Naya Diganta
সরেজমিন ভাটিবরাটিয়া গ্রাম

‘তিন দিন ধইরা না খায়া আছি, কেউ তেরান লইয়া আয় নাই’

সরেজমিন ভাটিবরাটিয়া গ্রাম
উপজেলার ভাটিবরাটিয়া গ্রামের ২৫০টি বাড়ি এখনো পানির মাঝে।

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ভাটিবরাটিয়া গ্রাম। বন্যা শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই এই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িঘরে পানি ওঠা শুরু করে। বর্তমানে গ্রামের প্রায় ২৫০টি পরিবারের ভিটেমাটি পানির নিচে। এই অবস্থায় কেউ কেউ গরু-বাছুর নিয়ে আশপাশের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে পানি উঠে যাওয়া ঘরের ভেতরই উঁচু মাচান তৈরি করে এক প্রকার বন্দি হয়েই দিন কাটাচ্ছেন। কেউবা আবার গিয়ে উঠেছেন সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে। বৃহস্পতিবার নৌকা যোগে সেই গ্রামে যান এই সংবাদদাতা।

গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (আশ্রয়কেন্দ্র) নৌকা ভেড়াতেই ভেজা ভেজা চোখ নিয়ে ভিড় করেন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। তাদের একজন আয়েশা আক্তার (২৫)। তার কোলে শিশুসন্তান। আশ্রয়কেন্দ্রের সিঁড়িতে
তিনি অনেকের সাথে কোমর পানিতে নেমে ত্রাণের অপেক্ষায়।

কেমন আছেন আপনারা?- জানতে চাইলে আয়েশা বলেন, 'আমরার ফেডঅ (পেটে) দানাপানি নাই, তিন দিন ধইরা কিছু খাওয়া হয় না, গলাও শুগায়া গেছে। খাওনের পানিও নাই।'

আয়েশা ভাটিবরাটিয়া গ্রামের নতুন পাড়ার বাসিন্দা। ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় গত শুক্রবার শিশু সন্তানসহ পরিবারের লোকজনকে নিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেন। ছয় দিনে কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি তিনি। এরমধ্যে এক ব্যক্তি কিছু চিড়া-মুড়ি দিয়েছিলেন। সেটাই খেয়েছেন। কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া অন্যদের কাছেও কিছু শুকনা খাবার ছিল। সেটা ভাগাভাগি করে খেয়েছেন তারা।

এই কেন্দ্রেই আশ্রয় নিয়েছেন আয়েশা বেগম (৬৭) নামে আরেক নারী। তিনি অন্ধ। ৪৭ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। গ্রামে ভাঙাচোরা ছোট একটি ছাপড়া ঘরে বসবাস করতেন তিনি। বানের পানিতে ভেসে গেছে তার ছোট্ট ঘরটিও।
বৃদ্ধা আয়েশা বললেন, 'অন্ধ হইলেও বাবা আমি এমুন বিফদে কোনদিন পড়ি নাই। গেছেকাইল দুই মুঠ চিড়া খাইছলাম, এইহানে অন্যরারও খাওন নাই। আমারেই বা কি খাওয়াইব।'

কেন্দ্রটিতে আশ্রয় নিয়েছেন মো: বসু মিয়া (৫৭)। তিনি গ্রামের মধ্য পাড়ার বাসিন্দা। তিনি বলেন, তার ঘরে কোমরপানি। ধান-চাল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গরু তিনটা অন্য বাড়িতে বেঁধে রেখে পরিবারের চার সদস্যসহ এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তারাও না খেয়ে আছেন।

বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের দুই ভাই মিস্টার মিয়া (৪৬) ও মিঠু (৩৩) তাদের বৃদ্ধা মা রইছা বানুসহ পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে এই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের শিশু সন্তানেরা খাবারের জন্য কাঁদছে। তাদের কেউই সরকারি ত্রাণ পাননি। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ শুকনা খাবার দিয়ে গেছেন। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। সুপেয় পানির অভাবও প্রকট এখানে। শুধু আশ্রয়কেন্দ্র নয়, যারা কোনো রকমে ঘরবাড়িতে রয়ে গেছে, তারাও বলছে খাবারের অভাবের কথা।

গ্রাম ঘুরে মানুষের সাথে কথা বললে তারাও দাবি করেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের দেয়া ত্রাণসহায়তা তারা পাননি। গ্রামের বেশিরভাগ টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে। সুপেয় পানি সংকটেও আছে মানুষ।

সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, ' আমার ইউনিয়নে ৫০ ভাগ বাড়িঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। খুব অসহায় অবস্থায় আছে মানুষ। সরকারিভাবে যা ত্রাণ পাচ্ছি। সাথে সাথে দুর্গতদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছি। মাত্র এক টন চাল আমি পেয়েছি। এগুলো গতকাল বুধবার ডুবি গ্রামে বিতরণ করেছি। তবে দুর্গতদের তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল। নতুন করে মাত্র দুই মেট্রিক টন চাল পেলাম। ভাটিবরাটিয়া গ্রামে আজকালের মধ্যে তা বিতরণ করব।’

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আবু হাসান মোবাইল ফোনে নয়া দিগন্তকে বলেন, বন্যাদুর্গতদের সবারই খাবার অভাব। নিকলী উপজেলায় এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ২০ মেট্রিক টন (২০ হাজার কেজি) চাল, ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। এসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।