Naya Diganta
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে হামলা

ক্ষমতাসীনদের অসহিষ্ণু আচরণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে হামলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মঙ্গলবার টিএসটিতে ঢাবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছিলেন। গণমাধ্যমের একটা অংশ এটাকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ বলে খবর পরিবেশন করে। এটি যে একতরফা আক্রমণ, বুধবারের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট। হামলায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ৪৬ জন আহত হয়েছেন। আর ছাত্রলীগের আহত হন চারজন।
ছাত্রলীগ গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে দাবি করে আসছে, শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীলতা এবং শিক্ষার পরিবেশ বজায়ে রাখার স্বার্থে প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করে আসছেন। গত মঙ্গলবারের হামলার পরও ওই একই দাবি করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেল, ছাত্রদল নয়; বরং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, কারা আসলে পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। গত ১০ বছরের খবরের কাগজগুলোর প্রতিবেদনই বলে দিচ্ছে, ছাত্রলীগই শিক্ষাঙ্গনে অগ্রহণযোগ্য সব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। অনেকে বলে থাকেন, ক্যাম্পাসগুলোতে হেন কোনো অপরাধ নেই যার সাথে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী জড়িত নন।
লক্ষণীয়, দ্বিতীয় মেয়াদে যখন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তার পর থেকেই দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় কলেজে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য কায়েম হয়েছে। বিগত এক দশকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া শিক্ষাঙ্গনে আর কারো উপস্থিতি সহ্য করা হচ্ছে না। ছাত্রলীগের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনের সব রকম সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগ আছে। ছাত্রলীগের ক্যাম্পাস দখলে রাখার পেছনে পেশিশক্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষপাতদুষ্ট নীতিই মূল শক্তি। এ ক্ষেত্রে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা দায়ী বলে মনে হতে পারে। তবে তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা অকারণ নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের অসহিষ্ণুতাই এর কারণ। যারাই সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামার চেষ্টা করেছেন, তাদেরই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও পেটোয়া বাহিনীর হামলায় নির্দয়ভাবে দমন করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো- সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষায় গড়ে ওঠা আন্দোলনও ছাত্রলীগ সহ্য করেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলন কঠোরভাবে পুলিশ প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের যৌথ অভিযানে দমন করা হয়েছে। এমনকি কিশোর শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন দমাতে পুলিশের সাথে হেলমেট বাহিনীও হামলায় অংশ নেয়। এসব সন্ত্রাসের কোনো প্রতিকার রাষ্ট্র করেছে বলে আমাদের জানা নেই।
মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা এমন সময় চালানো হলো, যখন ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশে বাধা দেয়া হবে না।
সেই আশ্বাসের পর তিন সপ্তাহও পেরোয়নি। এই হামলার পর ক্ষমতাসীনদের কথায় আস্থা রাখা বিরোধী শক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন সামনে আসে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে বিরোধীদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। কিন্তু ওই নির্বাচনে মধ্যরাতে ভোটের বাক্স ভরে ফেলায় বিদেশী গণমাধ্যমে যা ‘নিশি ভোট’-এর তকমা পায়।
জাতীয় নির্বাচনের ঠিক বছর দেড়েক আগে থেকেই সরকার বিরোধীদের মিছিল-সমাবেশে বাধা না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে; কিন্তু শুরুতেই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন সেই ওয়াদার বেলুন ফুটো করে দিলো।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গতিশীল করতে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই। সরকার এবং বিরোধী দলের সহাবস্থানেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ জোরদার এবং নিশ্চিত হয়ে থাকে। কিন্তু সরকারি দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এখনো অসহিষ্ণু, যা গণতন্ত্রে সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত। এই অসহিষ্ণুতা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই কেবল দুর্বল করবে না, এতে বিশ্বের কাছে ক্ষমতাসীনদের অবস্থানও নাজুক হবে বলেই মনে হয়।