Naya Diganta

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমছে

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমছে

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান সুন্দরবনে বহুবার যাওয়া হলেও এই প্রাণীটি সরাসরি দেখার সুযোগ কখনো হয়নি। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে একদিন শুনলাম লোকালয়ে হামলা করায় সুন্দরবনের বাঘ মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত বাঘ দেখার জন্য সেখানে উপস্থিত হলাম। সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট অফিসের মাঠে নিথর পড়ে আছে বিশালদেহী প্রাণীটি। প্রথম দর্শনে আঁতকে উঠলাম। কারণ বাঘের স্বভাবসুলভ শিকার ধরার ভঙ্গিতে তাকানো হিংস্র চোখ দেখেই নাকি মানুষ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। সেই পরিসরে বিদ্যুৎ গতিতে লক্ষ্যবস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারি বাঘ। প্রথমে শিকারটিকে প্রচণ্ড বেগে থাবা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বুকের নিচে নিয়ে ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দেয়। এরপর এমন জোরে চাপ দেয় যে শিকারের প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যায়। সুন্দরবনে বিভিন্ন পেশার মানুষ প্রায়ই বাঘের আক্রমণে নিহত হন।

বাঘটি কেন মারা হয়েছে জানতে চাইলে উপস্থিত জনতা যা জানাল তা হলো- বাঘটি কয়েকদিন ধরে গভীর রাতে বন থেকে নদী সাঁতরে লোকালয়ে আসা-যাওয়া করছিল। কয়েকদিন পর সেটি গোয়ালঘরে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকটি গরু, ছাগল ও কয়েকটি কুকুর মেরে ফেলে। বাঘের ভয়ে এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পরে নিরুপায় হয়ে এলাকার লোকজন বন বিভাগের সহায়তায় বাঘটি হত্যা করে। এভাবে খাবারের অভাবেই বনের বাঘ মাঝে মধ্যে লোকালয়ে হানা দেয়।
এর আগে হরিনগর, ভেটখালী, কৈখালী, কয়রা এলাকায় বাঘের আক্রমণে মানুষ নিহত হয়েছে। সুন্দরবনে যদি বাঘ না থাকত তাহলে হয়তো এ বন উজাড় হয়ে যেত। প্রাণীটি প্রবল শক্তিধর, চারটি পায়ে ৭২ জন যুবকের শক্তিসম্পন্ন। এর অগ্নিমূর্তি, গুরুগম্ভীর স্বর, হিংস্র্র তাণ্ডব এবং দর্শনীয় শারীরিক গঠন ইত্যাদির কারণে এটি পৃথিবীর অন্যতম আর্কষণীয় প্রাণী এবং বন্য সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে চোরাকারবারিদের কবলে পড়ে প্রাণীটি এখন বিপন্ন হতে বসেছে।

বিভিন্ন জরিপের তথ্যমতে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে চার শতাধিক বাঘ রয়েছে। ভারতে রয়েছে দুই হাজার, নেপালে আছে দেড় শ’ থেকে আড়াই শ’ এবং ভুটানে আছে ৭০ থেকে ৮০টি। পৃথিবীতে এখন বাঘের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হবে না। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে অবৈধভাবে শত শত কোটি ডলারের রমরমা ব্যবসা চলছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে একটা আস্ত মরা বাঘের দামই পাঁচ হাজার ডলার। আর বাঘটা যদি জ্যান্ত হয় তাহলে তার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ হাজার ডলার। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া কালোবাজারে বিক্রি হয় ৩৫ হাজার ডলারে।

বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন- চামড়া, হাড়গোড়, মাংস ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে দাম পাওয়া যায় ৭০ হাজার ডলার। বাঘের মাংস চর্মরোগ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলের কৃষকরা বুনো শুয়োর তাড়ানোর জন্য বাঘের মাংসের ছোট একটি টুকরা আগুনে পোড়ায়। বাঘের মগজ অলসতা দূর করার কাজে ব্যবহার করা হয়। সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি আনতে এবং ব্ল্যাক মাজিকের কাজেও লাগে বাঘের মাথা। এটি অশুভ শক্তি তাড়াতে ও দৈহিক শক্তি অর্জনে জাদুটোনার কাজেও ব্যবহার করা হয়। বাঘের গোঁফ দাঁতের ব্যথা সারাতে ব্যবহার করা হয়। বাঘের সামনের পায়ের ডান দিকের থাবা বেশি শক্তিশালী বলে মনে করা হয়।

বাঘের ছেদন দন্ত দিয়ে অলঙ্কার তৈরি হয়। চর্বি, পিত্ত, নখ, হাড় এমনকি বিষ্ঠা পর্যন্ত ব্যবহার করা হয় নানা কাজে। কুষ্ঠরোগ ও বাতের চিকিৎসায় এর ব্যবহার আছে। মেনিনজাইটিসে শিশুদের খিঁচুনির চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় বাঘের পিত্ত। বাঘের লিঙ্গের যৌন ক্ষমতাবর্ধক শক্তি আছে বলে চীনা এশিয়ার কিছু অঞ্চলে মানুষের ধারণা।

বাঘের চামড়া অনেকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ঘরে টানিয়ে রাখে। এসব কারণে চোরাকারবারিদের কাছ বাঘের কদর বেড়েছে। বাঘের চামড়া পাচার হয় চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে। প্রায় দুই হাজার তিন শ’ বছর আগে থেকে ঐতিহ্যবাহী চীনা টোটকা চিকিৎসায় বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার হয়ে আসছে। চীনের মতো একই বিশ্বাস রয়েছে হংকং, জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ানে। সেখানে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কদর রয়েছে।
১৯৮০ থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরা শিকারি, বনদস্যু ও গণপিটুনিতে ৬৭টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে বাঘ, চিত্রা হরিণসহ বণ্যপ্রাণী ও পাখি শিকার নিষিদ্ধ হলেও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় চোরা শিকারিরা সুকৌশলে হত্যার পর বাঘের চামড়া, মাংস, হাড় দাঁত ও চর্বি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের উন্মত্ত নেশায় মেতে উঠেছে। সুন্দরবনে বাঘের নির্বিঘœ ও নিরাপদে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য একবারে বন্ধ করা জরুরি। ইউনেস্কো কর্তৃক সুন্দরবনকে ৫২২ নম্বর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইনের ৩ নম্বর বিধি অনুযায়ী পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সুন্দরবনের বাঘের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্যের জোগান দেয়াসহ বংশবিস্তারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার। সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষায় বন এলাকায় বাড়াতে হবে টহলদারি। সুন্দরবনে বাঘসহ সবধরনের বন্যপ্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ও জনমত গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। বিলুপ্তপ্রায় বাঘ নিশ্চিহ্ন হলে ঐতিহ্য হারাবে সুন্দরবন। আর সুন্দরবন বিলুপ্ত হলে বিপন্ন হবে বাংলাদেশ।

এ দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের ওপর। ভারত একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় সুন্দবনের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। ফলে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ মারা যাচ্ছে। বন বিভাগ সুন্দরবন থেকে সবধরনের কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই বনের ঘনত্ব বাড়ার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি জীবজন্তুর আবাসস্থল সুন্দরবন যেন উজাড় হতে বসেছে। বনের গাছপালায় আগামরা রোগসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়ায় অনেক গাছ মরে গেছে।
দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ এ বনের সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িত। মাছ ধরা, গোলপাতা, মধু, কাঁকড়া সংগ্রহ করে বিভিন্ন পেশার লোক এ বনকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বিভিন্ন কারণে বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় জীবজন্তু আগের মতো নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে না। বনের ভেতর দিয়ে চলাচলরত নৌযানের শব্দ বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এ দিকে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য তো আছেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেল : rahimkhulna8@gmail.com