Naya Diganta

প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর

প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর

করোনা মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় লক্ষ করা যায়, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা লাভের অপেক্ষায় থেকে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে, করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কে নিজেদের তরফে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেতনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর, প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়।

সংক্রামক অসংক্রামক ব্যাধিনিচয়ের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব সংস্থা জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ২০১১ সালে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে জাতীয় সরকারগুলো সংক্রামক-অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন, গ্রহণ ও প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতিপত্রে সবাই স্বাক্ষর করে আসে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে খসড়া নীতিমালা দাখিল হয়ে থাকলেও বিগত আট বছরেও অনুমোদনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি, প্রবর্তন দূরের কথা। আজ এ নীতিমালা অনুমোদিত হয়ে থাকলে করোনা প্রতিরোধে অন্ধকারে হাতড়ানোর প্রয়োজন হতো না। করোনায় চিকিৎসক হেলথ টেকনোলজিস্টদের এভাবে প্রাণ দিতে হতো না।

আজ থেকে প্রায় ১৩৫ বছর আগে মশহুর মার্কিন আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১) যথার্থ বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতের চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ না দিয়ে তাকে শেখাবেন শরীরের যত্ন নেয়া, সঠিক খাদ্য নির্বাচন, রোগের কারণ নির্ণয় ও তা প্রতিরোধের উপায়।’ গ্রামে উচ্চশিক্ষিত এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক যখন দুর্লভ, শহরে ও গ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাব্যবস্থা ও সেবা কার্যক্রম যখন ব্যবসায়িক মন-মানসিকতার হাতে বন্দী, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যের বেড়াজালে সাশ্রয়ী মূল্যে দেশীয় ওষুধ শিল্প উৎপাদন যখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন, চিকিৎসাসেবায় নীতি ও নৈতিকতা যখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তখন আমাদের নিজে নিজের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার শরণাপন্ন হওয়ার যৌক্তিকতা বেড়ে যায়। এডিসন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা আজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে শরীরের যত্ন, খাদ্য-অখাদ্য বিচার ও রোগ ঠেকানোর ব্যাপারে আমাদের আরো যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

সুস্থ ও সুন্দর জীবন বলতে আমরা প্রকৃতপক্ষে কী বুঝি? একজন মানুষ দৈহিকভাবে, মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং আত্মিকভাবে যদি ভালো থাকে বা ভালো বোধ করে তাহলে তাকে পরিপূর্ণ সুস্থ বলা যেতে পারে। তার জীবনযাপন সুন্দর, অর্থবহ, উপভোগ্য, সৃজনশীল, কর্ম উপযোগী হওয়ায় তাকে ব্যক্তিগতভাবে উপরোক্ত চারভাবে বা প্রকারে সুস্থ হওয়ার বা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেউ দৈহিক বা শারীরিকভাবে হয়তো সুঠাম, নীরোগ এবং সুস্থ কিন্তু মানসিক অবস্থা, পরার্থপরতা, নীতিনৈতিকতা, ন্যায়নীতিনির্ভরতা তথা সততার সাথে সামাজিক অবস্থান বা সুনাম বিতর্কিত বা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ালে এবং একই সাথে আধ্যাত্মিক বা আত্মিক অবস্থা ভালো না হলে ওই ব্যক্তিকে পুরোপুরি সুস্থ বা তার জীবন সুন্দর বলা যাবে না। আবার আধ্যাত্মিকতায় উন্নত, সামাজিকভাবে সুপরিচিত কিংবা মানসিকভাবে শক্তিশালী এমন সুস্থ সবল ব্যক্তি যদি দৈহিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ অক্ষমতায় আপতিত হয় তাহলে তাকেও সুস্থ বা স্বাস্থ্যবান বিবেচনা করা যাবে না। অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে পুরোপুরি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে হলে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিকভাবে সব দিক দিয়ে সবল হতে হবে। বস্তুত সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পূর্বশর্ত হলো দেহ, মন, সামাজিক সুনাম আর আত্মার উৎকর্ষতাই পরিপূর্ণ সুস্থতা। সে জীবন অর্জনের জন্য, সে জীবন যাপনে সাধনার প্রয়োজন। করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রয়োজন সুশৃঙ্খল জীবনযাপন।

নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসের মতো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় শিক্ষার ক্রম অবলোপন গোটা দেশ ও জাতি সংস্কৃতি সম্প্রদায়কে যে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা উপলব্ধিতেও ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসন আমলেও শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার ছিল সরব উপস্থিতি।

সুস্থ ও সুন্দর জীবনের স্বার্থে এ চার পর্ব বা পর্যায়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। শারীরিক বা দৈহিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে শরীরের সব অঙ্গের চলাচলের শক্তি বজায় থাকা এবং কোনো কাজ সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শরীর একটি মেশিনের মতো, একে কার্যকর রাখতে প্রয়োজন উপযুক্ত জ্বালানির, এর চলৎশক্তি সক্রিয় রাখতে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যকার পরস্পর সহযোগিতার স্বাভাবিক কার্যকারিতা বেগবান রাখতে হবে। অর্থাৎ শরীর সচল রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১৭-১৯৮৯) প্রায়ই বলতেন, ‘গাড়িকে গতিশীল ও কার্যকর রাখতে বা পেতে এর নিয়মিত সার্ভিসিং দরকার। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা গাড়ি খারাপ হলে তারপর গ্যারেজে নিয়ে আসি। নিয়মিত সার্ভিসিং হলে একধরনের বেকায়দা অবস্থায় মেরামতখানায় নেয়ার প্রয়োজন পড়ত না। আমাদের শরীরের অবস্থাও তাই। একে ঠিকমতো যত্ন করতে হবে, নিয়মিত চেকআপে রাখতে হবে। শরীরকে রোগবালাইয়ের হাত থেকে অর্থাৎ একে নীরোগ রাখতে সময়মতো এর পরিচর্যা প্রয়োজন।’ মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য মনকেও সুরক্ষা দিতে হবে, মনকেও সক্রিয় ও সুস্থ রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে, সবার সাথে সহযোগিতা সখ্য সমুন্নত রাখতে হবে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি সকৃতজ্ঞতায় তাঁর নির্দেশাবলি পালন ও অনুসরণের মাধ্যমে পরমাত্মার প্রতি একাত্ম হতে হবে। সবকিছুই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, একটির অবর্তমানে অপরটি অচল।

আমরা সবাই জানি চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। ইন্নামাল আমালু বিন নিয়্যাত। মানুষের চলাচলের কাজকর্মের প্রেরণা প্রথমে জাগে তার মনে, ভাবনায়। চেতনার আশ্রয় যে দেহ সেই দেহ নিয়েই আমাদের মনোযোগ যেন সবল থাকে। ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’ কথাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা অনেকে অনেক অসুখে ভুগি। অসুখ জটিল হলে রোজগারি মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের অন্য কেউ এ রকম অসুস্থ হলেও অনেকের পক্ষে ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানো সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত ও অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া বিচিত্র নয়। তবে এ পরিস্থিতি অনিবার্য নয় যদি আমরা সঠিক নিয়মনির্ভর হই। যেহেতু প্রকৃতি হচ্ছে এমন নিয়মের রাজ্য যেখানে রোগের সাথে লড়াই করতে প্রতিটি প্রাণীর দেহেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে, সেহেতু এটিকে ঠিক রাখতে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বেশির ভাগ অসুখই হচ্ছে কোনো না কোনোভাবে এ নিয়ম ভাঙার ফল।

বর্তমানে বাংলাদেশের সনাতন সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ এক বিশেষ সময় পার করছে। ব্যাপক পরিবর্তনের পেছনে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার অপব্যবহার অপপ্রয়োগ অপচেষ্টার মাত্রাগত ওঠানামা যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় তেমনি যাবতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রাকে টেকসইকরণে মনোযোগে মানোমালিন্যের দৈন্য ও দুর্দশার সুরও শোনা যায়। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যতীত কোনো উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়; তেমনি সেই উন্নয়ন টেকসই করার ভাবনা সংযুক্ত না থাকলে উন্নয়ন মুখথুবড়ে পড়তে পারে। লাগসই প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস অর্থবহ করে তোলে।

কৃষি জমিতে ধান উৎপাদনের চেয়ে সেখানে লোনা পানি তুলে পরিবেশ বিপন্ন করে মাছের চাষে লাগসই প্রযুক্তি আপাত আর্থিক লাভ ঘটায় বটে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নে কতটা কার্যকর বা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত প্রয়াস তা পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার তখনই তাৎপর্যবহ হবে যখন দেখা যাবে ন্যূনতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত, বর্জন ও অর্জনের মধ্যে দূরত্ব দৃশ্যগোচর হয়ে দেশজ সম্পদ ও সেবা উৎপাদন নিরাপত্তার সাথে নির্ভরতার সাথে অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সময়ের কষ্টিপাথরে যা যাচাইযোগ্য হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে তা-ই টেকসই উন্নয়ন।

শিক্ষা মানুষকে চক্ষুষ্মান করে, শিক্ষায় মানুষের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে। শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে, অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তোলে। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, জাতীয় জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগেরও কোনো বিকল্প নেই। তবে কেমন বিনিয়োগ, কতটা বিনিয়োগ, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ও উদযাপনের উপায় কী- এসব বিষয় পর্যালোচনায় আনা বা আসার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

একটি বৃক্ষকে সত্যই সবল ও সুস্থ হয়ে বড় বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃত পরিচর্যা প্রয়োজন। এ সময়টা দেখাশোনার প্রয়োজনীয়তা এ জন্য জরুরি ও আবশ্যক যে, এ পর্যায়ে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত হলে পরবর্তী পর্যায় তথা অপরাপর অংশে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে এবং একসময় গোটা গাছই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইদানীং পরীক্ষাব্যবস্থা মূল্যায়নমুখী দেখার পরিবর্তে পাস বা গ্রেড-নির্ভর ভাবা হচ্ছে; আর পাসের হার বাড়ায় বিশেষ পরিতৃপ্তিবোধ দেখা যায়।

মশহুর ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের অ্যানশিয়েন্ট মেরিনার যেমন সমুদ্রে চার দিকে থই থই করা অপানযোগ্য পানি দেখে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেননি (Water water everywhere nor any drop to drink)। তেমনি লক্ষ কোটি শিক্ষিতের মধ্যে উপযুক্ত চাকরিপ্রার্থী মিলছে না। বাইরের শিক্ষিত লোক এসে চাকরির বাজার মাত করছে বেকারের ভারে ন্যুব্জ এই অর্থনীতিতে। উচ্চতর শিক্ষায়তনে ভর্তির দুয়ারে গিয়ে অপারগ অনেককেই ঠায় দাঁড়ানো দেখতে হচ্ছে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান