Naya Diganta

জীবনের অঙ্ক কেন সবসময় মেলে না

গোলাম মাওলা রনি

আজ আপনাদের এমন একজন লোকের কাহিনী শোনাব যিনি জীবনের সব ক্ষেত্রে অঙ্ক মেনে চলতেন। তিনি জানতেন, অঙ্কই হলো সব বিজ্ঞানের মা। সুতরাং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা অধ্যয়নের পাশাপাশি অঙ্ক নিয়ে তার আদিখ্যেতা তাকে প্রায়ই প্রিয়জনের কাছে এক অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত করেছিল। জীবন সম্পর্কে তার দর্শন ছিল এরূপ যে, কোনো জীবনেই সাধারণত অলৌকিক কিছু ঘটে না। অলৌকিক কিছু পেতে হলে মানুষকে এমন কিছু করতে হবে যা লোকসমাজে অপ্রচলিত এবং সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার বাইরে যা কি না খুবই জটিল-দুরূহ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বিরাটসংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা লোকসমাজে বাস করে, সাধারণ মানুষের মতো চিন্তা-চেতনা ধারণ করে এবং কোনো পরিশ্রম ছাড়া অর্থাৎ বিজ্ঞানের সূত্র অনুসরণ ছাড়া কেবল তসবি বা রুদ্রাক্ষের মাল্য ধারণ করে অলৌকিক কিছু আশা করতে করতে ধরাধাম ত্যাগ করে।

আমি যে ভদ্রলোকের কথা বলছিÑ তিনি ধর্মশাস্ত্রে বড়মাপের পণ্ডিত। ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বস্তরের আবেদ। কিন্তু তা সত্তে¡¡ও তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দুই টাকার কর্ম করে তিন টাকার ফলাফলের আশা করা গুনাহের কাজ। দুর্বল শরীর নিয়ে কঠোর শ্রম যেমন অন্যায়, তদ্রƒপ শক্তিশালী দেহ নিয়ে অলস সময় পার করা গুরুতর অন্যায়। তার মতে, মানুষের জন্য দেহতত্ত¡ জানা ফরজে আইন। কোন খাবারে দেহ শক্তিশালী হয়Ñ মাথায় বুদ্ধি আসে এবং কী করলে শরীর-মন ভালো থাকেÑ তা না জানলে কোনো পরিশ্রম যেমন সফলতার মুখ দেখে না তদ্রƒপ ধর্মকর্মেও শান্তির পরিবর্তে বিষাদ চলে আসে। আবার বুদ্ধিনাশক খাবার-পানীয় অথবা সঙ্গী-সাথী-পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন না থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে কাক্সিক্ষত মাকামে পৌঁছা অসম্ভব।

ভদ্রলোক মনে করতেন, অঙ্কের পাশাপাশি ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজি সম্পর্কে সব মানুষেরই সাধারণ জ্ঞান থাকা উচিত। এগুলো ছাড়া ধর্মের জ্ঞান প্রায়ই অনাহূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মানুষের বিয়ে-শাদি, সন্তান-সন্ততি লাভ, গর্ভধারণ, প্রসব ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস এবং আচার অনুষ্ঠান ছাড়া জীবন যে অচল তাও তিনি বিশ্বাস করতেন। ফলে তার কাছে আর্কিমিডিস, পিথাগোরাস থেকে শুরু করে ইমাম গাজ্জালীর নিবন্ধ যেমন আকর্ষণীয়, তদ্রƒপ শেখ সাদী, রুমি, মীর্জা গালিব থেকে শুরু করে কাহলিল জিবরানের রচনাবলিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি এবং আধুনিক অস্ত্রোপচার ইত্যাদি চিকিৎসা যেমন বিশ্বাস করেন তদ্রƒপ দোয়া-দরূদ, ঝাড়ফুঁকের প্রয়োজনও অস্বীকার করেন না।

ভদ্রলোক বিয়ে করার আগে হবু স্ত্রীর বংশ, রক্তের গ্রæপ, আইকিউ, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্মবোধ ইত্যাদির খোঁজ-খবর নিলেন। স্ত্রীর বংশে কয়জন বেয়াদব আছে এবং ভদ্রলোকের সংখ্যা কত তাও জানলেন। পাশাপাশি, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, লেনদেনের ইতিহাস, স্ত্রীর রূপ-লাবণ্য, ধর্মকর্ম এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণের খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিয়ের কথা পাকা করলেন। বিয়ের পর তিনি দেখলেন, সব কিছুই ঠিক আছে, কিন্তু হিসাবের অঙ্কে কয়েকটি ভুল রয়ে গেছে। বউ ঠিক মতো দাঁত মাজে না এবং হাত-পায়ের নখ কাটে না। এর বাইরে বউয়ের কোকিলকণ্ঠের অত্যন্ত সুনাম ছিল কিন্তু রাগ হলে কোকিলের কণ্ঠ যে কতটা কর্কশ হতে পারে তা তিনি বিয়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই টের পেলেন এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে ধর্মচর্চা বাড়িয়ে দিলেন।

ভদ্রলোক কর্মজীবনে বেশ সফল ছিলেন। ফলে দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার কারণে স্ত্রীর ময়লাযুক্ত নখ-দাঁত তার চোখে পড়ত না। ফলে তিনি আবার নতুন করে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করলেন। প্রেমময় দাম্পত্য, সুসন্তান পয়দা করার কলাকৌশল এবং সন্তানকে সুসন্তানরূপে বড় করার বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং ধর্মীয় বইপুস্তক নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন শুরু করলেন। এরই মধ্যে তার স্ত্রী গর্ভবতী হলেন। তিনি স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য সারাক্ষণ স্মার্ট পুরুষ হিসেবে নিজেকে সাজিয়ে স্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করলেন। গর্ভবতীর সুস্বাস্থ্য ও হাসিখুশি মন-মানসিকতার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করলেন। নামাজ-কালাম-কুরআন তিলাওয়াত, দোয়াসহ বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার, উন্নত চিকিৎসা ও ভোর বেলায় কয়েক মাইল ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। ফলে নির্ধারিত দিনে তাদের একটি সবল-সুস্থ ও আকর্ষণীয় চেহারার হৃষ্টপুষ্ট পুত্রসন্তান প্রাকৃতিকভাবে, কোনোরকম কায়ক্লেশ ছাড়াই ভ‚মিষ্ঠ হলো।

নবজাতকের মুখ দেখে ভদ্রলোকের বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাস বেড়ে গেল এবং ধর্মকর্মের প্রতিও আস্থা ও নির্ভরতা বৃদ্ধি পেল। তিনি ধর্মীয় বিধিমতে ছেলের নাম রাখলেন এবং শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে গিয়ে শেখ সাদীর গুলিস্তান পুস্তকের একটি কাহিনী পড়ে ভয় পেয়ে গেলেন। শেখ সাদী লিখেছেনÑজনৈক ব্যক্তির দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো সন্তান হচ্ছিল না। গ্রামের লোকজন পরামর্শ দিলো, গ্রাম পেরিয়ে যে ঘন জঙ্গল রয়েছে সেখানে নির্দিষ্ট একটি বৃক্ষ রয়েছে। তুমি সেই বৃক্ষের তলে বসে ইবাদত করতে থাকো। লোকটি গ্রামবাসীর পরামর্শে বৃক্ষতলে গেল এবং ১৭ বছর সাধনা করে একটি পুত্রসন্তান লাভ করল। সেই পুত্র যৌবনে পদার্পণ করল এবং গ্রামবাসীর কাছে বিজ্ঞাসা করলÑ সেই বৃক্ষটি কোথায়। আমি সেখানে যাবো এবং বৃক্ষতলে সাধনান্তে প্রার্থনা জানাবÑ আমার বাবা যেন মরে যায়।

শেখ সাদীর বই পড়ে ভদ্রলোকের মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভালোবাসার নিম্নগামিতা এবং ঊর্ধ্বগামিতা নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন করলেন। শিশুর মানসিক বিকাশ এবং কী কারণে সন্তানসন্ততি পরিণত বয়সে বাবা-মাকে ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে, এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে করতে তার গৃহে আরো কয়েকজন সন্তান-সন্ততির আগমন ঘটল। তারা সবাই সুদর্শন, সুদর্শনা, মেধাবী, স্মার্ট, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বিনয়-ভদ্রতা ও কাণ্ডজ্ঞানে সব মহলের প্রশংসা পেতে থাকল। তারা একত্রে খায়-দায়-ঘুমায়, খেলাধুলা করে এবং নানা রকম শিশুসুলভ কর্মকাণ্ড দ্বারা মা-বাবার চক্ষু ও অন্তর শীতল করে দেয়। এরই মধ্যে বড় সন্তানটি একদিন ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে ধরল, তারপর বললÑ ও আমার সোনা বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ভদ্রলোক কৌত‚হলবশত জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ভালোবাসো। শিশুটি বলল, আমি তোমার পায়খানাও খেতে পারি। পুত্রের কথা শুনে ভদ্রলোক আড়ালে চলে গেলেন এবং আবেগে অনেকক্ষণ ধরে অশ্রæ বিসর্জন করলেন।

ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল এবং ভদ্রলোক লক্ষ করতে থাকলেন যে, তার জীবনের অঙ্কগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তারা মা-বাবার সান্নিধ্যের চেয়ে বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্য পছন্দ করছে বেশি। পারিবারিক শিক্ষার চেয়ে বাইরের দুনিয়ার যেকোনো বিষয় তাদের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হতে থাকল। লুকোচুরি, টুকটাক মিথ্যা বলা এবং মাঝে মধ্যে বাবার মানিব্যাগ থেকে সংগোপনে টাকা চুরির মতো গর্হিত কাজগুলো দৃশ্যমান হতে থাকল। ভদ্রলোক একবার বিজ্ঞানের বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টান আবার ধর্মীয় পুস্তকে চুমু খেয়ে অশ্রæজলে সেখানে কী যেন খুঁজে বেড়ান। কিন্তু কিছুতেই জীবনের অঙ্ক আর মেলাতে পারেন না। ডাক্তার, কবিরাজ, মনোবিজ্ঞানী, জ্ঞানী-গুণী, পীর-ফকির থেকে শুরু করে শ্রদ্ধাভাজন ময়মুরব্বিদের দোয়া ও দাওয়া নিয়েও বিজ্ঞানের সূত্র কিংবা ধর্মীয় অলৌকিকতার সমন্বয় না করতে পেরে হতোদ্যম হয়ে পড়েন।

কয়েকজন আধুনিক মনা সফল বন্ধুর পরামর্শে ভদ্রলোক তার আজীবন লালিত নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলার বন্ধন কিছুটা আলগা করেন। সন্তানদের ধর্মকর্ম পালন, রাত্রি জাগরণ, দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারে ছাড় দিতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেন। নিজের সফলতা সুখ-শান্তির বিষয়ে এতদিন তার যে আত্মবিশ্বাস ছিল সেখানে ফাটল দেখা দেয়। তার শরীর স্বাস্থ্যে ব্যথা বেদনা ভর করে। ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কর্মে ভাটা পড়ে। ফলে জীবন খাতার হিসাব মেলাতে গিয়ে প্রায় দুই যুগ পরে লক্ষ করেন, সেখানে দেনার পরিমাণ বাড়ছে। এরই মধ্যে লক্ষ করলেন, তার সন্তানদের মন-মানসিকতা ও আচরণ ক্রমেই শেখ সাদীর গুলিস্তান পুস্তকে বর্ণিত কাহিনীর দিকে এগোচ্ছে। তিনি সাহস করে আবার জীবনের অঙ্ক নতুন করে শুরু করার চিন্তা করলেন এবং প্রকৃতি থেকে প্রাণশক্তি অর্জনের জন্য নদী-সমুদ্র, পাহাড়, শহর-বন্দর, পার্ক ইত্যাদি স্থানে বোহেমিয়ানের মতো ঘুরতে গিয়ে নতুন এক জীবনের সন্ধান পেলেন, যেখানে বীজগণিত পাটীগণিত কিংবা পদার্থবিদ্যা অথবা রসায়নশাস্ত্রের কোনো বালাই নেই।

ভদ্রলোক জীবনের অঙ্ক মেলাতে পাহাড়ে গেলেন। সাঙ্গু নদীর যে অংশটি গহিন অরণ্য এবং পাহাড় ভেদ করে ভয়ঙ্কররূপে প্রবাহিত হচ্ছে সেখানে বসবাসরত পরিবারের সাথে কথা বলে দেখলেন, ওখানে ভিন্নতর এক সুখময় আবেগ রয়েছে যার সাথে বিজ্ঞানের বা প্রচলিত ধর্মের কোনো সংযোগ নেই। কেবল মানবতা ও আত্মার বন্ধন দ্বারাই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীর কঠিনতম প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করে দিব্যি সময় পার করে দিচ্ছে এবং সন্তুষ্টচিত্তে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রতি তাদের কোনো ক্ষোভ নেইÑ নেই কোনো অভিযোগ। তারা কোনো অঙ্ক বোঝে না, কবিতা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কেবল মাথার ওপর যেদিন ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দোল খায় সে দিন তারা খুব করে দেশী মদ খেয়ে জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীর সাথে নতুন মাত্রার রসায়ন ঘটানোর জন্য সাঙ্গু নদীর জোয়ারের মতো উত্তাল হয়ে ওঠে।

পাহাড় ছেড়ে ভদ্রলোক সমুদ্রের কিনারে জেলে পল্লøীতে গেলেন। পচা শুঁটকি এবং জলদস্যুদের কাহিনী শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, তার জ্ঞান এতদিন অসম্পূর্ণ ছিল এবং হয়তো মৃত্যু পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞান বা অঙ্কের সূত্র দ্বারা তা পূরণ করা সম্ভব নয়। বরং তার ভেতরে এক ধরনের অনুশোচনা দেখা দিলো এই কারণে যে, তিনি এতদিন ধরে জীবনের অঙ্ক মেলানোর জন্য মূলত নিজেকে একটি শিকল দ্বারা আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন এবং শৃঙ্খলবদ্ধ হয়ে নিজের তৈরি কারাগারে আবদ্ধ থেকে মুক্তির গান গাচ্ছিলেন। তিনি অনুধাবন করলেন যে, এই পৃথিবীর কোনো পদার্থই চিরঞ্জীব নয় এবং কেউ কারো জন্যই অপরিহার্য নয়। সুখ-শান্তি এবং সম্পর্ক আপেক্ষিক এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সময়ের প্রয়োজনে সম্পর্ক যেমন তৈরি হয়, আবার সময়ের তোড়ে সম্পর্কগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এবং ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে কোনোভাবেই আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

ভদ্রলোক তার জীবন সায়াহ্নে এসে জীবনের জন্য নতুন করে অঙ্ক বিজ্ঞান রচনার খোঁজে রমনা পার্কে গিয়ে যে কাণ্ড ঘটালেন তা শুনলে আপনারা অবাক না হয়ে পারবেন না। সম্প্রতি তিনি দূরের জিনিস বিশেষ করে বড় বড় গাছের মগডালে বসে থাকা পাখপাখালি দেখার জন্য একটি ছোট অথচ শক্তিশালী দূরবীণ ক্রয় করেছেন। সেটা নিয়ে পার্কের নির্জন স্থানে গিয়ে বেঞ্চের ওপর শুয়ে তিনি পাখি, কাঠবিড়ালি দেখার পাশাপাশি দূর আকাশের কিছু নক্ষত্রও দেখতে পান। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি দৈনিক কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করেন। তার এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখার জন্য কিছু ছিন্নমূল কিশোর-কিশোরী, কয়েকটা পাগল, একটা পাগলী এবং কিছু নেড়ি কুকুর প্রায়ই জটলা করে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তিনি যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঊর্ধ্বলোকে তাকিয়ে থাকেন একইভাবে মর্ত্যরে প্রাণীগুলোও কোনোরকম শব্দ না করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি দূরবীণ থেকে চোখ ফিরিয়ে যখন তাদের দিকে তাকান তখন মনে হয় পৃথিবীতে এই প্রাণীগুলোর চেয়ে আপন কেউই নেই।

রমনা পার্কে তাকে নিয়ে যারা জটলা করে তাদের সবার সাথে নিদারুণ খাতির হয়ে যায়। তিনি মানুষের জন্য বাদাম এবং অন্যান্য প্রাণীকে পাউরুটি কিনে দেন প্রায়ই। ফলে পাখিরা গাছ থেকে নেমে আসে, কাঠবিড়ালি লাফ দিয়ে তার কোলে ওঠে যায় এবং কিশোর-কিশোরীরা তার মাথায় উকুন আছে কি না তা পরীক্ষা করে। অন্য দিকে পাগল তাকে নানারকম পরামর্শ দিয়ে তার মন আনন্দে ভরিয়ে তোলে। একদিন এক পাগল বলল, দুনিয়া কিয়ামত হবে। ভদ্রলোক হেসে বললেন, কেন! পাগল বলল, ওই পাগলী আপনারে বিয়া করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। দেখেন না, সে আপনার কাছে আসে না। দূর থেকে শুধু আপনাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে। ভদ্রলোক পাগলীকে কাছে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাছে আসো না কেন? পাগলী বলল ভয় করে। আপনি বন্দুক চোখে লাগিয়ে থাকেন কেন। ভদ্রলোক পাগলীর কথা শুনে এত জোরে হেসে উঠলেন যা তিনি কোনোকালে করেননি। তিনি পাগলীর হাতে শখের দূরবীণটি দিলেন। পাগলী দূরবীণ দিয়ে আকাশ দেখল। পাগলও দূরবীণটি দিয়ে আকাশ দেখার পর কিশোর-কিশোরীরা সুযোগ পেল। ছোট একটি দূরবীণ জ্যৈষ্ঠ মাসের উত্তপ্ত বিকেলে কতটা শীতল হাওয়ার পরশ দিতে পারে তার হিসাব করতে গিয়ে ভদ্রলোক দেখলেন, তার জীবনের অঙ্ক চমৎকারভাবে মিলে গেছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য