Naya Diganta

ইভিএম কিভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়ল

ইভিএম কিভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়ল

আমাদের সাধারণ নির্বাচনের আরো প্রায় দেড় বছর বাকি থাকলেও এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে এই বিতর্ক মূলত নির্বাচনে ‘ইলেকট্র্রনিক ভোটিং মেশিন’-এর ব্যবহার নিয়ে। প্রশ্ন জাগে, এই সময়ে হঠাৎ করেই ইভিএম বিতর্ক এত বিশাল স্পেস কেন পেল? এটি কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাকি এই বিতর্ক খুবই প্রয়োজনীয় বা সময়ের দাবি ছিল? নাকি এক পক্ষের জন্য অত্যন্ত জরুরি ও অন্য পক্ষের জন্য একেবারেই অসার?

গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০টি আসনেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে’। এর পরদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে সাংবাদিকদের একই কথা বলেন। কিন্তু ১০ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা বর্তমানে মাত্র ১০০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষমতা রাখেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনার পর ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে জানান।

পরবর্তীতে ২১ মে একজন নির্বাচন কমিশনার মো: আনিছুর রহমান হঠাৎ করেই বলেন, ‘আমাদের ইভিএমের মতো সেরা মেশিন পৃথিবীর কোথাও নেই। ইভিএমের ভুলক্রটি যদি কেউ ধরতে পারেন, তার জন্য আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।’ (প্রথম আলো, ২২ মে ২০২২) কিন্তু ২৪ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন পুরস্কারের ঘোষণাকে উদ্ভট বলে আখ্যা দেন এবং কমিশনার আনিছুর রহমানকে ডিফেন্ড করে বলেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ঘোষণা দেননি বরং সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে ভুলে এমন কথা বলে ফেলেছেন। সেই সাথে তিনি নিশ্চয়তা দেন যে, ‘ভোট তার নিয়মানুযায়ী হবে, দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না।’ গত সংসদ নির্বাচনে রাতে ভোট হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘এই অভিযোগ আমি ডিনাই করি না। আবার বিশ্বাসও করি না। কিন্তু অভিযোগগুলো ব্যাপকভাবে হয়েছে, এতে জনমনে নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০২২)।

এরপর ৩০ মে আরেকজন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো: আহসান হাবিব খান আরো একটি বোমা ফাটানো মন্তব্য করেন, ‘ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে- একটা ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে- আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান, দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২২) তিনি যে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সত্য কথাটি বলেছেন তার প্রমাণ দিয়েছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী।

গত ২৮ মে এক নির্বাচনী সভায় মুজিবুল হক বলেন, ‘ইভিএমে বাটন টিপে দিতে কেন্দ্রে আমার লোক থাকবে’। তিনি আরো বলেন, ‘ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতাম।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২২) তিনি আবার ২ জুন আরেক নির্বাচনী সমাবেশে বলেন, ‘তোমার আঙুল, আমি টিপ দেবো, ওটা হলো সুষ্ঠু ভোট।’ (প্রথম আলো, ৪ জুন ২০২২) এই বিতর্কের সর্বশেষ সংস্করণ হলো দু’জন অধ্যাপকের ইভিএমের পক্ষে ছাড়পত্র দেয়ার চেষ্টা।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ““Machine are not cent percent safe, it is not possible to manipulate in EVM.” (Daily Sun: 26/0582022)। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেছেন, “No machine can be trusted cent percent, but EVM can not be manipulated” (প্রাগুক্ত)। ওই দুই বিজ্ঞজনের বক্তব্য আমজনতাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছে। কারণ এক দিকে তারা বলছেন মেশিনের বিশ্বাস নেই; আবার অন্য দিকে বলছেন অপব্যবহার সম্ভব নয়। আমরা আমজনতা এখন কোনটা ধরে নেবো?

অবশ্য ইভিএম নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক শুরু ১৯৮২ সালে ভারতে প্রথম ইভিএমে ভোট চালুর দিন থেকেই। ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি স্থানীয় নির্বাচনে ৫০টি ইভিএম কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতা এ সি জোসে কমিউনিস্ট পার্টির এন সিভান পিল্লাইয়ের কাছে হেরে গেলে কেরালা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ওই ৫০টি আসনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচন হলে জোসে জয় লাভ করেন। তবে বর্তমান প্রজন্মের আধুনিক ইভিএমে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (VVPAT) সংযুক্ত রয়েছে যাতে ভোটারের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে ভোটদানের স্লিপ বা নথি চলে আসে যেন ভোটদানের প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিত হওয়া যায়। কাজেই ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভোটে স্বচ্ছতা এবং সঠিকতা নিশ্চিত করার জন্য ইভিএমের সাথে VVPAT ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন (https://www.thehindu.com/news/cities/kochi/evms-were-used-firss-time-in-kevala-in-so-booths-in-1982/article34005923.ece)।

জানা যায়, বিশ্বে মোট ৩১টি দেশ ইভিএম ব্যবহার করেছে বা চর্চা করেছে। তাদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশ জাতীয়ভাবে, ১১টি দেশ স্থানীয়ভাবে ইভিএম ব্যবহার করেছে এবং পাঁচটি দেশে বর্তমানে পাইলটিং করছে। তিনটি দেশ ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহার বাদ দিয়েছে এবং ১১টি দেশ পাইলট প্রোগ্রাম করার পর ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে (https://www.jagranjosh.com/general-knowledge/which-countris-use-electronic-voting-machines-1548418168-1)।
বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো নিরাপত্তা, সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং যাচাইকরণ সংক্রান্ত ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে ইভিএমকে নিজ নিজ দেশে নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড ইভিএম নিষিদ্ধ করেছে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ইটালি ইভিএমে পাইলট প্রজেক্ট সম্পন্ন করার পর ব্যালট পেপারেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র পেপার ট্রেইল ছাড়া ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম ইভিএম বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর কাজী রকিব উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করলে সেখানে মেশিনে ত্রুটি পরিলক্ষিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার ২০০ ইভিএম বাতিল করতে হয়। পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা দেশে ইভিএমের ব্যাপক ব্যবহারের লক্ষ্যে চার হাজার কোটি টাকার বাজেটে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় ও ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সেগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জানা যায়, দেশের সুশীলসমাজ ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও তৎকালীন নির্বাচন কমিশন একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে এই বিশাল বাজেটের ইভিএম প্রকল্প হাতে নেয়। তারা পরবর্তী ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন বাস্তবতায় ২০১৮ সালে মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করে। এ সময় ২৫ শতাংশ ভোটের ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইভিএম ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, যার মানে ওই কর্মকর্তার ২৫ শতাংশ ভোট নিজের পছন্দমতো প্রার্থীর পক্ষে দেয়ার অধিকার ছিল। (প্রথম আলো, ৬ জুন ২০২২)

২০০৭ সালের তত্ত্ববধায়ক সরকারের ইভিএম প্রচলনের চেষ্টার সময় তেমন একটা বিতর্ক না হলেও পরে রাজনৈতিক সরকার এই ইভিএম প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়; অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পরই সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অনাস্থা, সন্দেহ ও হতাশা শুরু হয় এবং তা সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের একদেশদর্শী কার্যক্রম ও সরকারের আচরণে দিন দিনই বাড়তে থাকে। বর্তমানে এই অনাস্থা ও হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে প্রতীয়মান। তবে ইভিএম পদ্ধতি অবলম্বনের ব্যাপারে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের আপাত নিরপেক্ষ কর্মতৎপরতায় বিরোধী পক্ষ কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকারদলীয় নেতাদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ইভিএমে অনুষ্ঠানের ঘোষণায় নির্বাচন কমিশনের বডিল্যাঙ্গুয়েজে পরিবর্তন সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।

এরই মধ্যে দু’জন বিশেষজ্ঞ সাবেক অধ্যাপক ইভিএমের পক্ষে সনদ দেন, যদিও একজন গত মার্চ মাসে এই ইভিএমকে একটি নিম্নমানের মেশিন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কাজেই ইভিএমকে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে বিরোধী পক্ষের সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। সমালোচকরা তাই ইভিএমকেই এবার ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনে জয় লাভের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, ২০১৪ সালে বিনাভোটে, ২০১৮ সালে রাতের ভোটে জয়লাভের পর ২০২৩ সালে ইভিএমকেই ডিজিটাল রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।

করো কারো মতে, দেশে বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতিসহ অন্যান্য সমস্যা থেকে বিরোধীপক্ষের মনোযোগ সরিয়ে একটি নতুন বিতর্কের মধ্যে ব্যস্ত রাখার কৌশল এটি হতে পারে। নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর আগে ইভিএম বিতর্কের মধ্যে বিরোধী পক্ষকে জড়িয়ে ফেলে পরবর্তীতে বিভিন্ন শর্তের মাধ্যমে নির্বাচনে নিয়ে আসার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে এই ইভিএম বিতর্ক। দীর্ঘদিন ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে করতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ইভিএমে পরবর্তী ভোটের ব্যবস্থার দাবিতে এক প্রকার ঐক্যের সুযোগ দলের মধ্যে আসবে বলে অনেকে মনে করেন। আর ইভিএমে ভোট হলে ক্ষমতাসীনদের টিকিটে জয়ের সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করার জন্য বিরোধীপক্ষের কেউ কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার যেকোনো অফার গিলে নিলে তৃণমূল পর্যায়ে বিরোধীপক্ষকে দুর্বল করে দেয়া সম্ভব হতে পারে বলে দুর্মুখদের বলতে শোনা যায়।

আসলে ইভিএমের কোনো দোষ বা ত্রুটি নেই। সমস্যা হলো, যারা এই মেশিনের উপকারিতা ভোগ করবেন তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার মারাত্মক অবনতি। কারণ, এতে ভোট প্রদান যাচাইকরণের (VVPAT) সুযোগ নেই; গোপন কক্ষে ‘ডাকাত’ বা ‘জিন’-এর উপস্থিতি এবং নির্দিষ্ট শতাংশের ভোট দায়িত্বরত কর্মকর্তার ওভাররাইটের সম্ভাব্য অধিকার থাকতে পারে। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্তির প্রক্রিয়া এবং তৎপরবর্তী ক্ষমতাসীন পক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিটি কর্মকাণ্ড সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। সেই সাথে বিগত দু’টি নির্বাচন কমিশনের সার্বিক কর্মতৎপরতা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ণে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল বলে সাধারণ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতিও সাধারণের একটি নেতিবাচক কল্পমূর্তি তৈরি হয়ে রয়েছে।

এমতাবস্থায় গত ৯ জুন দেশের ৩২টি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার মধ্যে ২৬টি সংস্থার প্রতিনিধি নির্বাচন কমিশনের সাথে মতবিনিময় সভায় বলেছেন, ভোট কক্ষে ‘জিন’ থাকে, ইভিএমেও বিশ্বাস কম। (প্রথম আলো, ১০ জুন ২০২২) ইতোমধ্যে ১৫ জুন কুমিল্লা মহানগর নির্বাচনে ভোট পড়ার স্বল্পতা ও চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় সন্দেহ এবং প্রশ্ন সৃষ্টিতে ইভিএমকেই অভিযুক্ত করছেন বিরোধীরা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ইভিএমকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পরোক্ষ প্রচেষ্টা তাদেরকে আরো বিতর্কিত বা অগ্রহণযোগ্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

তাছাড়া বিগত নির্বাচনগুলোতে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা রাখার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ‘সর্বৈব রাজনীতিকরণকেই’ বোদ্ধারা দায়ী করছেন বলে শোনা যায়। কাজেই রাজনৈতিক পরিবেশের কোনো গুণগত বা বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন না করে ইভিএম চালু করলেই কি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে? কারণ বন্দুক নয়, বরং বন্দুকের চালকই আসল সমস্যা। বন্দুকটি কখন, কোন টার্গেটে, কিভাবে গুলি ছুড়বে সেটি বন্দুক চালনাকারীই নির্ধারণ করে দেয়। তাছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন সদ্যসমাপ্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যকে প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাতে গিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন।

একটিমাত্র স্থানীয় নির্বাচনে যে কমিশন তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিরপেক্ষতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির সামর্থ্য প্রমাণে অসহায়ত্বের স্বাক্ষর প্রদর্শন করেছেন; তারা কিভাবে একত্রে ৩০০ আসনে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবেন তা একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে। কাজেই ইভিএমের বটিকা খাওয়ানোর চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে সব পক্ষের আস্থা অর্জনে মনোযোগী হতে হবে। নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা, সবাইকে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাশীল করে তোলা, সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের নেতিবাচক আচরণকে সংশোধিত করা ইত্যাদি প্রচেষ্টা না চালিয়ে শুধু ইভিএমকে নিষ্পাপ বানানোর প্রচেষ্টা না থামালে দ্রুতই এই নির্বাচন কমিশন আস্থা হারাতে পারে। তবে তারা জোরজবরদস্তি করে হয়তো বা নির্বাচনটি ইভিএমে সম্পন্ন করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু তাদের স্থান দেশ ও জাতির নির্বাচনী ইতিহাসের সুখস্মৃতির পাতায় নাও হতে পারে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com