Naya Diganta

নবী অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার প্রগলভতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যে লাভা সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অবশেষে কানপুরে বিস্ফোরিত হয়। শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের অবমাননার বিরুদ্ধে মুসলমানদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যে সময় এই কলাম লেখা, সে সময় ঘনবসতিপূর্ণ উত্তরপ্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর কানপুরে কঠিন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এখানে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যোগী সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়। বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করে শুধু তাদের বিরুদ্ধে গ্যাংস্টার অ্যাক্টের আওতায় ব্যবস্থা করা হয়েছে তা নয়, বরং তাদের স্থাবর সম্পত্তিও জব্দ করার ঘোষণা দেয়া হয়। কানপুরে ৩ তারিখ জুমার দিনে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় কোথা থেকে হাঙ্গামা শুরু হলো তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ‘গৃহপালিত মিডিয়া’র রিপোর্টিং ও পুলিশি তৎপরতার গতিবিধি থেকে স্পষ্ট অনুমান হয়, সব সময়ের মতো তাদের টার্গেটে রয়েছে শুধুই মুসলমান। অথচ যে ভিডিও দৃশ্যপটে এসেছে, তাতে পুলিশকে বিশৃঙ্খলাকারীদের সাথে পাথর নিক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিটি ঘটনার মতো কানপুর হামলার পুরো দায়দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। অথচ হামলায় উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই দায়ী। যদি পুলিশ নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণস্বরূপ তাকে শুধু জিজ্ঞাসাবাদই করত, তাহলে মুসলমানদের আহত আবেগের ওপর কিছুটা হলেও সান্ত¡নার মলম হিসেবে কাজ করত। কিন্তু পুলিশ কয়েকটি এফআইআর লিপিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে কলাম লেখার সময় পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কানপুরে জুমার সময় তার গ্রেফতারির দাবিসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।

নূপুর শর্মার ব্যাপারে সবাই জানেন, তিনি বিজেপির মুখপাত্র। আর বেশির ভাগ টিভি টকশোতে তাকে দেখা যায়। শাসকদলের মুখপাত্র হওয়ার সুবাদে তার কাছে এটা আশা ছিল, তিনি দায়িত্বশীল আচরণ করবেন। কিন্তু তিনি যে ভঙ্গিমায় নবী অবমাননার অপরাধ করেছেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, যে সরকারের কাঁধে এ দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও জান-মালের নিরাপত্তার সাংবিধানিক দায়িত্ব আরোপিত এবং যারা ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ-সবার সাথে সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার উন্নয়ন’-এর দাবিও করে, তাদেরই লোক যখন দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি নিয়ে খেল-তামাশা করতে থাকে, তখন দেশের অবস্থা কী হবে।

সম্প্রতি একটি নিউজ চ্যানেলে নূপুর শর্মা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:-এর শানে যে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন তা কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। এ কারণেই নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে ক্ষোভের পরিধি বেড়েই চলেছে। ভারতের বিভিন্ন শহরে তার বিরুদ্ধে এফআইআর করানো হয়েছে। প্রথম এফআইআর রেজা একাডেমি মুম্বাইয়ে করিয়েছে। এরপর পুনেতে এনসিপির সাবেক করপোরেটর আবদুল গফুর পাঠান কোন্ধয়া পুলিশ স্টেশনে এফআইআর করান। পাঠানের বক্তব্য- নূপুর শর্মার বক্তব্যে তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। সুতরাং নূপুরের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হোক। নূপুরের বিরুদ্ধে আরো একটি এফআইআর করা হয়েছে দিল্লিতে। এটা করিয়েছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ডা: তসলিম রহমানী। নূপুর স্পষ্টভাবে প্রদত্ত হুমকির প্রেক্ষাপটে তার নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। তার বক্তব্য- তাকে এবং তার পরিবারকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার এতে কোনো পরওয়া নেই যে, তার কর্মকাণ্ডে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা হুমকিতে পড়েছে।

এখন পর্যন্ত গৃহপালিত মিডিয়ার তীর মুসলমানদের দিকে। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের টার্গেট করছে গণমাধ্যম। কিন্তু হাওয়া উল্টা দিকে বইছে। গৃহপালিত মিডিয়া এখন মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলতে ময়দানে নেমেছে। মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের ব্যাপারে অবমাননামূলক বক্তব্য এগিয়ে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের চুপ করে বসে থাকা কী করে সম্ভব। এ কথা সবাই জানেন, মুসলমান সবকিছু মেনে নিতে পারেন, কিন্তু তারা তাদের পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবমাননা মেনে নিতে পারেন না। অতীতে যখনই এ ধরনের হৃদয়ে আঘাতকারী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তখনই মুসলমানরা সর্বাত্মকভাবে বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে এসেছেন। নূপুর শর্মার ব্যাপারেও তাই হচ্ছে। অনতিবিলম্বে এই প্রগলভ বিজেপির মুখপাত্রের গ্রেফতারের দাবি করা হয়েছে। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, শাসকদল এখনো তাদের এ অসভ্য ধৃষ্ট মুখপাত্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। তার বক্তব্যের সাথে নিজেদের আলাদাও করেনি। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, অস্থিরতা ছড়ানোর যে অপচেষ্টা হচ্ছে, তাতে শাসকদলের নীরব সমর্থন রয়েছে।

বিষয়টি মূলত টাইমস নাও টিভি চ্যানেলের সাথে সম্পৃক্ত। ২৭ মে ওই চ্যানেলের উপস্থাপক নবিকা কুমার জ্ঞানবাপী মসজিদ ইস্যুতে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিতর্কে বিজেপির অবস্থানের পক্ষে দলের মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নূপুর মূল বিষয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:কে তার নোংরা মানসিকতার লক্ষ্যবস্তু বানান। নূপুর যখন রাসূল অবমাননার অপরাধ ঘটান, তখন উপস্থাপক তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টাও করেননি। এমনকি এ কথাও বলেননি যে, চ্যানেল এ বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে না। যেকোনো নিরপেক্ষ মিডিয়া হাউজের এটা মৌলিক দায়িত্ব, যদি ওই চ্যানেলে কোনো ব্যক্তি অশোভনীয় ও অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য দেয়, তাহলে ওই চ্যানেলের সাথে তাদের অসম্পৃক্ততা ও ঐকমত্যহীনতার ঘোষণা দিয়ে এর নিন্দাও জ্ঞাপন করবে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নবিকা কুমার এমন কিছু করেননি। পরে যখন এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলো তখন ‘টাইমস নাও’ মানুষের চোখে ধুলা দিতে ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও তাদের চ্যানেল থেকে গায়েব করে দেয়। এটা মূলত গৃহপালিত মিডিয়ার বিশেষ রীতিতে পরিণত হয়েছে, এগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং মুসলিম বিদ্বেষ মানসিকতা পোষণকারীদের বেশ সহযোগিতা করে। এ ব্যাপারে সাংবাদিকতার নিয়মরীতি একেবারে শিকেয় তুলে রাখা হয়।

মনে হচ্ছে, এটি ওই চ্যানেলগুলোর একটা পরিকল্পিত ছকের অংশ- ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বেশি করে বিদ্বেষ ছড়াও, যাতে ভুল অক্ষরের মতো তাদের মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র সম্পন্ন করা যায়। সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, সরকারের যে দফতরের কাজ মিডিয়ার বিপথগামিতা নিয়ন্ত্রণ করা, এ ব্যাপারে তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি আপনারা দেখেছেন, বারানসির জ্ঞানবাপী মসজিদের হাউজের ফোয়ারাকে ‘শিবলিঙ্গ’ অভিহিত করতে গৃহপালিত মিডিয়া কোমর বেঁধে নেমেছিল। অথচ এ মামলা এখনো আদালতে চলমান। সেখানে এর ওপর কোনো ফায়সালা নেয়া হয়নি। তথাপি গৃহপালিত মিডিয়া এ ইস্যুতে যে লম্ফঝম্ফ করল, তাতে বোঝা যায়, তারা এখনই সেখানে পূজাপাটে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এটা এমন এক পরিস্থিতি, যা সংবাদমাধ্যমকে এ দেশে একটি তামাশায় পরিণত করেছে। এর নিরপেক্ষতা একেবারে শেষ হয়ে গেছে।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় ‘প্রাইম টাইম’-এ যে তর্কবিতর্ক হয়, তা দেখে মনে হয়, গৃহপালিত মিডিয়া ইসলাম ও মুসলমানদের একটি তৃণঘাস মনে করে। যাকে তারা সর্বদা চিবাতে থাকে। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, যে নিজের থেকে মুসলমানদের প্রতিনিধি সেজে ওই চ্যানেলগুলোতে গিয়ে পুরো জাতিকে হাসির খোরাক বানায়, তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। এই ধোঁকাবাজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র তৈরি করতে গৃহপালিত মিডিয়ার সহযোগী হিসেবে তৎপর রয়েছে। সুতরাং এ কথা বিশ্বাস করানো অত্যন্ত জরুরি, মুসলমান কোনো বাজারি পণ্য নয় যে, যে কেউ চাইলেই তার মানসম্মানের সওদা করে বেড়াবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য এটাও আবশ্যক, তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। উগ্রপন্থীদের ষড়যন্ত্রের শিকার যেন না হয়। কেননা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো তাদের বিভিন্ন রূপে উত্তেজিত করে রাস্তায় নামাতে চায়। যাতে তারা চতুর্দিক থেকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। দূরদর্শিতা ও কৌশলের চাহিদাগুলোকে অনুধাবন করা খুবই জরুরি।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ০৫ জুন, ২০২২-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ahmadimtiajdr@gmail.com