Naya Diganta

আবার কিসিঞ্জার! ইউক্রেন ইস্যুতে কেন?

নিজ ঘরের ভেতর বোমা ফাটানোর মতো ঘটনাটা ঘটিয়েছেন হেনরি কিসিঞ্জার! হ্যাঁ সেই কিসিঞ্জার! বাংলাদেশের আম মানুষের কাছে সেই কিসিঞ্জার- যার অর্থ কুচক্রী বা ষড়যন্ত্রকারী। তবে অ্যাকাডেমিক জগৎ আম মানুষের জগতের মতো খোলা মনের ভাব সরাসরি বলতে পারে না বা চলে না। ফলে কিসিঞ্জার সম্পর্ক এখানে ভদ্র ও শোভন ভাষায় সমালোচনা করতে হয়। ভাব করতে হয় কূটনীতি বলে একটি আরেক জগৎ আছে। আর কিসিঞ্জারের ভাষ্য সেই কূটনীতিকের চোখে বৈধ!
ইউক্রেন ইস্যুতে কিসিঞ্জার কিছু পরামর্শ রেখেছেন তাতে মেলা হইচই পড়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইম প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে। কিসিঞ্জার তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘ইউক্রেনের উচিত হবে নিজ জায়গা জমি রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিয়ে হলেও এ যুদ্ধ শেষ করা।’ কিসিঞ্জার আরো মনে করেন, ‘রাশিয়াকে অপমান-অবমাননাকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়ার পরিণতি পশ্চিমের জন্যই’ ভালো হবে না। সাথে মনে করিয়ে দেন যে, রাশিয়া কিন্তু ইউরোপেরই অংশ, এটি যেন কোনোভাবে অস্বীকার করা বা ভুলে যাওয়া না হয়। তাই তার সোজা কথা ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে দুই পক্ষ যে যে অবস্থায় ভূমিতে আগে ছিল, সেটিকে স্থিতাবস্থার লাইন মেনে দুই পক্ষই যেন সেই সীমার মধ্যে প্রত্যেকে নিজেকে ফিরিয়ে নেয় এবং এই ভিত্তিতে চুক্তি ও এর বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তা আগামী দুই মাসের মধ্যেই।’


কে এই কিসিঞ্জার
বাংলাদেশে যারা আশির দশকের পরে জন্মেছেন তাদের কাছে কম পরিচিত হয়তো এই কিসিঞ্জার। এর একটি কারণ হয়তো এই যে, গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে থেকে হেনরি কিসিঞ্জারের সবচেয়ে সক্রিয়তার বছর ধরা হয় ১৯৬৯-৭৭ সময়কালকে। তিনি মূলত আমেরিকার দুই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ফোর্ড- এদের আমলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার বা এনএসএ মানে নিরাপত্তামন্ত্রী ছিলেন অথবা কখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমতুল্য উপদেষ্টাও ছিলেন। এমনকি কখনো এ দুটো পদেই এবং একই সাথে নিয়োজিত থেকেছেন। আর এই যুগের পর থেকে তিনি মূলত অ্যাকাডেমিক কাজ যেমন বইপত্র লেখা বা স্থায়ী উপদেষ্টা বোর্ড বা কমিশন ধরনের সংগঠনের প্রধান হয়ে থেকেছেন। এখনো তিনি ডিকটেশন দিয়ে বই লেখাতে পারেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আশপাশে যারাই পদচারণা করেন, তাদের চোখে তিনি এখনো নমস্য এবং তার থেকে শেখার আছে বলে তারা মনে করেন!
একটু আপন মনে হবে, হয়তো তাই- সুনির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের বেলায় ১৯৭১ সাল হলো কিসিঞ্জারকে আমাদের সবচেয়ে স্মরণ ও স্মৃতিময় ঘটনাবলিতে ভরপুর সময়! কারণ তখন তিনি এরই মধ্যে টানা (১৯৬৯-৭৫) আট বছর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার) ছিলেন। আর সেকালে তার প্রথম সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা হলো, তিনি ছিলেন প্রথম চীনা-আমেরিকান সম্পর্ক স্থাপনকারী দূত। কথাটা একটু ভেঙে বুঝতে হবে। চীনে মাওয়ের কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯৪৯ সালে। এর পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নয়াচীন আর আমেরিকার মধ্যে কখনোই কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। আনুষ্ঠানিকভাবে চীন বলতে তাই আমেরিকা তাইওয়ান ও এর সরকারকেই বুঝত। আর এর অবসান হতে শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যখন, আমরা যুদ্ধ ও পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে আশ্রয়ের সন্ধানে ভারত সীমান্ত অভিমুখে ও তা ক্রস করে ছুটছিলাম। আর তখনই কিসিঞ্জার পাকিস্তান সফরের নাম করে এসেছিলেন। কিন্তু এর আড়ালে গোপনে পাকিস্তান থেকে সেই প্রথম মাওয়ের চীন সফর করেছিলেন। চীনে গিয়ে নয়াচীনের চেয়ারম্যান মাও জে দং ও প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাইয়ের সাথে বৈঠক করেছিলেন।


আর চীন-আমেরিকা সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ নিতে গিয়েই কিসিঞ্জারের আমেরিকা হবু বাংলাদেশের স্বার্থকেই পরিত্যক্ত করে ফেলে রেখে হেঁটে যায়। হবু বাংলাদেশের বিপক্ষে ও পাকিস্তানের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান নেন। অবশ্য যুদ্ধকালীন ও পরের রিলিফ তৎপরতা বা মানবিক সাহায্যগুলো আমেরিকা বাংলাদেশে চালিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশ ভেসে যাওয়ার পরের সেই সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিব তার আমেরিকা সফরকালে কিসিঞ্জারের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ করেন। বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির যোগসূত্র স্থাপন ও তৎপরতা শুরু বলা হয় সেটিকে। কথাটা আরেকভাবে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে উপায়ন্ত না পেয়ে সোভিয়েত ব্লকে ঢুকে অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ সেই প্রথম কিন্তু এবার উল্টো পথে মানে বাংলাদেশের অ্যান্টি-সোভিয়েত ব্লকে যাওয়াটা ঘটেছিল শেখ মুজিবের কিসিঞ্জারের সাথে সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে। ‘বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা মন্তব্যটা তখনকার! যদিও ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ নিয়েছিল ও তা হলেও তা কার্যত অকার্যকর করে ফেলে রাখা ছিল। সেই সম্পর্ক কার্যকর ও চালু করে প্রথম বিশ্বব্যাংকের ঋণ-অনুদান ঋণপ্রাপ্তি ঘটতে ঘটতে ১৯৭৬ সালের প্রথমার্ধে তা ঘটেছিল; তত দিনে শেখ মুজিব নেই। এসব ঘটনার সাথে কিসিঞ্জার বাংলাদেশ ইস্যুতে খুবই নির্ধারকভাবে জড়িত ছিলেন। গোপন তৎপরতায় কাজ করা, মিটিং বা চুক্তি করা এগুলো যেন কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক তৎপরতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য।
বর্তমানে প্রায় ৯৯ বছর বয়সের কিসিঞ্জার, সাম্প্রতিকালের খবর, চলতি সপ্তাহেই জেনেভায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক সভায় ভার্চুয়াল বা অনলাইনে যুক্ত হয়ে ইউক্রেন নিয়ে তিনি ওই সব মন্তব্য করেছেন। এটি ইউক্রেন যুদ্ধের এমন একটি সময় যখন প্রায় আপসরফায় সমাপ্তির দিয়ে চলে যাওয়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেনের আমেরিকা উসকানি দিয়ে ফের চাঙ্গা করেছেন- নতুন করে অস্ত্র ও অর্থ ঢেলে চলেছেন; এ কাজে ৪০ বিলিয়ন ডলার কংগ্রেস-সিনেট থেকে অনুমোদন এসেছে, যাতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদ ঠিক থাকে। ঠিক এমন সময়ে ইউক্রেনকে জমি-ভূমি-সীমানা ছেড়ে দিয়ে হলেও রাশিয়ার সাথে আপসে যুদ্ধবন্ধের দিকে যেতে কিসিঞ্জার জেনেভার ভরা হাটে দাবি করেছেন। কিন্তু কেন?


খুব পরিষ্কার করে তা বুঝিয়ে বলা হয়নি, এর পেছনের কারণ। তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন বাক্য পাওয়া গেছে এ নিয়ে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্টে। যেমন লন্ডন টেলিগ্রাফ, নিউজউইক, ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউ ইয়র্ক টাইমস ধরনের মিডিয়ায় যেভাবে এ খবর রিপোর্টেড হয়েছে তা থেকে; যেসবের সারকথা, ইউক্রেনকে নিজ ভূখণ্ড ত্যাগের বিনিময়ে হলেও রাশিয়ার সাথে আপসে যুদ্ধবন্ধের চুক্তি করতে উৎসাহ দিতে হবে। কারণ কোনোভাবে এতে রাশিয়ার জন্য এটি কোনো অসম্মানজনক হার হলে তা- ১. দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করবে। কথাটা কিসিঞ্জার বলেছেন এভাবে- ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার যে অপমানজনক পরাজয় আশা করছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করবে।’ অর্থাৎ তিনি যেনতেনভাবে রাশিয়ার কোনো- এই হার সেই হার-একেবারেই চান না। কারণ লংটার্মে এটি ব্যাকফায়ার করবে মানে আরো বড় ক্ষতি ডেকে আনবে বলে তিনি মনে করেন।
২. পরের বাক্য আরো মারাত্মক। বলছেন ‘রাশিয়া তো তোমাদের ইউরোপই’। তাই বলছেন, “পশ্চিমা বিশ্বের এ বিষয়টি উপলব্ধি করা উচিত যে, রাশিয়া ইউরোপের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই পশ্চিমের উচিত হবে না ‘তড়িঘড়ি’ কোনো সিদ্ধান্তে আসা।”
কিন্তু এতে কথাগুলো মানে, তিনি রাশিয়াকেও কি সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্ররোচনায় এবং ‘হোয়াইট ককেশিয়ান’ রেস-জাতির ধারণার চোখে দেখে বললেন? যেটা ক্রমেই এখন বাইডেনেরও অ্যাজেন্ডা হিসেবে উঁকি দিয়ে হাজির হচ্ছে? এক কথায় বললে, এখানে কিসিঞ্জারের অবস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট নয়; অর্থাৎ কেন তিনি রাশিয়াকে ‘ইউরোপেরই অংশ’ গণ্য করতে বলছেন তা স্পষ্ট করেননি। এ ছাড়া রাশিয়ানরা জাতিগত পরিচয় হিসেবে মানে রেস-জাতির বিচারে আসলে সবচেয়ে বেশি তারা ইস্ট স্লাভিক ট্রাইব বা স্লাভ-রেসের অংশ; অর্থাৎ ঠিক ককেশীয় নয় যদিও পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে বিবেচনা করলে ওর ভেতরের একটি বড় অংশই ছিল সাদা ককেশীয় রেস-জাতির; যা হোক, কিসিঞ্জার এর চেয়ে বেশি কিছু স্পষ্ট করেননি।
৩. কিসিঞ্জারের বক্তব্যের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলছেন যে, তারা যেন ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ‘আগের স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো অ্যান্টি)’ ফিরিয়ে আনতে আলোচনায় চাপ প্রয়োগ করে; যেটা অনেকটা ২০১৪ সালের সময়কার অবস্থান, যখন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ বলে ইউক্রেন থেকে কেটে রাশিয়া নিজের সাথে যুক্ত করে নিয়েছিল।


কিছু পুরনো ফ্যাক্টস
এখানে কিছু কথা পরিষ্কার করে রাখা যেতে পারে। ক্রিমিয়া জারের আমল থেকেই স্বতন্ত্র রেস-জাতি অর্থে আলাদা ছিল, তবে জার সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক অংশ হিসেবে। কিন্তু ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের পরে, ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনকালে ক্রিমিয়া অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে রাশিয়ান ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্রিমিয়ার কেউ কেউ হিটলারের জার্মানিকে সাহায্য করেছিল, এই অজুহাতে নেতা স্তালিন আমলে ক্রিমিয়ার বেশির ভাগ মানুষকেই শাস্তি হিসেবে ‘ফোর্সড’ সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল; কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ট্রেনে তুলে দিয়ে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তারা ক্রিমিয়ায় ফিরে আসে কিন্তু প্রশাসনিক দিক থেকে ক্রিমিয়া এবার রাশিয়ার সাথে আবার যুক্ত না হয়ে ক্রিমিয়া সীমান্তের অপর পাড়ে ইউক্রেনের সাথে প্রশাসনিকভাবে যুক্ত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে গেলে রাশিয়াসহ মোট ১৫টা রাষ্ট্রে তারা আলাদা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রভাব বাকি ১৪ নয়া রাষ্ট্রের ওপর থেকে জবরদস্তিতে হটাতে আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্য এক শর্টকাট ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পথ নিয়েছিল। তারা যেকোনো উপায়ে ওই ১৪ রাষ্ট্রকে ন্যাটোতে যোগদানের নীতি-পলিসিতে অগ্রসর হতে থাকে। আর এতেই রাশিয়ার নিজ ভূখণ্ড-রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দিক থেকে ব্যাপারটাকে হুমকি মনে করতে শুরু করেছিল। সব বিরোধের শুরু এখান থেকে।


তাই একই এই কারণে ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার বিরোধ দেখা দিলে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজ প্রশাসনের অধীনে ইউক্রেন থেকে ফেরত নিয়ে নিয়েছিল। আর এরই প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা সেই থেকে পুতিনের রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করতে এগিয়ে এসেছিল। নিজের অ্যাকশনের পক্ষে সাফাই বয়ান যুক্তি শক্ত করার জন্য এটিকে রাশিয়ার ইউক্রেনের ভূমি নিয়ে নেয়া জবরদখল হিসেবে উল্লেখ করতে শুরু করেছিল যেন ক্রিমিয়া তার অতীতে সবসময়ই ইউক্রেনের অংশ ছিল। অথচ মাত্র ১৯৯১ সাল থেকেই সোভিয়েত ভেঙে গেছে বলেই রাশিয়া ক্রিমিয়াকে যে আপসে ইউক্রেনের প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হতে দিয়েছিল, এই ফ্যাক্টস চেপে যাওয়া হয়ে চলছে।
ফলে এখন রাশিয়ার হাতেই ‘ক্রিমিয়াকে ছেড়ে দেয়া’ এটি ঠিক ইউক্রেনের নিজস্ব ভূখণ্ড রাশিয়াকে ছেড়ে দেয়ার মতো ঘটনা নয়। কারণ ইতিহাসে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অধীনস্থ অঞ্চল নয়; বরং ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন উভয়েই কয়েক শ’ বছর ধরে রাশিয়ান জার সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত ও পরিচালিত ছিল। এই হিসেবে কিসিঞ্জার যেন নিজেই আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমের শঠতা বয়ানের বাইরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। এ বিচারে পুতিনের রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনকে ভূমি ছেড়ে দিয়ে রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করার জন্য কিসিঞ্জারের আহ্বান ‘তেমন অস্বাভাবিক’ কিছু নয়। মূলকথা, ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কোনো কোর-ভূখণ্ড বা নিজ রেস-জাতিগত ভূখণ্ড- তা একেবারেই নয়, এ ফ্যাক্টস যদি আমরা মনে রাখি, কেবল তাহলেই এ কথা বুঝব।


এখন এ ঘটনায় দিনকে দিন এক রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে কথা আচরণের পরিবর্তে অ্যাকটিং তাও আবার ভাঁড়ামো কমেডিয়ান হতে চাচ্ছেন বেশি। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এক মাস আগেও তিনি মিডিয়ায় নিজেই বলেছেন তিনি ইউক্রেনকে আর ন্যাটোর সদস্যপদ নিতে বা পেতে আগ্রহী নন। কারণ আমেরিকান প্ররোচনায় পরে তার লোভে পড়া, এটিই এখন ইউক্রেনের দুঃখের কারণ হয়েছে। তিনি খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি আমেরিকার প্ররোচনায় পড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনিও তখন আমেরিকার ওপর হতাশ সে কথাই খোলাখুলি বলেছিলেন। আর এর পরই তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সাথে জেলেনস্কি সমঝোতা এগিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আবার সেই বাইডেন তখন অস্ত্র-অর্থের লোভ দেখাতে লাগলেন। সেই জেলেনস্কি আলোচনার টেবিল ফেলে এবার আমেরিকান উসকানি তার ভালো লাগতে শুরু করেছিল। তিনি আবার ভোল বদলে ফেলেন। সেই জেলেনস্কি এখন কিসিঞ্জারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
জেলেনস্কি বলেছেন, ‘রাশিয়ার সাথে শান্তি আলোচনার পূর্বশর্ত হলো- দুই দেশই তাদের মধ্যকার আগের সীমানায় ফিরে যাবে যার সহজ অর্থ রাশিয়া ইউক্রেনের অভ্যন্তরে যা দখল করেছে তার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে যেতে হবে;’ অর্থাৎ তিনি এখন ‘বাইডেন-মুডে’ আছেন।
আসলে কিসিঞ্জারের বক্তব্য অনেককেই প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। এদের একজন হলেন উরসুলা লেয়েন। উরসুলা বর্তমানে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলছেন, ‘যুদ্ধ কেবল ইউক্রেনের টিকে যাওয়া নয়, অথবা এটি কেবল ইউরোপীয় নিরাপত্তার ইস্যু নয়, বরং এটি সব গ্লোবাল কমিউনিটির কাজ ও দায়।’ তিনি এরপর দুঃখের ভঙ্গিতে বলছেন, এতে ‘পুতিনের ধ্বংসাত্মক ক্ষোভের খেলাও আছে।’ আবার সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে যেন বলে রাখতে চাইছেন, এক দিন হয়তো ইউরোপে তাদের বিশেষ জায়গা নিয়ে ফিরে আসবে। তা আসতেই পারে যদি সে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আন্তর্জাতিক নিয়মশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় ফিরে আসার পথ খুঁজে নেয়- কারণ রাশিয়া তো আমাদেরই পড়শি!


একালে বাইডেনের আবির্ভাব ও সবই পশ্চিমাগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে নিজেদের হাজির করার কায়দা শুরু করেছেন। আর এতে যারাই আমেরিকান নেতৃত্বের বা অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের নিচা দেখানোর এই রেসিয়াল শ্রেষ্ঠত্ব শো করা যে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলো রেস-জাতির দিক থেকে নিচা। মানে এক ‘বাইডেন বা পশ্চিমা রেসিজমের প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। আর তাতে মেতে ওঠে এই উরসুলা লেয়েনো ভালোই প্রভাবিত হয়েছেন। এই যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন আন্তর্জাতিক নিয়ম-শৃঙ্খলা- দেখানো গর্ব তিনি করছেন, এর বয়স কত?
মাত্র ৭৫ বছর। আর এর আগে তারা কী ছিলেন? তাদের সারা ইউরোপ ছিল কলোনি দখলদার লুটেরা ডাকাত। লাগাতার সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে যাদের প্রধান ব্যবসা-অর্থনীতি ছিল জাহাজে বিনিয়োগ আর এমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুলে কলোনি দখলদার লুট আর ডাকাতি করতে বেরিয়ে পড়া। সে দেশের প্রধান অর্থনীতি হলো লুট আর ডাকাতি। অথচ তারা এখন সবাইকে আইনের শাসন শেখান! যেন তারা সেই থেকে কথিত সভ্যতায় এগিয়ে ছিলেন।
খবরটা ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেয়া। তারা লিখছে, কিসিঞ্জার ইউরোপীয় লিডারদেরকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলছেন, ইউরোপে রাশিয়ার ভূমিকা অবস্থানকে খাটো করে দেখানো, দৃষ্টিশক্তির আড়ালে ফেলা না। আর? আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাশিয়াকে চীনের সাথে কোনো স্থায়ী অ্যালায়েন্সে যেতে দিও না; এটি ইউরোপের নিজেকেই রিস্কের মধ্যে ফেলা!
আশা করি এবার পাঠক দিশা পাবেন যে তা হলে কিসিঞ্জার ঠিক কী চাচ্ছেন? কিসিঞ্জার বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তির মতো তিনিও চীনা উত্থানে ভীত। কিন্তু একটি জায়গায় তিনি বাইডেন ও ইউরোপ থেকে আলাদা। সেটি হলো, চীনের ভয়ে তিনিও ভীত, কিন্তু পশ্চিমাশক্তি মানে বাইডেন ও ইউরোপ মিলে যেমন রাশিয়াকে সমানে কোপাচ্ছে, এটি তিনি ঠিক মনে করছেন না। কেন? কারণ তিনি মনে করেন এভাবে কোপাতে থাকলে চীন ও রাশিয়ার স্থায়ী অ্যালায়েন্স তৈরি হয়ে যাবে বা অ্যালায়েন্স করতে রাশিয়াকে ঠেলে দেয়া হয়ে যাবে, যা পশ্চিমা স্বার্থের বিরোধী হয়ে হাজির হবে।
এটি তিনি ফেলো পশ্চিমাদের বোঝাতে চাইছেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com