Naya Diganta

পাকিস্তানের গন্তব্য কি অনিশ্চিত

শাহবাজ শরিফ ও ইমরান খান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২৫ মে ইসলামাবাদ লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণার পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন ঝড়ের সূচনা হয়েছে। ইমরান পেশোয়ারে তার দলের কোর কমিটির বৈঠকের পর ঘোষণা করেন, ‘আমরা নতুন নির্বাচনের তারিখ এবং আইনসভা ভেঙে দেয়ার দাবি করছি। আমরা দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চাই। আমাদের রাজনীতির ধরন হলো শান্তিপূর্ণ এবং আমাদের জনসমাবেশে সব স্তরের মানুষ এবং মহিলারা অংশগ্রহণ করে। আমাদের রাজনীতিতে এটাই আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার সংগ্রাম। শান্তিপূর্ণ লংমার্চে বাধা সৃষ্টি হলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আমি ২৫ মে শ্রীনগর হাইওয়েতে সবার জন্য অপেক্ষা করব।’

পিটিআই চেয়ারম্যানের এই ঘোষণার পর তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব বলেছেন, ফেডারেল সরকার দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রোধ করতে প্রতিটি সাংবিধানিক পদক্ষেপ নেবে। সরকার কাউকে দেশে অরাজকতা ছড়াতে দেবে না। রক্তপাত ঘটবে এমন কোনো লংমার্চ সরকার হতে দেবে না। নতুন নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারই নেবে বলে উল্লেখ করেন তথ্যমন্ত্রী।

এর আগে পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর কেন্দ্রীয় নেতা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ পিটিআইয়ের ইসলামাবাদ লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে, তিনি লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের ইসলামাবাদে প্রবেশ করতে এবং তাদের বাড়ির বাইরে বের হতে দেবেন না। তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের গ্রেফতার করা হবে।

লংমার্চ ও রাজনৈতিক উত্তাপ
লংমার্চ নিয়ে এই উত্তাপের মাঝেই পাঞ্জাব প্রাদেশিক সভায় পিএমএল-এন ভিন্নমতের সদস্য ফয়সাল নিয়াজি পদত্যাগ করেছেন। তিনি পাঞ্জাব আইনসভা স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অন্য দিকে পাঞ্জাবে পিটিআই জোট নেতা চৌধুরী পারভেজ এলাহি বলেছেন, প্রথম পদত্যাগ এসেছে এবং পিএমএল-এন-এর আরো সদস্য পদত্যাগ করবেন। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মুসলিম লিগের ভিন্নমতাবলম্বী চার এমপিএ পদত্যাগ করতে পারেন। এটি হলে পিটিআইয়ের ২৫ এমপিএ’র সাথে এই চারজন যোগ হয়ে ২৯ এমপিএ বাদ যাবে পাঞ্জাব প্রাদেশিক সভা থেকে। এরপর হামজাহ শরিফের পক্ষে আস্থা ভোটে জয়লাভ কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমের মূল্যায়ন অনুসারে, দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর পাঞ্জাবের হামজা শাহবাজ শরিফের সরকার নিশ্চিতভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ রায়ে বলা হয়েছে, দেশের যেকোনো আইনসভায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলত্যাগকারীদের ভোট গণনা করা উচিত নয়। এর পরপরই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন দলত্যাগী পাঞ্জাব প্রাদেশিক আইন সভায় ভোটদানকারী ২৫ সংসদ সদস্যের এমপিএ পদ শূন্য ঘোষণা করে। পিটিআই ত্যাগকারী এসব এমপিএ’র ভোট নিয়ে মুসলিম লিগের হামজা শরিফের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন এখন আর বৈধ নয় বলা হচ্ছে। দেশটির সিনিয়র সাংবাদিক হামিদ মীরের মতে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর পাঞ্জাবে এখন আর কোনো সরকার নেই।

আপাতদৃষ্টিতে, শাহবাজ শরিফের ফেডারেল সরকারের ওপর সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ পিটিআই ভিন্নমতাবলম্বীদের কেউই গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে পাঞ্জাবের মতো কেন্দ্রেও পিএমএল-এন-এর নেতৃত্বাধীন সরকার হালকা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর প্রতিদিন যেভাবে পাকিস্তানের রুপির দরপতন ঘটছে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কারণে মানুষের দুর্দশা বাড়ছে তাতে শাহবাজ শরিফ ও তার মিত্ররা সরকার চালিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। মুসলিম লিগের কো-চেয়ারম্যান মরিয়ম নওয়াজ দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি মনে করছেন, ইমরান খানের অর্থনৈতিক দুরবস্থার দায় গ্রহণ দলের জনভিত্তি আরো দুর্বল করবে। অন্য দিকে নতুন সরকারে মন্ত্রিত্ব পাওয়া অনেকে যতটা সম্ভব সরকারের মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে চাইছেন।

নানা চ্যালেঞ্জে শাহবাজ সরকার
এক দিকে রাজনৈতিক ঝড় অন্য দিকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর অবনতির আশঙ্কা আর সেই সাথে বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্কের সমীকরণ শাহবাজ সরকারের জন্য সরকার চালানো কঠিন করে তুলেছে। ইমরানের লংমার্চ ঘোষণার পর দ্রুত নির্বাচন দেয়া না হলে বড় ধরনের সঙ্ঘাত দেখা দিতে পারে। সরকার লংমার্চ প্রতিরোধের ঘোষণা দিলেও জনমতের কারণে তা সহজ কাজ হবে না। এর মধ্যে পাকিস্তানের বড় বড় শহরে ইমরান যে সমাবেশ করেছেন তাতে সর্বস্তরের জনগণের ঢেউ তৈরি হয়েছে। জনগণের এই চাপের মুখে দুর্বল ও পরস্পরবিরোধী দলগুলোর জোটকে ক্ষমতায় ধরে রাখা সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এর ফলে এস্টাবলিশমেন্ট এখন শাহবাজ সরকারের পক্ষে দৃশ্যমান কোনো সমর্থন জানাতে চাইছে বলে মনে হয় না।

এ দিকে বৈরী পরিস্থিতিতে সরকার গঠন করতে গিয়ে যে বিপাকে পড়েছে শাসক জোট সে উপলব্ধি ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাড়ছে। আসিফ আলি জারদারি বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন বলে নতুন সরকারের অংশ না হয়ে কেবল সমর্থন জানাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু নিজের পুত্র বিলাওয়ালসহ দলীয় নেতাদের মন্ত্রী হবার লোভের সামনে তার এই উপলব্ধির মূল্য থাকেনি। অন্য দিকে নওয়াজ কন্যা মরিয়মের মধ্যে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব না পাওয়ায় বেশ খানিকটা ক্ষোভ রয়েছে। শাহবাজ হয়েছেন ফেডারেল সরকারের প্রধানমন্ত্রী আর পুত্র হামজাহকে তিনি বানিয়েছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। এতে নওয়াজ পরিবারের মধ্যে অসন্তোষের বিষয়টি মাঝে মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে।

এই টানাপড়েনের মধ্যেও শাহবাজ শরিফ সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কাছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু ইমরানের চাপ এবং বৈরী জনমতের কারণে এস্টাবলিশমেন্ট সেই ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

২০১৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন লন্ডনে বসবাসরত শাহবাজের ভাই ও তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের এখনো পার্টি এবং সরকারের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গত সপ্তাহে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা নতুন সরকারের নির্দেশনা নিয়ে নওয়াজের সাথে পরামর্শ করতে হঠাৎ লন্ডনে গিয়েছিলেন। এ সময় পাকিস্তানের অর্থনীতির সর্পিল নিম্নগামী যাত্রা অব্যাহত ছিল। ডলারের তুলনায় রুপি দ্রুত মান হারাতে থাকে; শেয়ারবাজারও মূল্য হারায়।

ইমরান খানের সরকার যে ব্যয়বহুল, টেকসই জ্বালানি ভর্তুকি নীতি অনুসরণ করছিল সেটিই কি এ সরকার চালিয়ে যাবে নাকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পাকিস্তানের ঋণ কর্মসূচি পুনর্নবীকরণের পূর্বশর্ত হিসেবে সরিয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহার করবে তা নিয়ে একটি মৌলিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি শাহবাজ। ভর্তুকি অপসারণ অবশ্যই অজনপ্রিয় হবে, যা পরবর্তী নির্বাচনের আগে সীমিত সময় দায়িত্বে থাকা শাহবাজ সরকারকে গণক্ষোভের মুখে ফেলতে পারে। এখনো অবধি সরকার কী করবে তা স্পষ্ট নয়।

শাহবাজের সামগ্রিক দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতায় বোঝা যায়, ক্ষমতায় আসার আগে তারা আসলে কোনো বিকল্প শাসন পরিকল্পনা বা অর্থনৈতিক কৌশল তৈরি করেননি।

নির্বাচন ও গভীর ক্ষমতা বলয়
পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য একটি বড় প্রশ্ন হলো পরবর্তী নির্বাচনের সময়। এই নির্বাচন স্বাভাবিক সূচি অনুসারে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ইমরান খান স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি অবিলম্বে নির্বাচন করতে চান। নতুন সরকার, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলোর সমাধানসহ সবকিছু তাদের পক্ষে আনতে ক্ষমতার মেয়াদকাল ব্যবহার করতে পারেন।

জোট সরকার গত সপ্তাহে বলেছে, তারা আগাম নির্বাচনে যাবে না; প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি জোর দিয়ে বলেছেন, সংসদ নির্বাচনী সংস্কার করার আগে নির্বাচন হবে না। কিন্তু সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নভেম্বরে নির্বাচন হবে। ইমরান খানও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চান। তবে তিনি তার ভাষায়, ‘আমদানি করা সরকারের’ অধীনে এই সংস্কার সম্ভবত চাইছেন না। ঠিক এই জায়গাটিতে দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয় সক্রিয় হতে পারে।

পাকিস্তানে একটি নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠিত হবে বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বাজেট ঘোষণার আগেই যদি এই নির্বাচনের তারিখ দেয়া হয় তা হলে দ্রুততম সময়ে শাহবাজ সরকার তত্ত¡াবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারেন। তবে শাহবাজ সরকার এবারের বাজেট ঘোষণা করুক সেটি ইমরান খান চাইছেন না বলে মনে হয়।

পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্ট হিসেবে পরিচিত সামরিক বাহিনী একটি বিতর্কিত ও অজনপ্রিয় সরকারকে সামনে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে বলে অনেকে এখন মনে করছেন না। যার কারণেই শাহবাজ সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আগামী নভেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন বলে তারা মনে করছেন। সামরিক বাহিনী অক্টোবর নভেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করতে চাইছে বলে জল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে দেশের নতুন সেনাপ্রধান কে হবেন সে ঘোষণা এসে যেতে পারে।

এ দিকে দেশটির পররাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও নতুন সরকার চাপে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ওয়াশিংটন সফরের পর নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বেইজিং সফরে গেছেন। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখবে। এর আগে বিলাওয়াল ভুট্টো বলেছিলেন, ইমরান খানের মস্কো সফর ছিল পাকিস্তানের অনুসৃত পররাষ্ট্র সম্পর্কের নীতিগত একটি সিদ্ধান্ত।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের ভ‚মিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া ২৯ নভেম্বর অবসর গ্রহণ করছেন। তিনি মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব নিজেও করবেন না এবং প্রস্তাব এলে সেটি গ্রহণও করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এর অর্থ হলো নতুন সেনাপ্রধান পাচ্ছে পাকিস্তান। সাধারণত এক মাস আগে সেটি ঘোষণা করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে নতুন নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নতুন সেনা নেতৃত্বের চিন্তাভাবনার প্রভাব থাকতে পারে। ইমরান খানের ব্যক্তিগত পর্যায়ের টানাপড়েন বাজওয়ার এভাবে বিদায় নেয়ার কারণ বলে মনে করা হয়।

জানা যায়, ইমরান খান আমেরিকান চাপের কারণে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে গররাজি ছিলেন না কিন্তু তিনি নির্বাচনের আগের সময়টাতে একটি তত্ত¡াধায়ক সরকার থাকবে মর্মে সম্মত ছিলেন এবং তার সাথে এস্টাবলিশমেন্টের তেমন একটি বোঝাপড়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত চাপে সেটি আর হয়নি। ইমরান সমর্থকরা এ ব্যাপারে বাজওয়ার ভ‚মিকা রয়েছে বলে সন্দেহ করেন। সেনাপ্রধান অবশ্য ইমরানের বিদায়ের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে নতুন সরকারকে সমর্থন দেননি। লংমার্চ ঘোষণার পরও সমর্থন দেবেন বলে মনে হয় না।

নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হলে ইমরান খান লংমার্চের কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করতে পারেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরেই পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শাহবাজ সরকার এখনই পদত্যাগ না করলে এই সরকারের মেয়াদ হতে পারে তিন মাস। শাহবাজের বিদায়ের পর তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেবে। ইমরান এখন এ ব্যাপারে খুব তাড়াহুড়া না করে শাহবাজ শরিফের সরকারকে আরো কিছু দিন ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন বলে মনে হয়। এখন জনমতের যে অবস্থা তাতে আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইমরান খানের আবারো সরকার গঠনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়।

গভীর নজর
পাকিস্তানে গভীর ক্ষমতা বলয়ের মূল নিয়ামক হলো সেনাপ্রতিষ্ঠান। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই রাষ্ট্রের মূল নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করে। আইএসআই’র একটি রাজনৈতিক শাখাও ছিল। নানা সমালোচনার মুখে একসময় এই ইউনিট বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্প্রতি এটি আবারো সক্রিয় করার কথা জানা যাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার সর্বশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতি গভীর নজর রাখছে বলে মনে হয়। জানা যাচ্ছে, তারা রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে অরাজক ও সহিংস অবস্থা সৃষ্টির মতো কোনো ঘটনা কোনো পক্ষ ঘটাতে পারবে না।

এ কারণে দু’পক্ষই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিক্রিয়াকে সহিংসতা উসকে দেয়ার পথে নিতে চাইছে না। ইমরানের সব রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ এবং লংমার্চের কর্মসূচিও তিনি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ এ ব্যাপারে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তাতে বলেছেন গৃহযুদ্ধে উসকানি দিলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সহিংসতা সৃষ্টি করলে ইমরান খানকে গ্রেফতার করে তাকে জেলে যে সেলে রাখা হয়েছিল সেই সেলে রাখতে চান। এ জন্য তিনি অনুমোদনের অপেক্ষা করছেন। এই অনুমোদন কে দেবেন সেটি তিনি উল্লেখ করেননি।

কিন্তু যতদূর জানা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সঙ্ঘাত উসকে যাওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ রাষ্ট্রের গভীর ক্ষমতা বলয় নেবে না। এটি যে নেবে না তা সুপ্রিম কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক রায় ও সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ করা যায়। শাহবাজের সরকারও ভর্তুকি প্রত্যাহার ও কর বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ সম্বলিত বাজেট দিয়ে এর দায় নিতে চাইছে না। ফলে এটি বিচিত্র কিছু হবে না যে শাহবাজ সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বাজেটের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিতে পারেন। গভীর ক্ষমতা বলয়ও সম্ভবত সে দিকেই হাঁটছে। আর তত্তাবধায়ক সরকার নির্বাচনী সংস্কার ও অর্থনীতিকে গতিপথে আনতে কিছু দিন বেশি সময় নিলে তাতে ইমরান খানের আপত্তি না-ও থাকতে পারে।

নির্বাচনে কী ফল হতে পারে?
সার্বিকভাবে একটি সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার যদি শিগগিরই ক্ষমতা নেয় তাতে বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। আর পরের নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন ইমরানের প্রতি জনসমর্থনের ঝোঁক থাকলেও তার ফলাফল কী হবে তা পুরোপুরি স্পষ্ট বলা যাবে না। পাকিস্তানের সংসদীয় ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোন দল সবচেয়ে বেশি ‘নির্বাচনযোগ্য’ স্থানীয় নির্বাচনী এলাকায় শক্তিশালী রাজনীতিবিদকে তাদের পক্ষে পেতে পারে সেটি। বৃহৎ শহুরে সমাবেশগুলো খানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে পারে, তবে সংসদ নির্বাচনে তার দল কিভাবে কতটা ভালো করবে এটি দিয়ে তা পুরোপুরি নির্ণয় করা যাবে না। অন্য কারণটিও গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, কোনো দলের নির্বাচনযোগ্য রাজনীতিবিদরা নিজেদের সেই দলেই সারিবদ্ধ করে, যেখানে সামরিক বাহিনীর শক্তিশালী সমর্থন থাকে। সেই সমর্থন আগামী নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে কোন দিকে থাকবে তা এ সময়ে বলা মুশকিল।

চলমান তীব্র রাজনৈতিক টানাপড়েনের নিচে পাকিস্তানের ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলো একই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সামরিক বাহিনীর সমর্থন। রাজনৈতিক দলগুলো এখন সরাসরি রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের দিকে ইঙ্গিত করে; কিন্তু শুধু যখন তারা বিরোধী দলে থাকে তখন। আর সরকারে থাকলে সেই সমর্থন উপভোগ করে, তখন তারা এটিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু করে না। এটি ক্ষমতায় থাকাকালীন ইমরান খানের দলের ক্ষেত্রে সত্য ছিল এবং এখন শরিফের সরকারের ক্ষেত্রেও সত্য।
সৎশসসন@মসধরষ.পড়স
mrkmmb@gmail.com