Naya Diganta

ট্রাম্প ও বাইডেন, সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের দুই রূপ

জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

সামনের দিনগুলোতে গ্লোবাল পরিসরে যুদ্ধ-লড়াই ক্রমেই ‘জাত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হিসেবে’ খাড়া করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। মানে, কারা নৃতাত্ত্বিক-জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ যেন এ নিয়ে হতে যাচ্ছে লড়াইটা- এ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। কথাটা আরো সরাসরি করেও বলা যায়। যেমন পশ্চিমা শক্তি আসলে সোজা বলতে চাইছে, আগামী যেকোনো যুদ্ধ-লড়াই তারা ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব’-এর লড়াই হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। অর্থাৎ বাস্তবে তারা আগেই জানত ও জানে যে, দুনিয়াতে কোন নৃতাত্ত্বিক-জাতি শ্রেষ্ঠ- এই অনুমান বা তুলনা করাটাই অর্থহীন। প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই একেক দিকে বিশেষত্ব থাকে, থাকতে পারে। কিন্তু মূল কথা, অজুহাত বা সাফাইয়ে আমরা কেউ কারো অধীনে অধীনস্থ হতে পারি না। অতএব ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই’ বলে কিছুই নেই।

তবু দুনিয়াতে আমরা দেখেছি সাড়ে তিন শ’ বছরের কলোনি দখল ও লুটের শাসন চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত যার ভুয়া সাফাই ছিল এটিই যে,পশ্চিমা সাদা ককেশীয়রা ছিল ‘বেশি সভ্য’। কাজেই তারা আমাদের মতো দেশের ওপর শাসন কায়েম করবে লুট করবে, এ উছিলায় যে, তারা আমাদের সভ্য বানাবে ইত্যাদি।

সবচেয়ে বড় কথা, মনে করা হয়েছিল মুখ্যত জার্মান হিটলার ও তার দোসর-বন্ধুদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পতনের মধ্য দিয়ে হয়তো দুনিয়া যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছে। ফলে বর্ণবাদ বা রেসিজম এই জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদ সেবার পরাজিত হওয়ার পর ক্রমেই এই চিন্তা হয়তো চাপা পড়ে যাবে। এ ছাড়া মানুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিপদ ও চরম খারাপ দিক সম্পর্কে জেনে গেছে। ফলে এই চিন্তা আবার জেগে ওঠার সুযোগ নেই। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে এই পশ্চিমা শক্তিই খোদ এবার রেসিজম, এই পুরনো ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদী’ হয়ে ফিরতে চাচ্ছে।

নয়া চলতি শতক হবে অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকার পতন ও চীনের উত্থানের সময়কাল। তাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছি এটি অবজেকটিভ মানে মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ এক ফেনোমেনা। যেমন আমেরিকান কোনো প্রেসিডেন্ট কোনো যুদ্ধ লাগিয়ে চীনা উত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করবেন হয়তো কিন্তু তাতে এটি ঠেকবে না। অন্তত সেই ২০১৪ সাল থেকে তাই নিয়মিত বলে আসছি যে, এককালে পুরনো ব্রিটিশ কলোনি সাম্রাজ্যও পেছনে পড়ে যেমন উত্থিত আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল আর নানা ঘটনাপ্রবাহ শেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা এক গ্লোবাল নেতা হয়ে উঠেছিল, আজ প্রায় ৭৫ বছর পরে এটি আবার পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। এবার চীনা উত্থান মানে চীনের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়, এই অ্যাকুমুলেশন ব্যাপক ও সবাইকে ছাড়িয়ে হাজির হওয়া শুরু হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক সক্ষমতাতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে; ঠিক যেমন এককালে আমেরিকা ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

আমেরিকার এই ক্রমেই পতন ও চীনের ক্রমেই উত্থান প্রমাণিত সত্য হিসেবে আমেরিকার ন্যাশনাল সার্ভেতেও স্পষ্ট হয়ে চলেছে। গত ২০০৮ সাল ছিল এ নিয়ে প্রথম পরিসংখ্যানগত প্রকাশিত সার্ভে রিপোর্ট ও প্রমাণ, যা এরপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর আরো স্পষ্ট করে একই রিপোর্ট তুলে ধরছে। এ নিয়ে বুশ বা ওবামা আমলে তারা উভয়েই দুই টার্ম করে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের মিলের দিকটি হলো এই দুই প্রেসিডেন্টই সার্ভে রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু নিজ সার্ভে রিপোর্টও মানতে চাননি। অস্বীকার করে গেছেন, ‘এতে তেমন কিছু হবে না’ ধরনের কথা দাবি করে। তবে তলায় তলায় উভয়েই এশিয়ায় চীন ঠেকানো বা চীনা কনটেইনমেন্ট পলিসি নিয়েছেন। সেটি হলো, ভারতের পিঠে হাত রেখে চীন ঠেকানোর নীতি।

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো তারা উভয় তাদের প্রেসিডেন্টশিপের মোট ১৬ বছর ধরে দেখেছেন এতে আমেরিকার ফেভারে কোনো অগ্রগতি নেই। তবে কেবল কয়েক বছর পরে পরে চীনের উপরে চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকার জন্য নয়া কিছু বাণিজ্য সুবিধা আদায় করেছেন, চীনও দিয়েছে। কখনোই তাদের নিরাশ করেনি। এভাবেই চলে আসছিল এমনকি এত পাগলাটে ও জাতিবাদী ভাব দেখানো ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। তিনিও একইভাবে চীনের কাছে দাবি করেছেন আর এতে নয়া কিছু বাণিজ্য সুবিধা তিনিও পেয়েছেন। এমনকি সর্বশেষ তা ২০১৭ সালেও যে বছর প্রথম ‘কোয়াড’ (আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত এই চার দেশের) জোটকে চাঙ্গা করা হয়েছিল তখনো ট্রাম্প সুবিধা পেয়েছিলেন।

কিন্তু এর পরই আমেরিকাকে ট্রাম্প এক মহাপরিবর্তনের দিকে মোচড় দিয়েছিলেন। সেটি হলো সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ। শুরু থেকেই এই ঝোঁক-অভিমুখ সাথেই ছিল ট্রাম্পের। তবে প্রথম দিকে খাপ ছাড়া বা অস্পষ্টতার কারণে সাধারণ্যে তা হয়তো স্পষ্ট হয়নি। যেমন ধরা যাক স্টিভ ব্যাননের কথা। তিনি ছিলেন আগে ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর পরে ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের পরে হন প্রেসিডেন্ট অফিস হোয়াইট হাউজের প্রধান উপদেষ্টা যদিও তিনি মাত্র সাত মাস এই পদে ছিলেন। আর এরপর ওই সৃষ্টপদটাই আবার অবলুপ্ত করে দেয়া হয়। রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে এই ব্যানন ছিলেন ‘সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী’। শুরুর থেকেই তার এত উগ্র অবস্থান ট্রাম্প নিতে পারেননি; যদিও ট্রাম্প যতই ক্ষমতামলের শেষের দিকে গেছেন ততই তিনি আরো বেশি ও প্রকাশ্যে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী (হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট) গ্রুপের ওপর তার নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে গেছেন।

গত ২০২০ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলে এর পরের তিন মাস তিনি লাগাম ছাড়া তিনি আর রিপাবলিকান না, যেন সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মূল নেতা হয়ে ওঠেন। আর এরই সবচেয়ে বড় প্রকাশ তিনি ঘটান ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে। ওই দিন সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা আমেরিকান সংসদ বা কংগ্রেস ভবন দখল করে নিয়েছিল ও এর শিখরে উঠে কংগ্রেসে তাদের রাজত্ব কায়েম করে ছাদে দেয়ালে নাচানাচি-বিজয় প্রকাশ করেছিল। সরকারি হিসেবে ওই দিন সাতজনের মৃত্যু ও কয়েকজনের আহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে ঘটনা শেষ হয়।

সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা জাত-শ্রেষ্ঠত্ববাদী বলতে এরা কারা
বাংলাদেশের মতো পাঠকদের মধ্যে সাধারণ্যে ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব’ কথাটা অনেকের কাছে আবছা ধারণায় থাকতে পারে বা তা খুব একটা পরিষ্কার না এমন হতে পারে। তাই এ নিয়ে আগে একটু কথা বলে নেই। শব্দটার মূল বিষয় ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা’ বা নিজেকে সব ব্যাপারে, অন্য এথনিক জনগোষ্ঠীর চেয়ে ধর্ম-জাতি ইত্যাদি যেকোনো দিকে শ্রেষ্ঠ-বোধ করা। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে সুপ্রিমিস্ট, ইংরেজি ‘সুপার’ বা সবার চেয়ে ভালো- এ ধারণা থেকে ‘সুপ্রিমিস্ট’ শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এই সুপ্রিমিস্ট শব্দেরই খাস বাংলা হলো শ্রেষ্ঠত্ববাদী। বলাবাহুল্য, সুপ্রিমিস্ট বা শ্রেষ্ঠত্ববাদী এগুলো নেতিবাচক শব্দ। এগুলো শুধু নেতিবাচক শব্দই নয়, এটিকে ইংরেজিতে বলে ‘ডেরোগেটরি’ শব্দ মানে, বাংলায় বললে কাউকে ইচ্ছা করে ‘নিচা দেখানোর’ জন্য এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষের নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ- এই বোধ তাদের কেউ কেউ আনে কেন? এটির দরকার কী? যখন থেকে মানুষ টের পেয়েছে নিজের গায়-গতরের শ্রমে সম্পদ জোগাড়ের চেয়ে সহজ ভিন্ন পথ আছে। সেটি হলো, অন্যের শ্রম-সম্পদ লুটে খাওয়া ও নেয়া, অন্যের কাঁধে চড়ে খাওয়া ইত্যাদির জন্য অন্য পুরো জনগোষ্ঠীকেই নিজ অধীনস্থ করা বা বাধ্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা।

কিন্তু তাতেও পেছনে আরো বড় কাহিনী আছে। দুনিয়াতে মানুষের থিতু হয়ে কৃষিকাজভিত্তিক জীবনযাপন শুরু করা বলা হয় মোটামুটি প্রায় ছয় হাজার বছর বয়সী। সে কারণে এখান থেকেই আমাদের তৎপরতাকে আমরা সভ্যতা বলি বা ‘সিভিলাইজেশন’-এর শুরু বলা হয়। আর দুনিয়াতে এমন সভ্যতার জীবন বা কৃষিকাজে মানে থিতু হয়ে কোনো ভূগোলে বসবাস শুরু করা, যাযাবর জীবন ত্যাগ করা- এসবই শুরু হয়েছিল, কোনো একটি সভ্যতা নয়। আসলে অন্তত দশের অধিক বিভিন্ন সভ্যতা প্রায় কাছাকাছি সময়ে (কিন্তু পরস্পর সম্পর্কে একেবারেই না জেনে, যোগাযোগ ছাড়াই) শুরু হয়েছিল। যেমন এসব সভ্যতার বিচারে আমরা ‘সিন্ধু সভ্যতার’ অংশ (যার মূল ভূখণ্ড এখন পাকিস্তানের অংশ)। আর এর ভেতরেও আবার অনেক নৃতাত্ত্বিক-জাতির জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিল, যার মধ্যে আমরা বৃহত্তরভাবে সিন্ধু সভ্যতার অংশ হলেও এর ভেতরের বাঙালি- এ নৃতাত্ত্বিক-জাতির অন্তর্ভুক্ত বা অংশ। যেমন এশিয়ায় আমাদের কাছাকাছি সবচেয়ে প্রভাবশালী আরেক সভ্যতার নাম হলো মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক-কুয়েত)।

আগের দিনে এথনিক জনগোষ্ঠী বা সভ্যতাগতভাবে সঙ্ঘাত হয়নি এমন নয়। তবে ধরনটা ছিল যে, দেশ যুদ্ধ-মারামারিতে অন্যের দখল পেয়েছে দখলদার সে ভূমিতেই এর পর থেকে নিজেও বসবাস শুরু করেছে। এটিই প্রধান ধরন ছিল। পরবর্তীতে টেকনোলজির কারণে কলোনি দখল যুগ (১৬০৭-১৯৪৫) শুরু হয়েছিল। আর এর একমাত্র ধারা হয়ে যায় ইউরোপ যারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা সব মহাদেশকেই কলোনি, নিজের শিকার বানিয়ে নিয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের এই লুটেরা শাসন চলেছিল। কিন্তু এটি বিশেষ লক্ষণীয় যে, এই প্রথম ইউরোপীয় কলোনিবাজ দখলদাররা দখলের পরে সাথে এ কাজের পক্ষে সাফাই বক্তব্যও দেয়া শুরু করেছিল। এই প্রথম আমরা কে সভ্য আর কে নয় এ নিয়ে তুলনা হতে দেখেছিলাম। আর এ থেকে দেয়া সাফাইটা হলো যেমন, এশিয়ায় আমাদের চেয়ে ইউরোপীয় দখলদাররা ‘ভালো সভ্য’ বা ‘বেশি সভ্য’ বলেই যেন তারা আমাদের সভ্যতা শিখাতেই আমাদের দেশ দখল করেছে। এ থেকেই শুরু হয় সভ্যতা শব্দটার শঠতা বা ছলনার নেতি ব্যবহার। যেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া আমাদের সভ্যতা শিখাতে এসে আমাদের স্থায়ী মজুদ বা উদ্বৃত্ত সম্পদ সবই নিরন্তর লুট করে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের কাজ।

আসলে সরাসরি বললে আমরা শ্রেষ্ঠ কিংবা আমরা অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ- এ ধারণা, এ অনুভবটা থেকেই সব অপরাধের শুরু হতে পারে। কারণ আপনি হয়তো সতর্ক থাকলেন কিন্তু অন্যে হয়তো আপনার কথাটাই অন্য জনগোষ্ঠীকে পদানত বা অধীনস্থ করার সাফাই হিসেবে ব্যবহার করবেন।

যেমন আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’; এদের মূল কথা হলো, তাদের গায়ের চামড়ার সাদা (বলতে চায় সাদা ককেশীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী) অতএব তারা অন্য সব মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আসলে ইঙ্গিতে বলতে চায় তারা চার-পাঁচ শ’ বছর অনেক জনগোষ্ঠীকেই অধীনস্থ করে রাখতে পেরেছিল তাই তারা শ্রেষ্ঠ। তবে একালে ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’ চিন্তা ফিরে জেগে ওঠার কারণ একটু ভিন্ন।

চীনের উত্থানে আমেরিকান ইকোনমির পতন বা তাদের অন্ততপক্ষে রি-অ্যাডজাস্টমেন্ট (ভিন্ন কাজ ভিন্ন দেশ ইত্যাদি) একটি খুবই স্বাভাবিক বা প্রায়ই ঘটা ঘটনা হিসেবে উঠে আসছে। বড়রা অনেকেই তো বটেই, মিডল ক্লাসের ব্যবসা বা চাকরি টলায়মান হয়ে উঠছে। আর এদের ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’ বয়ানটা হলো, এমন যে, আগে তারা সুন্দর দিন ‘কাটাইত’! কিন্তু এখন কালো বা বাদামি চামড়ার লোকেরা তাদের দেশে আসাতেই নাকি তাদের চাকরি-ব্যবসার সব সুবিধা এরা নিয়ে গেছে।

আসলে, স্বভাবতই এখানে অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনের কারণ, পশ্চিমা দেশ থেকে সাদা চামড়া অন্য দেশে বেরিয়েছে বা অন্য চামড়ার সস্তা শ্রমিক পশ্চিমা দেশে থাকার অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু যেকোনো উগ্র জাতিবাদের মতো এই হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট সত্য-মিথ্যা মিলিয়েই কথা বলবে। মূলকথাটা সোজা- যখন পশ্চিমা কোনো দেশের অর্থনীতি ভালো চলে তখন বাইরের আমাদের মতো দেশের সস্তা পেতেই তো মাইগ্রেটেড শ্রমিক সে আমদানি করবে। কাজেই অ-সাদা চামড়াদের তখন ভালো লাগবে যখন পশ্চিমা দেশে অর্থনীতি ভালো চলবে। এর সাথে কোনো রঙের গায়ের চামড়ার মানুষ ভালো অথবা শ্রেষ্ঠ- এটা ডাহা মিথ্যা ও ভুয়া কথাবার্তা। কিন্তু তবু পশ্চিমের ঘৃণায়, নরওয়ে বা সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসে মুসলমান বলে হত্যাকাণ্ডগুলো প্রায়ই উঠে আসছে।

তবে চীনা উথান হলেই সেটি সাদা চামড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা না খেয়ে মরবে, ঠিক তা নয়। তবে সুযোগ সুবিধা কমে যেতে পারে। আবার তারাও এশিয়ায় মাইগ্রেটেড (লেবার, টেকনিশিয়ান বা যেকোনো স্পেশালাইজড) হলে তারাও ভালো করবে যেভাবে গত অন্তত শ’বছর আমরা এশিয়ানরা এভাবেই নিজেদের ভাগ্য খুলবার চেষ্টা করে এসেছি।

একই সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের দুই রূপ ট্রাম্প ও বাইডেন
ট্রাম্প সম্পর্কেই উপরে বেশি কথা লিখেছি তা হলে ট্রাম্পই কেবল খারাপ আর বাইডেন ভালো, তিনি জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট নন অথবা কম? তাই কি?

তার যুগে বাইডেন সবচেয়ে বড় হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট হিসেবে হাজির হতে চাইছেন। এখন এটি একেবারেই পরিষ্কার যে, বাইডেন আরো বড় হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট পরিকল্পনা নিয়েই ২০২১ সালে শপথ নিয়েছিলেন। তা হলে ট্রাম্প ও বাইডেন দু’জনই কি সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী? সাধারণ উত্তর হ্যাঁ-সূচক। কিন্তু দু’জনের কাজের ফিল্ড বা ফোকাস ভিন্ন। ট্রাম্প অভ্যন্তরীণভাবে মূলত আমেরিকার ভেতরে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। আর বাইডেন সারা পশ্চিমাশক্তি মিলে, যার মধ্যে ইউরোপীয় নেতারা শামিল আর ব্যতিক্রমী জাপানিজরা। তারা মনে করে, গত পঁচাত্তর বছরে পুরনো আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব তারা আরো কিছু দিন যেভাবেই হোক ধরে রাখবেন।

এতে সবচেয়ে যেটা বড় বিভ্রম ও জিদ তা হলো ইকোনমিক নেতৃত্বটা যেন সাবজেক্ট বা ব্যক্তি ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়। যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দাসখতে রাজি না হয়েও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার পুরনো গ্লোবাল অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হিটলারের হাত থেকে বাঁচাতে পারত। বাইডেন আসলে এর থেকেও এককাঠি ওপর দিয়ে চলেছেন। বাইডেন মনে করছেন, পাঁচ শ’ বছর ধরে সাদা চামড়ার শাসন দুনিয়ায় চলছে। এ শাসন চীনের (অ-সাদা) নেতৃত্বের তলে পড়তে পারে না, যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখতেই হবে- এ উসকানি দিয়ে বাইডেন নিজ গ্লোবাল নেতার সুপ্রিমিজম যেন তিনি ধরে বা টিকিয়ে রাখতে সফল হবেন- এই হলো তার বাজনার মূল সুর।

কিন্তু বাইডেনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের প্রমাণ কী?
বাইডেন প্রশাসন এত দিন ঠিক কী বলে ইউরোপকে ইউক্রেন যুদ্ধে শামিল করেছেন, তা পাবলিকলি খোলাসা করেননি। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল। আজ তা নিয়ে একটু ডিটেইল ব্যাখ্যা করেছেন বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের দুই মন্ত্রী কর্তা- পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ও ট্রেজারি বা অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন। দুটোই লম্বা পলিসি বক্তব্য। আমেরিকার আটলান্টিক কাউন্সিল নামে এক থিংকট্যাংক আছে, এর এক বক্তৃতায় জ্যানেটের বক্তব্য গত ১৩ এপ্রিলে। আর ব্লিঙ্কেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তৃতা দিয়েছেন গত ২৬ মার্চ ২০২২। সেখানেই তিনি ‘চীনা সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের পলিসির রূপরেখা’ দিচ্ছেন বলে এ বক্তৃতা দিয়েছেন।

এখনকার সার কথাগুলো বোঝা খুব সহজ। মুখ্য শব্দগুলোর দিকে খেয়াল রাখলেই বোঝা যাবে। যেমন- এক. ইউনিভার্সাল ভ্যালু; ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার, ইন্টারন্যাশনাল রুল বেজড অর্ডার; দুই. ইকোনমিক অর্ডার, ইন্টারন্যশনাল ল, প্রিন্সিপাল ও প্রতিষ্ঠান; তিন. রাশিয়ার সাথে চীনের অ্যালায়েন্স ইত্যাদি।

এসব কিছুর সার কথা একটাই- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত যেন আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসঙ্ঘ ও আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল চীন এগুলোর কেউ নয়। এ-সংক্রান্ত সব মূল্যবোধ ও ইউনিভার্সাল মূল্যবোধের বাইরে চীন।

তা হলে ব্লিঙ্কেন এখন কী করবেন?
তিনি স্বীকার করে বলছেন, ‘চীন হলো একমাত্র দেশ যার আন্তর্জাতিক অর্ডার বদলে ফেলার ইচ্ছা ও সামর্থ্য আছে- যে সামর্থ্য বলতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, কূটনীতিক, সামরিক ও টেকনোলজিক্যাল সব বোঝায়। কিন্তু চীনের আর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ এক নয়।’

তা হলে ব্লিঙ্কেনের প্রতি এখন প্রথম প্রশ্ন হলো, যদি চীন আর আমেরিকার মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মূল্যবোধ বা কাম্য ও প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ার নিয়ম-শৃঙ্খলা বা গ্লোবাল অর্ডারে মিল না থেকে থাকে তা হলে চীনের সাথে আমেরিকার এত দিন চলল কী করে? জাতিসঙ্ঘ গঠন হতে পেরেছিল কী করে? যদি ধরে নেই চীন পরে এসেছে, তবু জাতিসঙ্ঘের জন্মের থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সক্রিয় সদস্য ছিল। কলোনি মাস্টার ইউরোপ নিশ্চয় সেকালের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মূল্যবোধ ও অর্ডার-শৃঙ্খলা (ব্লিঙ্কেন কথিত) কায়েমের পক্ষে বা দোস্ত ছিল না। তা হলে সেকালের রুজভেল্ট একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকেই গোনায় ধরে গ্লোবাল অর্ডার সাজাতে হয়েছিল? তা হলে আজ অন্য যে কাউকে বাইডেনের এত বিতৃষ্ণা কেন?

আবার সত্তরের দশকে কিসিঞ্জারের আমেরিকা বাংলাদেশের স্বার্থসহ দুনিয়ার সব মূল্যবোধকেই পায়ে দলে চীনের মন পেতে কি ছুটে যাননি? তখন সেটি কি আমেরিকার বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তিতে পা ফেলা ছিল না? তা হলে তখন আজকের তোলা মূল্যবোধের কথা কোথায় ছিল? টানা সাত বছর (১৯৭১-৭৭) চীন-আমেরিকার নেগোসিয়েশন চলেছিল- উভয় উভয়কে যা কিছু সব বুঝে নেবার সময় হিসেবে শেষে ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হয়েছিল। তা হলে তখন আরো কড়া কমিউনিস্ট চীনকে সহ্য হলে এখন লিবারেল চীনকে অসহ্য লাগা শুরু হবে কেন? আমেরিকান পুঁজি ওয়াল স্ট্রিটের সেকালে অবাধে চীনের বাজারে প্রবেশের সুযোগ, অনুমতি দেয়ায় যদি তখন চীনকে ভালো মনে হয়ে থাকে- মূল্যবোধে কোনো সমস্যা না দেখা দিয়ে থাকে, তা হলে এখন এমন কী ঘটেছে সেটি বাইডেনের আগে স্পষ্ট বলতে হবে। সুপ্রিমিজম করতে দেয়া হবে না।

যদিও চিয়াংকাইশেকের জাতিবাদী চীন ১৯৪৫ সাল থেকেই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য; কিন্তু ১৯৪৯ সালে মাওয়ের বিপ্লব হয়ে যায় মূল চীন ভূখণ্ডে। চীন জাতিসঙ্ঘেরও সদস্য ছিল না। পরে ১৯৭১ সালে তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে মূল চীন জাতিসঙ্ঘ জন্মের সময়ের ভেটো-ওয়ালা সদস্যপদ ফিরে পেয়েছিল। আর একইভাবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সক্রিয় মেম্বার হচ্ছে ১৯৮০ থেকে। এমনকি মাওয়ের চীন, মূলচীন ডব্লিউটিওয়ের সদস্যপদ নেয় আরো পরে, ২০০১ সালে। তা হলে জাতিসঙ্ঘ বা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ধরনের প্রতিষ্ঠানের ইন্টারন্যাশনাল মূল্যবোধ না বুঝে থাকাটার আর কি চীনের বুঝতে বাকি ছিল?

আসলে এসব প্রশ্নের উত্তরে ব্লিঙ্কেনের খবর নেই। যেন তাদের কথা একটিই, তাদের সাদা চামড়ার নেতৃত্ব তাদের স্থায়ী করে দিতেই হবে। না হলে চীনা মূল্যবোধ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলবেন।

সবশেষে, বাইডেন সম্ভবত বুঝেছিলেন তারা কথার মেরুদণ্ড নেই- খামোখা কথা বলছেন। তাই এবার তিনি বলে বসেন, ‘চায়নার বন্ধু রাশিয়ার’ হুমকিতে তারা ভীত। অতএব, এটি চীনের দায়। ইউক্রেনের যুদ্ধও চীনের দায়!
এক কথায় বললে, সাদা চামড়া সুপ্রিমিজম, জাত শ্রেষ্ঠত্ব এভাবেই ডুবে যাবে বাইডেনের আমেরিকা।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com