Naya Diganta

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় রাশিয়া

ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন সৈন্য পাঠালে পশ্চিমারাসহ এবং তাদের মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাশাপাশি প্রকাশ্যে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং মার্কিন মিত্র দেশগুলো। রাশিয়ার সমর্থনে মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশসহ চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া থাকলেও প্রকাশ্য অংশগ্রহণে আসেনি এখনো। এটা এখন পরিষ্কার, রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণে টেনে নিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘুণে ধরা ন্যাটোকে পুনর্গঠনসহ চির প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াকে ঘায়েলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার সুপ্ত বাসনা ছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র দেশগুলো কালবিলম্ব না করে একের পর এক দেশটির বিস্তৃত খাতজুড়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপেই এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রুশ অর্থনীতিকে দমানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কী প্রভাব এবং কিভাবে এখন পর্যন্ত রাশিয়া মোকাবেলা করছে তা নিয়ে আজকের লেখা।
যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। পরাশক্তির তালিকা থেকে বাদ পড়া রাশিয়া পুনর্গঠিত হতে থাকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে; যার জানান দেয় ২০১৪ সালে ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে। ওই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ওই ঘটনা থেকে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পরবর্তী কঠোর অবরোধ মোকাবেলার। সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এমন এক রুশ অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যার ওপর নিষেধাজ্ঞার তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা দেশগুলো যতটা অনুমান করেছিল, তার চেয়েও বেশি সময় ধরে এসব নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করে টিকে আছে এবং থাকতে পারছে রাশিয়া।
মোকাবেলার সক্ষমতা বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয়, বিশ্বের বৃহত্তম দেশটির আয়তন এক কোটি ৭১ লাখ ২৫ হাজার ১৯১ বর্গকিলোমিটার; জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬২ লাখেরও বেশি। রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিশ্বের বিরল খনিজপদার্থের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ১২তম শীর্ষ অর্থনীতির এ দেশের মোট প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যমান ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের খনি শিল্পের তিন ভাগই আসে রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।
এখানে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কপার, ডায়মন্ড, লেড, জিঙ্ক, স্বর্ণ, রূপা আর পারদের মতো মূল্যবান খনিজ আছে। প্লাটিনাম, স্বর্ণ, ডায়মন্ড আর লৌহ আকরিকের একটি শীর্ষ প্রস্তুতকারক দেশ রাশিয়া। বিশ্বের মোট হীরা খননের বেশির ভাগই করে রাশিয়ার আলরোসা কোম্পানি। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের পর দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত খনিশিল্প। বিশ্বের পঞ্চম কয়লা উত্তোলক দেশ রাশিয়া, দেশটিতে মজুদ আছে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টন কয়লা।
দেশটির কাঠশিল্পের বার্ষিক মুনাফা দুই হাজার কোটি ডলার। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মৎস্যশিল্প রাশিয়ার। মস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাশিয়ার মোট প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যমান ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চীনের ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
খনিজসম্পদের পাশাপাশি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম ও যব রফতানিকারক দেশ রাশিয়া। বৈশ্বিক পরিসরে রুটির ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাতি আছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যবের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ ও ভুট্টার ৪ শতাংশ রফতানি করে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যশস্যের জোগান দেয় রাশিয়া। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রাশিয়াবিরোধী ইউরোপীয় দেশগুলোর মোট গ্যাস চাহিদার ৪১ শতাংশ জোগান দেয় মস্কো। যদি ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি বড় ধরনের বিপদে পড়বে। কারণ, দেশ দু’টি সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করে। যুক্তরাজ্যকে প্রায় ৫ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। সে কারণেই রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও গ্যাসের ওপর তা আসেনি এখনো। বরং রাশিয়াই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর গ্যাস অস্ত্র ব্যবহার করছে ফলে ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে পারছে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার তীব্র সমালোচনা করলেও রাশিয়ার তেলে এখনো পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এখনো ইউরোপ রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তবে ইউরোপের তেল কেনার পরিমাণ অনেকটা কমেছে। তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এলেও তেমন কার্যকর হচ্ছে না কারণ, ইউরোপীয় দেশগুলো বেনামে রাশিয়ার তেল কিনছে। আসলে রাশিয়ার তেল ছাড়া ইউরোপের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। ফলে পশ্চিমাদের এত অবরোধ সত্ত্বেও রুশ অর্থনীতি যে ধসে যায়নি, তার মূল কারণ এই গোপন তেল-বাণিজ্য।
এপ্রিলে রাশিয়া দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ১০ হাজার ব্যারেল তেল বিক্রি করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর আগে যে পরিস্থিতি ছিল, সেই পর্যায়ে ফিরে গেছে। ভারত ও চীন বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক, দেশ দুটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার পোয়াবারো হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে রাশিয়া কম দামে তেল বিক্রির প্রস্তাব দিলে ভারত ও চীন তা লুফে নেয়।
অধিকন্তু, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভবানও হচ্ছে রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় এপ্রিলে রাশিয়ার তেল বিক্রি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। সেই বিক্রি থেকে রাশিয়া মাসে প্রায় ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি ডলার আয় করছে।
অন্য দিকে ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি জাহাজ ও পাইপলাইনের মাধ্যমে রফতানি করেছে মস্কো। ফলে ২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে হাইড্রোকার্বন খাত থেকে রুশ সরকারের রাজস্ব বছরওয়ারি হিসাবে ৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে দেশটি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ সুদহার কার্যকর করে সমর্থন দেয়ায় দেশটির মুদ্রা রুবলের পতন ঠেকানো গেছে। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের সময়ের মান ফিরে পেয়েছে রুবল। বিদেশী মুদ্রায় বিক্রীত বন্ডের সুদও পরিশোধ করতে পারছে রাশিয়া। দ্য ইকোনমিস্ট প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রুশ অর্থনীতি ধসের পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় রুশ মুদ্রা রুবলের ব্যাপক দরপতন হয়। তখন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার পতন ঠেকাতে সুদহার অনেকটা বাড়ায়। এতে মুদ্রার দরপতন ঠেকানো সম্ভব হয়। মূল্যস্ফীতিও লাগামছাড়া হয় না। এরপর গত ২৯ এপ্রিল রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার ৩ শতাংশ হ্রাস করে।
অর্থনৈতিক লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম ‘সুইফট এর ওপর অবরোধ আরোপ করে পশ্চিমারা। তবে, ইতোমধ্যে রাশিয়া ও চীন নিজেদের মধ্যে ‘সুইফট’-এর বিকল্প বার্তাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং সেই ব্যবস্থায় আশপাশের অনেক দেশকে শামিল করতে তৎপর আছে। ভারত ইতোমধ্যে এসপিএফএস নামে পরিচিত রাশিয়ার ফিন্যান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেমে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। ২০১৭ সাল থেকে লেনদেন চলতে থাকা এই ‘এসপিএফএস’ দ্রুত শামিল হতে চলেছে চীনের সিআইপিএসের (ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম) সাথে। ডলারভিত্তিক আধিপত্যের জগৎ এড়াতে রাশিয়ার সাথে চীন ও ভারতের লেনদেন ব্যবস্থার সমন্বয়ের চেষ্টা এখন মোটেই আর আলোচনার টেবিলে আটকে নেই; বরং সেটা অনেক বাস্তব চেহারা নিচ্ছে।
ভারত ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে রাশিয়ার সাথে ২০১৮ সালে চুক্তি হওয়া পাঁচ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিচ্ছে রুপি-রুবল বিনিময়ব্যবস্থায়। অস্ত্র ছাড়াও সারের মতো জরুরি আমদানি পণ্যের সরবরাহ বাধামুক্ত রাখতেও রাশিয়ার সাথে সুইফটের বিকল্প ব্যবস্থায় ঢুকতে হচ্ছে ভারতকে। বিশ্বজুড়ে এ রকম প্রবণতাগুলোরই মিলিত ফল হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক সেটেলমেন্টে ডলারের হিস্যা ইতোমধ্যে অনেক কমেছে বলেই তথ্য মিলছে।
অবরোধ মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় চালটি খেলেছে রাশিয়া মুদ্রা নিয়ে। রাশিয়া হঠাৎ করে এই ঘোষণা দেয় গোল্ডের বিপরীতে রুবেলকে ফিক্সট করে দিবে; যেখানে এক গ্রাম গোল্ডের দাম হবে পাঁচ হাজার রুবল। অর্থাৎ রাশিয়া ব্যাংকের কাছ থেকে এক গ্রাম স্বর্ণ সমান পাঁচ হাজার রুবল বা প্রায় ৬১ ডলার ফিক্সট রেটে গোল্ড কিনবে। এই গোল্ডের ওপরে ভিত্তি করে যে এক্সচেঞ্জ রেট সেটা রুবলকে ডলারের বিপরীতে অনেক শক্তিশালী করছে ফলে এখন এক ডলার সমান ৮১ রুবল যা কিছুদিন আগেও ১০০ রুবল এর ওপর ছিল। এই ব্যাপারটাকে বলা হয় গোল্ড প্যারিটি। এই পদ্ধতিটি সর্বশেষ প্রয়োগ করেছিল সুইজারল্যান্ড এবং পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডে গোল্ড প্যারিটি বাতিল করে দেয়। গোল্ড প্যারিটি ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র দেশ মিলে দেয়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছিল রাশিয়া। তবে রাশিয়া এই ঘোষণার পরে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে কাজটা করবে না। ফলে ৭ এপ্রিল রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৮ এপ্রিল থেকে গোল্ড কে ফিক্স রেটে রুবলের সাথে এক্সচেঞ্জ করবে না। বরং তখন থেকে নেগোশিয়েট প্রাইস অর্থাৎ ৫০০০ রুবেল না করে নেগোশিয়েট করার সামর্থ্যরে ভিত্তিতে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ভর করবে। অর্থাৎ রাশিয়া পুরোপুরি সেই আগের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের যুগে ফেরত যাচ্ছে ব্যাপারটা এরকম না।
তবে রাশিয়ার কাছ থেকে কিছু কিনতে হলে গোল্ড দিয়ে অথবা ডলারের বিপরীতে রুবল দিয়ে কিনতে হবে। আগেই বলেছি, রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্যাস রফতানিকারক এবং তৃতীয় বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশ। এই রফতানি রাশিয়া রুবল কিংবা গোল্ড ছাড়া করবে না। মূলত নিজেদের ডলার থেকে বের করে নিয়ে আসাই লক্ষ্য। আর ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের অনেক কারণের মধ্যে ডলার টিকিয়ে রাখাও অন্যতম। অতীতেও দেখা গেছে যারাই ডলার থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে তারাই আক্রমণের শিকার হয়েছে; লিবিয়া, ইরাক, ইদানীং পাকিস্তান এর অন্যতম উদাহরণ।
দ্য গার্ডিয়ানের অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক ল্যারি এলিয়ট বলেছেন, অতীতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা দেশগুলোর অনেক মূল্য চুকাতে হয়েছে। এ যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্রুত বিজয় অসম্ভব হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া আক্রমণের পর থেকেই ভøাদিমির পুতিন সক্রিয়ভাবে পশ্চিমা বলয় থেকে রাশিয়াকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়ত, স্বয়ংসম্পূর্ণতা বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টায় চীনের সাথে একটি নীতির সূচনা করেছে দেশটি। বেইজিংয়ের সাথে এ চুক্তি গ্যাস পাইপলাইন পাওয়ার অব সাইবেরিয়া তৈরির পথ প্রশস্ত করেছিল, যা ২০১৯ সালে চালু করা হয়। তৃতীয়ত, রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানি থেকে প্রাপ্ত অর্থে আর্থিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে ব্যবহার করেছে। মস্কো প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বসে আছে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, দেশটির জাতীয় ঋণের পরিমাণও অনেক কম। যেখানে মহামারীর কারণে অনেক দেশের জাতীয় ঋণ জিডিপির আকারকে ছাড়িয়ে গেছে।
জার্মান থিংক ট্যাংক কিয়েল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, গ্যাস রফতানি বন্ধ করলে রাশিয়ার জিডিপি ৩ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল রফতানি বন্ধ হলে এক দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পশ্চিমা দেশগুলো অন্যত্র জ্বালানির উৎস তৈরি করতে সক্ষম হবে। তবে এ পরিস্থিতি টালমাটাল জ্বালানি বাজারকে রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
এজন্য অনেক বিশ্লেষক জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি শীতল যুদ্ধের উত্তাল সময়েও পশ্চিমা বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত ছিল। রুশ জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করলে বিশ্বকে মূল্য দিতে হবে বলেও সতর্ক করেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
উপরোল্লিখিত বিভিন্ন প্রচেষ্টার পরও যুদ্ধের প্রভাব যে একেবারে পড়ছে না রাশিয়ার ওপরে, তা নয়। এপ্রিলে বার্ষিক হিসেবে রাশিয়ার ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা ২০০২ সালের জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। তবে মাসিক হিসেবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, মার্চে যা ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, এপ্রিল মাসে নেমে এসেছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশে। মুদ্রার দরপতনে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া অনেক পশ্চিমা কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ায় সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়েছে। এ সময় দেরিতে কর্মীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এখন রুবল মান ফিরে পাওয়ায় পরিস্থিতির আবারো উত্তরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এত কিছুর পরও রুশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো অক্ষত আছে। মোট বিদ্যুৎ ব্যবহার কমেছে সামান্যই। মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও রুশ ভোক্তাদের ক্যাফে, পানশালা বা রেস্তোরাঁয় হাত খুলে খরচ করতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক। কিছু অর্থনীতিবিদ চলতি বছরে রাশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ হারে কমার যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, বর্তমান অবস্থায় সেটি বাস্তবে নাও হতে পারে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com; mizan12bd@gmail.com