Naya Diganta

বড় চাকরি!

বড় চাকরি!

বৃষ্টির মৌসুম। টানা বৃষ্টি। চার দিন হলো- কিন্তু বৃষ্টি কমার নাম নেই। রাতদিন একাকার এই বৃষ্টিতে কান ঝিম মেরে আসে। তারপর টিনের চালের ঝমঝম ঝমঝম শব্দ। আমি তখন ঢোলা হাফপ্যান্ট পরা টিনটিনে বালক। বাঁশের কঞ্চির মতো লম্বা আমার পা। ঢোলা ঢালা শার্ট পরলে কণ্ঠার হাড় উঁকি দিয়ে থাকত।
সন্ধ্যা উতরে বোধ হয় রাত নেমেছে। বোঝা যায় না। দিনের বেলায় সামান্য আলো থাকলেও বিকেলের পর থেকে আকাশের মুখ থাকে একেবারে গম্ভীর। বৃষ্টির কারণে একটু শীত শীত অনুভূত হচ্ছে।
আমাদের মুরগির খোপের মতো একটা দোচালা ঘর। টিনে জং পড়ে প্রায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। ঘরময় টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ছে। মা আর আমার বোন রুপালি সারা বাড়িতে বাটি, বল এইসব বিছিয়ে দেন। বৃষ্টি কমে। একটু বিরতি দিয়ে আবার শুরু। অবিরাম এই বৃষ্টিকে আমার সে সময় রেলগাড়ির মতো মনে হতো। কোনো স্টেশনে থামবে কী থামবে না, সব ড্রাইভারের এখতিয়ার। থামলেও চার দিক কাঁপিয়ে আবার চলে। ঝকঝক, ঝকঝক।
এ বৃষ্টিতে আমার আব্বার কথা মনে পড়ে শুধু। তিনি কি এসে একটু দেখতে পারেন না তার পরিবারের এ দুরবস্থা। আব্বার অবশ্য অনেক ব্যস্ততা! বাড়িতে আসার সুযোগ হয় না তেমন।
বৃষ্টি কমিছেরে? কাঁথার নিচে থেকে মাঈন্লু ভাই জানতে চান। টিনের গায়ে ঝমঝম ঝমঝম শব্দে কান তব্দা হওয়ার জোগাড়। বৃষ্টি থামলে কি অইব ভাই? কিছুই না। ঘুমা। মাঈনুল ভাই সোলেমান জেঠার ছেলে। তার বড় ভাই বিয়ে করলে যখন ঘরের সঙ্কট দেখা দেয়- তখন থেকে আমাদের বাড়িতে আমার সাথে থাকেন। ক্লাস এইট পাস করা ২২-২৩ বছরের যুবক। অর্থাভাবে আর পড়াশোনা হয়নি। বিদেশ যাওয়ার চক্করে আছে। এরই মধ্যে মাঝে মধ্যে মাইদুল ভাইকে এ-ওর জমি জিরাতের কাজ করতে দেখা যেত। পেটানো শরীর। পেশিযুগল শক্ত-সামর্থ্য। কিন্তু তার মন ঠিক ততটাই আর্দ্র। যেন বর্ষার বর্ষণে গলিত হওয়া কোনো নরম মাটি।
আম্মা আমাদের ঘরটাতে দুয়েকবার এসে বাটিগুলোর পজিশন ঠিক করে দিয়ে আবার তার ঘরে চলে যান।

দ্বিতীয়বার আম্মা ঘরে ঢোকার সময় আম্মাকে বলেই ফেললাম, আম্মা, আব্বা আইব না? ঢাকায় আব্বার এত কী কাম?
আমরা কষ্টে আছি আব্বা আইসা দেখব না? কত দিন আব্বারে দেখি না... হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় দেখা গেল আম্মার মুখটাতে হঠাৎ দুঃখী মানুষের ছায়া ভেসে উঠেছে। চোখে কেমন গাঢ় বিষাদরেখা।
বিলচলন এ গ্রামের ছোট্ট বাড়িটাতে আব্বাকে দেখতে আমাদের বহুদিন অপেক্ষা করতে হতো। তিনি শহর থেকে যখন বাড়ি আসতেন পুরো বাড়িতে ঈদের আমেজ শুরু হতো। মুখ ভার আকাশেরও যেন খুশির সীমা থাকত না। আম্মা সেদিন পুরাতন ঘুণে পড়া আলমিরা থেকে একটা ছাই রঙের শাড়ি বের করে পরতেন। আমাদের ভাইবোনকে সাজিয়ে ফুলবাবু করে ফেলা হতো। মাঈনুল ভাই বাজার থেকে আগেভাগে গিয়ে কাতল মাছ কিনে নিয়ে আসতেন। আম্মা খোঁয়াড়ে লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগটা বন্দী করে রাখতেন সেই সকালে। দুপুরে কাতলা মাছ, মুরগির সালুন, মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে আব্বার সাথে আমরা খেতে বসতাম। আম্মা খাওয়ার ফাঁকে এটা ওটা বলে নরম স্বরে বলতেন- কতদিন পর আসেন! ছেলেমেয়েরা আপনার কথা সারা দিন জিজ্ঞেস করে। আব্বা কিছু বলেন কি না ‘আমরা তার মুখের দিকে তাকাই। তিনি খেয়ে চলেন। টুঁ শব্দটিও করেন না। ছোট শিশুর মতো আব্বা চুকচুক করে মাষকলাই ডাল খাওয়াতে মনোযোগী হন।
সেবারের বৃষ্টিতে- ঠিক বৃষ্টি নয় বন্যা। বন্যাতে আমাদের উঠোন যেন একটা ছোটখাটো খালে পরিণত হয়েছে। চার দিকে পানি আর পানি। পানিতে থইথই।
উঁচু রাস্তাগুলোও ডুবি ডুবি। ফসলের জমিগুলো পানির উপর ভেসে আছে। পানিতে ডুবে ডুবে কিঞ্চিৎ উঁকি দেয় নতুন ধানের অগ্রভাগ।
আমাদের দোচালা ঘরের কী যে করুণ পরিস্থিতি। ঝড়ে কিছু টিন আছড়ে পড়েছে বহুদূরে। পুরনো ছিদ্রগুলো আরো বড় হয়ে পানি পড়ছে বিরামহীন। মাঈনুল ভাই অস্থির হয়ে পাশের বাড়ির দিনু মিস্ত্রিকে ডেকে আনেন। রাত বাড়তে থাকে। দিনু মিস্ত্রি তার ঘর থেকে পুরাতন কিছু টিনের টুকরা এনে জোড়া দেন। বৃষ্টিটাও কিছুটা কমে এলো বোধ হয়। রাত কেটে গেল সবার জেগে জেগে। আম্মা নামাজের চৌকিতে বসে আছেন পুরো রাত ধরে। ভোরে মোরগের ডাক শুনে আমরা সবাই চমকে উঠি। খোঁয়াড়ের ভেতরে মুরগিগুলো এখনো জীবিত আছে?
ফজরের আজান হলো কি হলো না তা বোঝা সম্ভব হয়নি। তবে মোরগের ডাক শুনে মনে হলো সকাল উঁকি দিচ্ছে পানিবন্দী এ বাড়িটার সামনে। মাঈনুল ভাই দরজার সিটকানিটা আস্তে খুলে দেন। রোদে তার মুখে উজ্জ্বল ধান ক্ষেতের মতো সোনার বরণ মাখিয়ে রঙিন আলো ছড়িয়ে যায়। সুরুজ উঠছে, সুরুজ উঠছে বলে মাঈনুল ভাই হাঁটুপানি উঠানে দৌড়াতে লাগলেন।
আম্মার সাথে আমরাও বাইরে বেরিয়ে আসি। আসলে এত বড় সূর্য! এত কিরণ তার। চোখ ঝলসে ওঠে! একটানা আট দিন বৃষ্টির পর আকাশ যেন ষোড়শী -অষ্টাদশীর হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। আকাশও হাসে? এত সুন্দর। কী স্নিগ্ধ। পূর্ব দিক থেকে এক ঝটকা মৃদু বাতাস এসে গায়ে মাখিয়ে দেয় আমাদের।


২.
তোমার আব্বা করেন কী? নাম কী তার? কই থাকে? টানা বৃষ্টির পর, বলা চলে বহুদিন পর চাটমোহর বাজারে মাঈনুল ভাইসহ ঘুরতে এলাম। ঠিক ঘুরতে এলাম বললে ভুল হবে। সামান্য সদাই-পাতিও নিতে হবে। কেরোসিন কিনতে জীর্ণশীর্ণ একটা দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার ছেলেটি উপরি-উক্ত প্রশ্নগুলো করে বসলেন! বলে উঠলেন- এই তোমাগো বাড়ি নদীর হে পাড় না? বিলচলন! হুঁ।
তোমাদের গ্রামের নাম কি বিলচলন? ভদ্র গোছের এক মধ্য বয়স্ক লোক এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এ দোকানের সামনে। পরনে সাদা চেকশার্ট। পরিপাটি করে ইন করা। মাথার চুলগুলো সুন্দর করে চিরুনি করা। প্রথম দেখাতেই বোঝা যায় এ লোক এ চাটমোহরের কেউ না। হয়ত মেহমান। বড়াল নদী দেখতে আসছে। গ্রামের নাম কী বাবু?
বিলচলন।
বিলচলন? আমি মাথা ঝাঁকাই। দোকানদার ছেলেটার আগ্রহ বেড়ে যায়। তোমার আব্বা করেন কী? ঢাকাত থাকে? নাম কী তার?
একটানা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে একটু নিশ্বাস নেয় দোকানদার ছেলেটি। উত্তরের আশায় আমার চোখে তাকিয়ে থাকে সে। আমার ছোট্ট বুক কেমন যেন ভয়ে ধুঁকপুক করে উঠেছে। দাঁড়িয়ে থাকা সাহেব গোছের ভদ্রলোকটি বুঝেছেন কি না! অভয় দিয়ে বললেন, বাবু তুমি ভয় পেয়ো না। তুমি বলো। তোমার আব্বুর নাম কী?
রফিকুল ইসলাম। ঢাকায় চাকরি করেন। আমি ডেবডেবে চোখ নিয়ে তাকাই তার কালো চোখের মণিজোড়ার দিকে। ভদ্রলোক এবার জানতে চান কী চাকরি করে জানো?
আব্বা ঢাকায় ঠিক কী চাকরি করেন আমরা ভাইবোন তেমন একটা জানতাম না। এমনিতে এতটুকু জানি- আব্বা ঢাকায় চাকরি করেন। কী চাকরি সেটা জানি না।
একবার বাড়ি এলেন আব্বা অনেক রাতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আব্বাকে দেখে চমকে উঠি। সেই দিন, সেদিনই প্রথম জানতে চাই, আচ্ছা আব্বা-ঢাকায় তুমি কী করো? যেখানে তুমি ছুটি পাও না। শুধু কাজ আর কাজ... আমাগো লগে তোমার কত দিন বাদে দেখা অয়। অন্য ছাওয়ালরা তাগোর আব্বারে নিয়ে হাটে ঘুরতে যায়। হাটবারে জিলাপি আর বাতাসা লইয়া দেয় তাগোরে। আমি যাইতে পারি না।
আব্বা মুখ তুলে তাকালেন। বাবা, আমি তো বড় চাকরি করি। বড় অফিসে চাকরি করি। সেজন্য আসতে পারি না। কিয়ের অফিস? বড় অফিস। অফিসাররা যেখানে চাকরি করে। আব্বা তুমি কি অফিসার? আব্বা এবার মাথা ঝাঁকালেন নিতান্ত বালকের মতো। হ আব্বাও অফিসার।
তারপর আরো যতবার আব্বা বাড়ি আসতেন আমাদেরকে তার অফিসের গল্প শোনাতেন। সে কী সুন্দর গল্প। গল্প শোনাতেন অফিসার হওয়াতে আব্বার কতখানি প্রভাব। কোনো সময় হয়ত বিকেলে আম্মা পেঁপে কেটে দিয়েছেন সামনে। সে পেঁপে খেতে খেতে আব্বা গল্প বলতেন তার সেখানের নামডাকের কথা। আম্মা অবশ্য সে সময়ে কোনো কথা বলতেন না। মনে হতো তিনি কিছুই শুনছেন না। বা শুনলেও এ আলাপে তার আগ্রহ নেই।
ছোট্ট একটা নৌকাতে আমরা বাড়ির দিকে যাচ্ছি। নৌকার গলুইয়ে বসে আমি ভদ্রলোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। তার মতলবটা কী? কিছুই বোঝা যায় না।
বাড়ি এসে আম্মাকে ডাকলাম। আম্মা অপরিচিত পুরুষ মানুষকে দেখে সামনে যেতে ইতস্তত করলেন। মাঈনুল ভাই বললেন, আপনার সাথে দেখা করতে চায় এ লোক। খুব জরুরি খবর নাকি।


আম্মা মুখে প্রকাণ্ড ঘোমটা টেনে দরজা থেকে সামান্য বাইরে নেমে এলেন।
ইকবাল চৌধুরী তার নাম বলে বললেন, আচ্ছা আপনার স্বামী ঢাকায় কী করে? আপনার এ ছেলে বলছে অফিসার, এ একটি তথ্য আমার সাথে ম্যাচিং হচ্ছে না! আর বাকি সব পুরোপুরি ঠিক আছে। আপনার স্বামী ঢাকায় কী করেন এটা জানা খুব জরুরি। আর এর প্রকৃত সত্য আপনিই জানেন! আম্মা মাথা আরো নিচু করলেন। মাটির দিকে দৃষ্টি রেখে খুবই নীরব স্বরে বললেন, উনি বাসার দারোয়ানি করে!
ইকবাল চৌধুরীর কপালে এতক্ষণ চিন্তার যে একটি ভাঁজ ছিল তা এ তথ্যে আপসেই মিলিয়ে গেল। আমি সে বাসার মালিক। আমার বাসার দেখাশোনার করত সে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। যার জন্য আমি চাটমোহর এসেছি।
রফিক গত ১০ দিন আগে, শুক্রবার ছিল সেদিন। গত শুক্রবার তার ডিউটি হাফটাইম ছিল, বাসার কেয়ারটেকার সে হাফটাইমের পরে ডিউটি দিতেন। ইকবাল সাহেব সামান্য বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন-
সে রাতে রফিক হঠাৎ বাড়ি আসার জন্য আমার কাছে ছুটি চাইল। মাঝে মধ্যে শুক্রবার বিকেলে সে কমলাপুর গিয়ে কুলির কাজ করে আসত। সে হাসতে হাসতে বলত- স্যার বাড়তি ইনকাম। বেতন পেলে এক সাথে এটাও মানিঅর্ডার করে দিবো।
শুক্রবার সে আমার কাছে হঠাৎ ছুটি চাইল। বুঝলে? আম্মা কিছুই বলেন না। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে না গিয়ে সকালে গেলে হয় না? সে বলল তার ছেলেমেয়ের সাথে নাকি জরুরি দেখা করতে হবে। সে এক্ষুনি যেতে চায়। বাসা থেকে রাতেই সে বেরিয়ে পড়ল। মহাসড়ক পার হতে গিয়ে...
এতটুকু বলে ইকবাল চৌধুরী থামলেন। মাঈনুল ভাইকে বললেন এক গ্লাস পানি দিতে। পানি আসার আগেই ইকবাল চৌধুরী আবার কথা বলা শুরু করলেন। রফিক বাস এক্সিডেন্ট করেছে। এই বলে ইকবাল চৌধুরী কতক্ষণ ছন্দহীনভাবে কাশলেন। আমি বহুকষ্টে এখানে তোমাদের বাড়িতে এসেছি। তোমরা ঢাকায় চল। তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বেরিয়েছে। এখন হিমাগারে লাশ। আগে তোমাদের ঢাকা যেতে হবে। আম্মার চোখজোড়া এখনো মাটিতে। তিনি মনে হয় মাটি ফেঁড়ে তলিয়ে যেতে চাচ্ছেন! বন্যায় যেমন তলিয়ে গেছে আমাদের ফসলের ক্ষেত। আস্তে আস্তে চোখ উঠিয়ে শক্ত মুঠোয় আমাদের হাত ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন আম্মা। সেদিনের বিকেলবেলা সাক্ষী হয় একজন নীরব নিভৃতচারী মায়ের সংগ্রামমুখর জীবনের প্রথম লগ্নের। আলমিরা খুলে আম্মা ছাই রঙের শাড়িটা আরো ভেতরে ঠেলে রাখেন। আমরা ভাইবোন ঘটনার আকস্মিকতায় নিমগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি পাশে। মাঈনুল ভাই তাড়া দেন- কাকী, একটু জলদি করেন। সায়েবের দেরি অইয়া যাইতাছে।