Naya Diganta
৯৫ পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে দেদার

জিরো টলারেন্সের বাস্তবতা দেখা যায় না

৯৫ পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে দেদার

মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে রহস্যজনক খেলা চলছে। সরকারি প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে সারা দেশে এর বিরুদ্ধে ঘন ঘন অভিযান চালায়। ২০১৮ সালে এ ধরনের সবচেয়ে কঠোর অভিযানের সময় ৪৬৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। এখনো সারা দেশে মাদকবিরোধী শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাস্তবতা হচ্ছে, মাদক চোরাচালান ও এর সেবনের হার বাড়ার খবর প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর পরিচালিত পথশিশুদের ওপর একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এদের বড় একটি অংশ মাদকসেবী। আবার এরাই ব্যবহৃত হচ্ছে এর বাহক হিসেবে। প্রতিনিয়ত খবর পাওয়া যাচ্ছে, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বানের পানির মতো মাদক ঢুকছে দেশে। প্রশ্ন হলো, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির আসল কার্যকারিতাটা কী?
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশে মাদক প্রবেশের রুটগুলোকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করেছে তাদের এক প্রতিবেদনে। ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে তারা এটি প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, দেশের সীমান্তবর্তী ১৯ জেলার ৯৫টি পয়েন্ট মাদক পাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের ৯ জেলার ৫১ পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ ও সাতক্ষীরা দিয়ে বেশ কিছু নতুন রুট চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো দিয়ে এখন মূলত পাচার হচ্ছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও হেরোইন। চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ফেনসিডিল ঢুকছে। উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের আট জেলার ২৯ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও গাঁজা। দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসছে ১৫টি রুট দিয়ে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ইয়াবা উদ্ধার বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ঢুকছে বানের স্রোতের মতো। বার্মায় এর কারখানা স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশে পাচারের জন্য। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে সহজে তারা বাংলাদেশে এটি পাচার করছে। এর প্রধান রুট কক্সবাজারের ১০টি পয়েন্ট। আমরা দেখেছি ওই জেলায় মাদকবিরোধী অভিযানের ভয়াবহতা। টেকনাফের সাবেক এক ওসি একাই শতাধিক এনকাউন্টার অভিযান চালিয়েছেন এ জন্য। এ ছাড়াও যৌথবাহিনীর সবচেয়ে কড়া অভিযান সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ইয়াবা, আইসসহ মারাত্মক সব মাদক পাচারের সামান্যতম বিঘœও ঘটেনি। তাহলে মাদকবিরোধী অভিযানগুলো আসলে কী ছিল, সে ব্যাপারে তদন্ত হওয়া দরকার। এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থাকা গোপনে পরিচালিত মাদকের কারখানাগুলো চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। ওইসব কারখানার সুনির্দিষ্ট তথ্য বার্মা বা মিয়ানমারকে সরবরাহ করা হয়েছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের সাথে চারটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। তারা ওইসব কারখানা বন্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। এ বিষয়ে দেশটির সাথে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো মাদক নিয়েও প্রতারণাপূর্ণ আচরণ করছে মিয়ানমার।
এ দেশে মাদকের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা দেশ ভারত। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ বলে উভয় দেশের সরকার দাবি করে। অথচ মাদক পাচারের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি মিয়ানমারের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। দুটো দেশই মাদক পাচার করে আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। ভারত থেকে গাঁজা ফেনসিডিলসহ বহু রকমের মাদক বহু আগে থেকেই আমাদের দেশে আসছে। বাংলাদেশে পাচারের জন্য সীমান্তের ভারত অংশে এসব মাদকের কারখানা গড়ে উঠেছে। উভয় দেশ এসব নিয়ে সরকারি পর্যায়ে বৈঠক করে। মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারগুলো সভ্য হিসেবে উভয় দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভারত এর বাস্তবায়ন করে না।
জাতীয়ভাবে সবাই স্বীকার করে যে, আমাদের তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাদকে। আবার সরকারও রয়েছে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। এ যেন বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। এ শুধু কথার ফুলঝুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থেকেছে। দেশে যারা মাদকের কারবার করেন তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কখনো অভিযান চালানো হয়নি। সেটা হলে ভারত ও মিয়ানমার যতই আমাদের দেশে মাদক চালান করতে চাইত, সেটা পারত না। সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের সময় একজন প্রার্থী শীর্ষ মাদক কারবারী বলে আলোচনায় এসেছিলেন। এর আগে কক্সবাজারে আরেকজন রাঘববোয়ালের নামও আলোচনায় এসেছিল। কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মূলত আমাদের সরকারই মাদক নির্মূল চায় না। তা হলে মিয়ানমার বা ভারতকে এ ক্ষেত্রে দোষ দেয়া বৃথা।