Naya Diganta

জীবনমান উন্নয়নে অসাধু প্রতিযোগিতা ও মূল্যস্ফীতি

জীবনমান উন্নয়নে অসাধু প্রতিযোগিতা ও মূল্যস্ফীতি

সামষ্টিক অর্থনীতির সমসাময়িক কালের নির্দেশক বা সূচক নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথমে যে দু’টি বিষয় সাধারণত জনগণের মনে ঘুরপাক খায় ও হৃদয়ের অন্তস্তলে নাড়া দেয়, সে দু’টি বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার। মূল্যস্ফীতি শুধু ব্যবসাবাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না; বরং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত সবাইকে সমানভাবে ভাবিত করে ও তাদের জীবনমান প্রভাবিত করে। মূল্যস্ফীতির হার যখন বেড়ে যায় ও বাড়তে থাকে তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্কটে পড়ে। এতে নানাভাবে নানাপর্যায়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়। সে জন্যই বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি সামষ্টিক অর্থনীতির মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমসাময়িক বিবরণীগুলোতে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো একত্রে এনে পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকার যেসব তথ্য দিচ্ছে, কথা বলছে ও বক্তব্য দিচ্ছে এবং যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে তার সাথে বাস্তবতার মিল নেই। এর অর্থ হচ্ছে, সরকার প্রথম থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণকে সঠিক পরিসংখ্যান না দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল অথবা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে।

মুদ্রাস্ফীতির অনেক মুদ্রাবিষয়ক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কারণ ও উৎস রয়েছে; যেমন বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি; দেশজ উৎপাদনে ঘাটতি; পণ্য সরবরাহে ঘাটতি; মুদ্রার বিনিময় হার; শুল্ক ও বিশেষ শুল্ক হার; অশুল্ক বাধাগুলোর প্রভাব; মুদ্রা সরবরাহ; বাণিজ্যঘাটতি; বাজেটঘাটতি; বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা; সুদের হার; ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ; পণ্যের একচেটিয়া মূল্য নির্ধারণ; শ্রমিক ইউনিয়নের মজুরি বাড়ানোর চাপ; শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে খাতওয়ারি মজুরি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা; শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা; মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে অসামাঞ্জস্য; সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে জীবনমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার মতো কারণগুলো। এগুলোর বেশির ভাগ আবার একে-অপরের সাথে সম্পর্কিত। একটি সূচকের কার্যক্রম অন্য সূচককে প্রভাবিত করে। মূল্যস্ফীতির কারণ যেমন একটি নয়, তেমনি এর প্রতিকারও একটি সূচকের তারতম্য করার মাধ্যমে সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সমস্যার উৎস যেমন বহুমুখী-বহুমাত্রিক, তেমনি এর প্রতিকারেও প্রয়োজন বহুমুখী-বহুমাত্রিক কার্যকলাপের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া।

তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার যে প্রক্রিয়া তাতে তিনটি বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান। প্রথমত চাহিদাগত; চাহিদার সাথে স্বল্পমেয়াদে দ্রব্য-পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, দ্বিতীয়ত পণ্যমূল্যের ওপর হঠাৎ করে বহিরাগত ধাক্কা। তৃতীয়ত স্বল্পমেয়াদে আমদানিকৃত পণ্য ও কাঁচামালের ঘাটতি। অর্থাৎ একই সাথে আকস্মিক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও সরবরাহ কমে যাওয়া। চাহিদা বেড়ে গেলে তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় পণ্যের চাহিদা, সরবরাহ ও পণ্যমূল্যের অন্তস্তলে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয় এবং চাহিদা ও সরবরাহের মূলকেন্দ্রে মূল্যস্ফীতির সঙ্কেত সৃষ্টি করে। পরে যদি সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হয় বা ভ্রান্তনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ করা হয় তাহলে মূল্যস্ফীতি তার নিজস্ব গতি অনুসরণ করে স্থায়ী রূপ লাভ করে, যা পরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আকৃতিতে রূপ নেয়।

মূল্যস্ফীতির যে দু’টি প্রধান কারণ ও যুক্তি (তত্ত্ব) এখন পর্যন্ত মোটামুটি মীমাংসিত ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সেগুলো হচ্ছে প্রথমত, (ক) চাহিদা বৃদ্ধিÑ আশাবাদ, আশঙ্কা বা প্রত্যাশানির্ভর অতিরিক্ত বিনিয়োগ বা ব্যয়। অর্থাৎ মূলধন ও উপাদানের চাহিদা এবং একই সাথে (স্বল্প মেয়াদে) ভোক্তার অতিরিক্ত চাহিদা। যেমন, আমাদের দেশে রোজার আগে বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, ঈদের সময় চিনির দাম বৃদ্ধি, কোরবানি ঈদের আগে মসলার দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি । এটাকে এক কথায় বলা হয় ‘মাত্রাতিরিক্ত সার্বিক চাহিদা তত্ত¡ বা চাহিদার টান তত্ত্ব; দ্বিতীয়ত (খ) প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বল্পসময়ে জীবনমান উন্নয়নে আয় বাড়ানোর প্রতিযোগিতা ও ব্যয় বাড়িয়ে দেয়া (হঠাৎ করে যদি কোনো গোষ্ঠীর আয় বেড়ে যায়, তখন ওই গোষ্ঠীর সদস্যরা একে-অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় বাড়ায়)। এই তত্তে¡র নাম মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ধাক্কা তত্ত¡। এতে দেশে স্বল্পকালীন মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা সাধারণ মানুষের জীবনমানে তেমন কোনো উন্নয়ন হয় না। বরঞ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের আপাময় জনগণের ভোগান্তি বাড়ে ও দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন দুটোই বাধাগ্রস্ত হয়।

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের দূষ্টচক্র (সিন্ডিকেট)
অথচ দেশে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথেই একটা কথা সবাই উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকে, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি শাকসবজির দাম বাড়লেও একই কথা শোনা যায়। তাহলে কি শুধু কোনো একটা বা দু’টি পণ্যের দাম বাড়লেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়? অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাউকে তেমন কথা বলতে শোনা যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে শাসকদলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও কোটিপতি। এখন প্রশ্ন উঠে তাহলে কি গত দশকে দেশে কোনো রাজনৈতিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে? এর সোজাসাপটা উত্তরÑ অবশ্যই।

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, উন্নয়ন প্রকল্প, এমনকি সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে অর্থ লোপাট, অনৈতিক ও অবৈধ আয়, খাজনা খোঁজা অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে লুটপাটের সাথে যারা জড়িত, তাদের বেশির ভাগই শাসকদলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রভাবশালী নেতা, সদস্য ও সমর্থক। সেই সাথে যোগ হয়েছে ভোটডাকাতির মাধ্যমে, তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং অনির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তারা একে-অপরের যোগসাজশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন বা লুটপাটে সদা-সর্বদা ব্যস্ত। এই গোষ্ঠী বাংলাদেশে বর্তমানে একে-অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই গোষ্ঠীকে যদি কেউ লুটপাটের সিন্ডিকেট হিসেবে চিহ্নিত করে তাহলে ভুল হবে না।

সরকারি যেকোনো কেনাকাটা বা সরবরাহের দরপত্র প্রকাশ্যে আসার আগেই সরকার সমর্থক এই গোষ্ঠী, একে-অপরের সাথে গোপন আঁতাত করে ঠিক করে নেন, কোন কাজটি কে করবেন এবং কত টাকায় করবেন। এভাবেই তারা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে সেবা বা সরবরাহকৃত পণ্যের মূল্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। নির্মাণকাজ, সেবা বা সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমও তাদের লুটপাট থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ কারণে সরবরাহকৃত পণ্য বা সেবা যা-ই হোক না কেন, তা হয়ে থাকে অত্যন্ত নিম্নমানের। ফ্লাইওভার নির্মাণ থেকে বড় বড় সড়কের কাজ, সেতু থেকে রেলপথ, বন্যা ও ভাঙন থেকে শহর রক্ষায় নদীশাসন, নদীর বাঁধ ও হাওরের বেড়িবাঁধগুলো প্রতি বছর ভেঙে পড়া ও রাস্তাঘাটের বেহাল চেহারা নমুনা হিসেবে নিয়ে পাঠক নিজেই বর্তমান লুটপাটের প্রকৃত অবস্থা অনুমান করে নিতে পারেন।

লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত এই অতিরিক্ত অর্থ সবাই মিলে ভাগবাটোয়ারা করে নেন। লুটপাটের বেশির ভাগ বিদেশে পাচার করে দেয়ায় দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ এক সঙ্কটের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এ রকম পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। পরিণতিতে নির্মাণকাজসহ সরকারের ক্রয়কৃত ও সরবরাহ করা সব সেবা ও পণ্যের মান এক দিকে যেমন নিম্নমানের, তেমনি অন্য দিকে মূল্য হচ্ছে আকাশচুম্বী। এ কারণেই যেকোনো নির্মাণকাজ, পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে সরকারের যা খরচ হওয়া উচিত, বর্তমানে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়। এক কথায় বলতে গেলে পুরো সরকারি ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। এখন তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না। কারণ দেশে এখন আর আইনের সমপ্রয়োগ হয় না।

যদি খবরের কাগজের খবরগুলো সত্যি হয়ে থাকে তাহলে গড়ে ওঠা গোষ্ঠী টেন্ডারে নিজ ইচ্ছেমতো মূল্য দিতে পারে। কাজ না করেও ভুয়া বিল জমা দিয়ে অর্থ উঠিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই’। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকার অনেক খাতে অঢেল খরচ করলেও কাজ হয় নামমাত্র। আমি পুনর্ব্যক্ত করছিÑ পুকুরচুরির মাধ্যমে জনগণের যে অর্থ অপচয় হচ্ছে সেই টাকা, ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত দাবিদার ও অসাধু জনপ্রতিনিধি, দলীয় ও অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং সরকার সমর্থক একধরনের বায়বীয় ব্যবসায়ী, যাদের দুই হাত ও এক পা বিদেশে, তারা সবাই এই লুটের টাকা ভাগ করে নেন। এখানে-সেখানে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম কোনো বিধিবিধান নয়।

এ ধরনের লুটপাট, রাজস্ব অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার বীজ পরিলক্ষিত হয়েছিল ১৯৬০-৭০ বা ৮০-এর দশকে পৃথিবীর অনেক দেশে। যেমনÑ দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা (হুয়ান পেরন) ও পেরুতে (মোরালেস), আফ্রিকার কংগো ব্রাজাভিল (মুবুতে সেসে সেকো), লাইবেরিয়া (চার্লচ টেইলর) ও জিম্বাবুতে (রবার্ট মুগাবের) বা বর্তমানে ভেনিজুয়েলা (শ্যাভেজ) জনতুষ্টিমূলক শাসনামলে। জনতুষ্টি বিধায়ক শাসন নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে।

চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের খবরাদি
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের খবর নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্তে¡ও প্রতিদিন গণমাধ্যমে দুর্নীতির অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার দৈনন্দিন শিরোনামগুলো দেখলেই পাঠক বাংলাদেশে বর্তমানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির যে মহোৎসব চলছে এর বাস্তব ও খোলামেলা চিত্র পাবেন। একই সাথে পাঠক দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন, কারা দেশে অনৈতিক আয়ের অংশীদার। কারা ও কোন গোষ্ঠী পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে একত্রে মিলেমিশে দেশের কোষাগার থেকে অর্থ লুণ্ঠন করতে সদা ব্যস্ত। খবরের কাগজের শিরোনামগুলো তাদের কার্যকলাপের প্রামাণিক দলিল। আরো একটু গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে বোঝা যাবে, এই গোষ্ঠী কিভাবে সরকারি পণ্য ও সেবা জোগানোর টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেই সাথে এর পরিণতিতে দেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তাদের এই লুটপাট শুধু সরকারি ব্যয়ে তীব্র নেতিবাচক ভ‚মিকা রাখছে। তবে সত্যিকার অর্থে, তাদের এসব কার্যক্রমের পরিণতিতে সমাজ ও দেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতির মূল ভিত্তিতে একধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের সমাজ-রাজনীতির তাত্তি¡ক ভিত্তিই দুর্বল করে দিয়েছে।

জনতুষ্টি বিধায়ক শাসন ও কোষাগার লুণ্ঠন
সত্তরের দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক বেষ্টনীর আড়ালে বিশ্বের বহু দেশে একনায়কতান্ত্রিক নেতা একধরনের তথাকথিত কল্যাণমুখী ‘জনতুষ্টি শাসনের নীতি’ অনুসরণ করেন। ফলস্বরূপ ওই সব দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এসব দেশ অতীতে বেশ সম্পদশালী হলেও জনতুষ্টির নীতি অনুসরণ করে একনায়কতান্ত্রিক শাসক ওই সব দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ চার দশক পরও এই দেশগুলো এখনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ধ্বংসাবশেষের রেশ টানছে। সামাজিক অস্থিরতা দেশগুলোকে এমন এক দুর্দশাগ্রস্ত করেছে, যার কারণে ওই সব দেশে আজো সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বিধাদ্ব›দ্ব ও অস্থিরতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের দিকে এগোতে পারছে না।

এসব একনায়কতান্ত্রিক শাসক আবার অল্প কিছুকাল জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। পরিচিতির কলেবর বৃদ্ধি এবং এই ক্ষণস্থায়ী কৃত্রিম জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে তারা এমন এক শাসন বা নীতি অনুসরণ করেছিলেন, যার ফলে ওই দেশগুলোতে রাজনীতিবিদ, আমলা, বায়বীয় (টুকটাক) ব্যবসায়ী ও সুযোগসন্ধানী পেশাজীবী মিলেমিশে এক নতুন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। ওই গোষ্ঠী সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দেশের সম্পদ অবাধে লুটপাট করেছে। ব্যবসার নামে লুটপাট করতে তাদের কোনো বাধা ছিল না। অতি দ্রুত তারা ধনী বনে যান। এ গোষ্ঠী অবৈধ ও অনৈতিকভাবে সম্পদ করায়ত্ত করতে যথেচ্ছভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো প্রশাসন বা দেশ শাসনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দুর্বল করে দিয়েছিল। অন্য দিকে সরকারি কর্মকর্তা ও নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচিত বা তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগসাজশ করে সরকারি কোষাগারও খালি করে দিয়েছিল।

‘জনতুষ্টি শাসন’ব্যবস্থায় এক দিকে সরকারি ক্রয়ের খরচ বেড়ে যায়, অন্য দিকে রাজস্ব আয় কমে যায়। সেই সাথে সরকারের ঋণ বেড়ে যায়। কেননা ঋণ নেয়া ছাড়া সরকারের খরচ নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বস্তুতপক্ষে এই ‘জনতুষ্টি নীতি’ চালু রাখতে একধরনের সস্তা ‘জনপ্রিয় শাসন’ব্যবস্থা চালু করতে এ শাসকেরা বাধ্য হয়। ফলে সরকারের খরচ ও ঋণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের বিভিন্ন আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুণ্ঠনে সহায়তা করে। এসব পথভ্রষ্ট বা তথাকথিত জনপ্রিয় নেতাদের বাধা দিকে কোনো দেশেই শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল না। নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হতো বলে বিরোধীরা রাজপথে সরব থাকলেও সংসদে ছিলেন যৎসামান্য। প্রহসনের নির্বাচনে নামমাত্র নির্বাচিত নেতারাই ছিলেন ভোটচুরির সর্দার। তাই সংসদে তাদের কখনো শক্তিশালী বিরোধী দলের সম্মুখীন হতে হয়নি।

এসব নেতার সমর্থকদের মধ্যে যারা গরিব ও দুর্বল বা যাদের লুণ্ঠনের সামর্থ্য ছিল না, তাদের লাগাতার সমর্থন ধরে রাখতে ও পথভ্রষ্ট করে নিত্যনতুন সমর্থন জোগাড়ে সামাজিক বেষ্টনীর নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ‘কল্যাণমুখী’ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ফলে ভর্র্তুকির কলেবর অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এই ‘জনপ্রিয় শাসন’ব্যবস্থার ফলে সমাজে দুর্নীতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গরিবের সম্পদ লুণ্ঠন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সমাজে সার্বজনীন নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে। বাজেটঘাটতি ও দেশী-বিদেশী ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে। এগুলো সব মিলেমিশে মূল্যস্ফীতির অন্তস্তলকে উসকে দেয়। একই সাথে এই ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করায় মূল্যস্ফীতির হার মারাত্মক আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় ওই সব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আইএমএফের হস্তক্ষেপ বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। ওই সময় অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ওই সব দেশকে অর্থনীতির কাঠামো সমন্বয় সাধনে যে নীতি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বাধ্য করে, সেই নীতি ক্রমান্বয়ে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস বা মতৈক্য’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই