Naya Diganta

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক মানব পাচার রুট যেগুলো

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক মানব পাচার রুট যেগুলো

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর হিসাব অনুযায়ী ইউরোপ ও আমেরিকার কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে হয় প্রাণ হারিয়েছে নয়তো নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী।

আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর দু’টি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে অতি সম্প্রতি।

মরক্কো থেকে বিশাল এক অভিবাসন প্রত্যাশীর দল শুক্রবার (২৪ জুন) উত্তর আফ্রিকায় স্পেনের ছিটমহল মেলিল্লায় ঢোকার চেষ্টা করতে গেলে ২৩ জনের মৃত্যু হয়।

এর তিন দিন পর যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে টেক্সাসের সান অ্যান্টোনিও শহরের প্রান্তে একটি ট্রাক থেকে শহরের পুলিশ ৪৬টি লাশ উদ্ধার করে। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩-তে।

বিভিন্ন দেশ থেকে যে মূল পথগুলো ধরে মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় ঢুকতে চেষ্টা করে, সেসব পথে যাত্রা কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। এসব রুট যে দেশগুলোর মধ্য দিয়ে গেছে, কোভিডে কড়া বিধিনিষেধ আরোপের ফলে, সেসব বহু দেশে ঢোকা কঠিন হয়ে ওঠে। এখন আবার এসব রুটে মানব পাচার শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, আগামী দিনগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম তাদের এক হিসাবে জানায়, ইউরোপ ও আমেরিকার গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে হয় প্রাণ হারিয়েছে, নয়তো নিখোঁজ হয়ে গেছে প্রায় ৫০ হাজার অভিবাসী। সংস্থাটি মনে করে মৃত ও নিখোঁজ মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে।

আইওএম জানায়, অভিবাসীদের জন্য ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল পাচার রুটগুলোর অন্যতম। উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে এই পথে প্রাণ হারিয়েছে ১৯ হাজার ৫০০ অভিবাসী।

এসব অভিবাসীদের সীমান্ত পার করার চেষ্টায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় রাবারের ডিঙির মতো হাতে তৈরি নৌকা এবং সেগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ তোলা হয়। ফলে এসব ডিঙি নৌকায় সমুদ্র যাত্রা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এবং মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে খুবই বেশি।

এসব নৌকা সাধারণত চালায় অপরাধী চক্রগুলো এবং মানব পাচারকারীরা।

ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে সমুদ্র যাত্রা শুরু করার মূল পয়েন্ট হলো লিবিয়া ও তিউনিসিয়া। সাগরে ডুবে যাওয়া মানুষকে কবর দেয়ার জন্য তিউনিসিয়ায় এমনকি আলাদাভাবে সংরক্ষিত কবরস্থানও রয়েছে।

ইউরোপিয়ান সীমান্ত ও উপকূলরক্ষীদের সংস্থা ফ্রন্টেক্সের দেয়া খবর অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে এই পথে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে বিপদে পড়া তিন লাখ মানুষকে তারা উদ্ধার করেছে।

বহু আফ্রিকান অভিবাসীর জন্য ইউরোপের পথে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন শুরু হয় তাদের নিজেদের মহাদেশের ভেতর দিয়ে যাত্রার মাধ্যমে। তাদের গন্তব্য থাকে উত্তর আফ্রিকা আর তার জন্য পার হতে হয় সাহারার দীর্ঘ মরুপথ।

এই পথে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ। আইওএম-এর আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাহারা মরুভূমি পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৪০০ মানুষ।

অভিবাসীদের জন্য আরেকটা বিশাল ঝুঁকি হলো ওই এলাকায় তৎপর বহু মানব পাচারকারী দল।

আমেরিকার মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের যাওয়ার যে রুটগুলো রয়েছে, সেগুলো দিয়ে মানুষ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার চেষ্টাই করছে তা নয়, এসব অভিবাসীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে সুখী জীবনের আশায় আমেরিকায় নতুন ঘর বাঁধা।

এর ফলে এসব অভিবাসীরা আমেরিকায় ঢুকতে বেপরোয়া ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না।

আমেরিকা আর মেক্সিকোর মধ্যবর্তী সীমান্ত পাড়ি দেয়ার বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভৌগোলিক কারণে এই এলাকায় চলাচল দুরূহ ও কঠিন। ভৌগোলিক প্রতিকূলতার কারণ হিসেবে এলাকায় রয়েছে বিশাল মরু অঞ্চল। এছাড়াও আমেরিকায় পৌঁছতে অভিবাসীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো সীমানা বরাবর বয়ে যাওয়া দুর্গম ও বিপজ্জনক নদী রিও গ্র্যান্ডে পার হওয়া।

এই পথে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একটা কারণ হলো নদীতে ডুবে যাওয়া। আইওএম-এর আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে এই নদী পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তিন হাজারের ওপর অভিবাসী।

যারা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে পথ চলা এড়াতে চায়, তারা লরি বা ট্রাকে লুকিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করে যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে মৃত্যুর অন্য ধরনের ঝুঁকি, যা দেখা গেছে সম্প্রতি টেক্সাসের সান অ্যান্টোনিওতে, পরিত্যক্ত ট্রাকে প্রচণ্ড গরমে মৃত্যমুখে পড়ার ঘটনায়।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মেক্সিকোর চিয়াপাস থেকে একটি ট্রাক লুকিয়ে আমেরিকা যেতে গিয়ে মারা যায় ৫৬ জন অভিবাসী। ট্রাকটি দুর্ঘটনায় পড়ে বিধ্বস্ত হয়।

আইওএম জানায়, ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত অভিবাসী গেছে তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজনেরও বেশির জন্ম এশিয়ায়। এশিয়া মহাদেশে বেশ কিছু প্রধান অভিবাসন রুট রয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী গত আট বছরে এশিয়ায় প্রায় পাঁচ হাজার অভিবাসীর হয় মৃত্যু হয়েছে নয়তো তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে।

এই নিহতরা বেশিরভাগই রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী অভিবাসী।

বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীরা সমুদ্র পথে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর পার হওয়ার চেষ্টা করে। বিপজ্জনক হলেও এই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তারা প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে চেষ্টা করে।

অনেকের প্রধান লক্ষ্য থাকে শেষ পর্যন্ত ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। তাই নানা রুটে তারা ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনে এগোয়।

পৃথিবীর অন্যান্য পাচার রুট ব্যবহারকারীদের মতো এশিয়ান অভিবাসীরাও মানব পাচারকারী চক্রগুলোর হাতে নানা ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। এসব পাচারকারীরা তাদের অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের নানাভাবে হেনস্তা-হয়রানি করে, এর ফলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নানাভাবে আর্থিক বিড়ম্বনা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

সূত্র : বিবিসি