্লাহভীতি) শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে জ্ঞানী সমাজ! আমাকেই ভয় করতে থাক।’

‘তোমাদের প্রতি কোনো গুনাহ নেই, যদি তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ খোঁজ করো এবং যখন তোমরা আরাফাত হতে ফিরবে তখন মাশআরুল হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তাঁকে স্মরণ করবে যেরূপ তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, বস্তুত তোমরা এর আগে ছিলে পথভ্রষ্টদের অন্তর্গত।’

‘তারপর তোমরা ফিরে আসবে যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’

বাবে ইবরাহিম
এদিকটায় সূরা হজের ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ সূরা আহজাবের ৪৭ এবং সূরা নিসার ১১০ নম্বর আয়াত লেখা রয়েছে।

অর্থ-‘ স্মরণ করো, যখন আমি ইবরাহিমকে (পবিত্র) গৃহের স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছিলাম, (তখন বলেছিলাম) আমার সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার গণ্য করবে না। আর আমার গৃহকে পবিত্র রাখবে তাওয়াফকারী, নামাজে কিয়ামকারী, রুকুকারী ও সেজদাকারীদের জন্য।’

‘আর মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব (পথক্লান্ত) শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূরের গভীর পর্বতসংকুল পথ বেয়ে।’

‘যাতে তারা তাদের জন্য (এখানে রাখা দুনিয়া ও আখিরাতের) কল্যাণগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারে আর তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দান করেছেন, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। কাজেই তোমরা (নিজেরা) তা থেকে খাও আর দুঃস্থ অভাবীদের খাওয়াও।’

‘অতপর তারা যেন তাদের দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মান্নত পূর্ণ করে আর প্রাচীন গৃহের (কাবা শরিফ) তাওয়াফ করে।’

‘তুমি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য আল্লাহর নিকট আছে বিশাল অনুগ্রহ।’

‘যে গোনাহ, করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’

বাইনার রুকনাইন তথা দুই রুকনের (রুকনে হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানি) মধ্যবর্তী স্থান
একাধিক হাদিসে এসেছে, এখানেও দোয়া কবুল হয়। এদিকটায় সূরা আলে ইমরানের ৯৫, ৯৬, ৯৭, সূরা হজের ৩২ এবং সূরা ত্বহার ৮২ নম্বর আয়াত লিপিবদ্ধ আছে।

অর্থ-‘ বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন, সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠভাবে ইবরাহিমের অনুসরণ করো, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’

‘নিঃসন্দেহে প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, তা তো মক্কায়, যা বরকতমণ্ডিত এবং সারা জাহানের জন্য পথপ্রদর্শক।’

‘তাতে সুস্পষ্ট নিদর্শনবলী রয়েছে (যেমন) মাকামে ইবরাহিম (ইবরাহিম আ:-এর দাঁড়ানোর জায়গা)। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে নিরাপদ হবে। আল্লাহর জন্য উক্ত ঘরের হজ করা লোকদের ওপর আবশ্যক যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে এবং যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, (সে জেনে রাখুক) নিঃসন্দেহে আল্লাহ বিশ্ব জাহানের মুখাপেক্ষী নন।’

‘এই (তার অবস্থা), আর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।’

‘আর যে তওবাহ করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার জন্য অবশ্যই অতি ক্ষমাশীল।’

এ ছাড়াও কাবা গৃহের প্রতিটি কোণা সুরা ইখলাসের মনকাড়া বৃত্তাকার ক্যালিওগ্রাফিতে সজ্জিত। একইসাথে গাণিতিক দূরত্বে আল্লাহর বিভিন্ন গুণবাচক নামের ক্যালিওগ্রাফি তো আছেই।

কাবা শরিফের দরজায় যা লেখা
কাবা শরিফের দরজা মোবারকেও কুরআনের নানা আয়াতের ক্যালিওগ্রাফি রয়েছে। এখানের শোভা বর্ধন করেছে সূরা ইখলাস, সূরা কুরাইশ, আয়াতুল কুরসি, সূরা বাকার ১৪৪, সূরা আলে ইমরানের ১৩৩ এবং সূরা ফাতহের ২৭ নম্বর আয়াত। সূরা নুরের ৩৫ নম্বর আয়াতটি একাধিকবার লেখা হয়েছে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সম্মানজ্ঞাপক বিভিন্ন আরবি বাক্যও লিপিবদ্ধ আছে এখানে।