Naya Diganta

ধরাছোঁয়ার বাইরে

ধরাছোঁয়ার বাইরে

মেঘনা গোমতির তীর ঘেঁষে একটি গ্রাম নাম তার সুবর্ণগ্রাম। সেই গ্রামের একসময়ের সুশীল শিশু সুকোমল বসাক প্রথম জীবনে স্থানীয় হাইস্কুলে কিছু দিন শিক্ষকতা করেছিলেন। গ্রামগঞ্জে তখন কালমার্কস চর্চা জোরেশোরে সবে শুরু হয়েছে। ওস্তাদ সাগরেদরা উঠতি আঁতেল প্রকৃতির সে সময় সেরখানেক ফিদেল কাস্ট্র, আধা কেজি পরিমাণ ট্রটস্কি, পরিমাণমতো টিটো, মাও সেতুং ও মার্টিন লুথার কিং, চার চা-চামচ চৌচেস্কু ইত্যাদির অধ্যয়নে সময় কাটাত। সুকোমল গাঁওগেরামের অর্থনীতির আলোচনায় আঁতেল ভাবই শুধু প্রকাশ করত তা নয়, ঢাউস প্রকৃতির বই লিখবার পাঁয়তারাও ছিল তার। তার ছিল সুবর্ণগ্রাম হাইস্কুলের হেড মাস্টার হওয়ার বড় শখ কিন্তু স্কুলে হঠাৎ করে তো কেউ হেডমাস্টার হতে পারেন না এবং তখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এত উন্নতি সাধিত হয়নি যে, যে কেউ তদবির তেলেসমাতিতে এমনকি বিশেষ ক্ষমতা বলে হেডমাস্টার কেন কয়েক বছর পড়িয়ে প্রভাষক অধ্যাপক হতে পারেন। তাই তিনি হঠাৎ হোমরা-চোমরা হতে গ্রামের চৌধুরী বাড়ির বড় কেরানির চাকরিতে নাম লেখালেন। গোটা গ্রামে তখন চৌধুরী পরিবারের প্রতিপত্তি যেমন ছিল একই সাথে নিবু নিবু অবস্থায় ছিল মুখুজ্জেদেরও প্রভাব।

বড় চৌধুরী হরিচরণ বাবু হঠাৎ হার্টফেল করলেন। সর্বেসর্বা ক্ষমতাধরের এমন অন্তর্ধানে চৌধুরী পাড়ায় তো বটেই মোকামে মড়ক লেগেছে ঠাহর হলো। সবাই হতভম্ব। এ অবস্থায় মদন মুখুজ্জেদের মুখে চন্দন, কমলকান্ত মুখুজ্জে তার প্রভাব প্রতিপত্তির পসার সাজানো শুরু করেছে। চৌধুরীদের দহলিজ থেকে মুখুজ্জেদের দস্তরখানায় পাত্র নিলেন বসাক বাবু। তার এই রাতারাতি ভোল পাল্টানোয় সবাই আশ্চর্য হলো বৈকি। শুধু তিনি একা নন সুকোমল বাবুদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে কমল বাবুর সভায় স্থান করে নিয়েছে। কমলকান্ত গ্রামের উন্নয়নের নামে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিলেন। তিনি নিজেই কোদাল কাস্তে হাতে খাল কাটার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মানুষের উন্নতি কিভাবে হবে, কিভাবে মানুষ সহজে সুপেয় পানি পাবে, বিদ্যুৎ পাবে, গোলা ভরা ধান পাবে, পুকুর ভরা মাছ পাবে আরো কত কী স্বপ্ন দেখা ও দেখানো শুরু হয়ে গেল সুবর্ণগ্রামে।

কমল বাবু কর্মসূচি নিলেন গ্রামের যত খানাখন্দ, পুকুর-পুস্করনি, খাল-বিল সবটাকে খনন করে সেখানে সুপেয় পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। খনন করা খাল ও পুকুর পাড়ে লাগানো শুরু হয়ে গেল ফল, ফসল, পাট ও ধান। সাথে শুরু হলো মাছ চাষের আর্ট ও গান। এসব কাজকর্মে কমল বাবু আর সুকোমল বসাক হঠাৎ করে যেন পরস্পরের ভাবশিষ্য ও হরিহর আত্মা হয়ে গেলেন। রাতদিন খাল খনন কাজে সুকোমল বসাক এমনভাবে নিজেকে জড়ালেন যেন মনে হচ্ছিল কমল মুখুজ্জের এমন ভক্ত কুশীলব ভ‚ভারতে আর জন্মায়নি। চার দিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। তাতে বসাক বাবুর পসারও বাড়তে লাগল। তরতর করে পেয়ে গেলেন পদোন্নতি। তিনি হোমরা-চোমরা হয়ে মাঝে মধ্যে বড় বড় বিদ্যালয়েও বক্তৃতা দিতে যান। মোটামুটি একজন বুদ্ধিদীপ্ত কামলার পর্যায়ে উঠে গেলেন তিনি।

কমলাকান্ত বাবু চাপাডাঙ্গায় নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে বর্ষণমুখর ভোরে খুন হলেন। এই অদৈব দুর্বিপাক দুর্ঘটনায় মুখুজ্জেদের বাড়িতে সবাই মুষড়ে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে বসাক বাবু এই সুবাদে তীর্থযাত্রী হওয়ার বাসনা বা ফন্দি আঁটলেন। মথুরায় তার এক পিসি থাকত। তার আমন্ত্রণে তিনি মথুরায় পাড়ি জমালেন। সেখানে তিনি তার পসার বাড়াতে চেষ্টিত হলেন। বসাক বাবু বরাবরই মেধাবী, চৌকশ, বাগ্মি ও বাক্যালাপে বেজায় শব্দ নির্মাণের শক্তি তার ছিল। সেসব চালবাজি খাটিয়ে বসাক বাবু প্রায় আট বছর মথুরায় কাটিয়ে আবার গাঁয়ে ফিরলেন। এবার মনে হলো এ যেন খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। গ্রামে তখন আবার চৌধুরীদের প্রভাব জাগতে শুরু করেছে। সবাই বিস্ময়ে এক দিন দেখল কমল মুখুজ্জের কাছের কামলা খাটা সেই বসাক বাবু হঠাৎ করে চৌধুরী বাড়ির বড় দিদিমনির প্রেমে পড়ে গেলেন।

হরিচরণ চৌধুরীর মেধাবী মেয়ে বিদেশে ক‚টকৌশল রপ্ত করে গ্রামে ফিরে এসেছে। ক্রমে ক্রমে সবার দিদিমনি গ্রামের মাথার মনি হওয়ার পথে। দিদিমনির ডাকসাইটে সহযোগী হওয়ার বাসনা বসাক বাবুর মধ্যে জেগে উঠল তীব্রভাবে। মোক্ষম এ সময়ে দিদিমনির ভালোবাসা লাভের আশায় সুকোমল বসাক গ্রামের সুবোধ ও সুশীল কুল ব্রাহ্মণদের ‘শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরী সুরে উতলা’ হতে উদ্বুদ্ধ করলেন। শেষমেশ কৃষ্ণরূপী বসাক বাবুর বাঁশরী শুনে সব সুশীল রাইরা ঘরের বার হলো।

হ্যামিলনের সেই বাঁশিওলার মতো গাঁয়ের যত ছোট-বড় মুটে মজুররা তার পিছু নিলো। গাঁয়ের সবাই প্রমাদ গুনল। সুশীল সেবকদের মর্যাদা, মান্যি গণ্যি সব হাওয়ায় উড়ে গেল। হঠাৎ করে বড় ছোট জ্ঞান সকাল বিকেলের পালাবদলে দুধ ও ঘোল তেল ও ঘির মধ্যে একাকার হতে শুরু করল। বাড়ির ল²ী ঘরের ল²ী সুশীলদের এভাবে একুল ওকুল বরণের খেলায় সবাই আঁতকে উঠল। এভাবে চৌধুরীরা যে তালুক পেল সেই তালুকে ভোল পাল্টানোয় পটিয়সী বসাক বাবু সর্বেসর্বা হয়ে উঠলেন। ঘরের সৌন্দর্য যেসব ললনা তার কথা শুনে জাতকুলের মান খেয়ে বাঁশি শুনে বের হয়েছিল, তাদের বেশ এনাম দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো আর যারা তার কথা রাখেনি তাদের ঘরছাড়া করা শুরু হয়ে গেল। এ যেন গ্রাম্য ক্ষ্যামতা প্যাঁচালের উৎকোচের উদগ্র উদ্বাহু।

যা হোক, বছর পাঁচেক পর মুখুজ্জে বাড়ির বৌ সুদামনি দেবী চৌধুরী বাড়ির দিদিমনির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে গেল। অবস্থা যা দাঁড়াল তাতে প্রথম বেকায়দায় পড়লেন বসাক বাবু নিজে। এখন বসাক বাবু কোথায় দাঁড়াবেন? বারবার পক্ষ ত্যাগ করায় ওস্তাদ বর্ণচোরাদের মতো বসাক বাবুর এবার এক ঘরে হওয়ার জোগাড়। কমলাকান্ত বাবুর সাথে তার এক সময়কার সখ্যের সূত্র ধরে তার কুল রক্ষা হলো না এবার। তিনি এগাঁ সেগাঁয় গাঢাকা দিয়ে বেড়ান। কয়েক বছরের মাথায় বেজায়নক গোলমাল বেধে গেল গ্রামে। ফণি মণ্ডলের ছেলে ননিগোপাল হঠাৎ করে মাতাব্বরি নিয়ে নিলো গ্রামের। তখন তার দাপট দেখে কে! সে প্রথমে এসে বসাক বাবুদের মতো বসন্তের কোকিলদের কাবু করতে একঘরে আটকাল। সে ঘরে বসাক বাবুকে যে ক’দিন যেভাবে রাখা হয়েছিল বাবু তার বর্ণনা করে একখান বই লিখে ফেললেন। তাকে কিভাবে কথায় কথায় ঠাট্টা মশকরায় মাথায় ঘোল ঢেলে দিয়ে হেনস্থা ও অপমান করা হয়েছে সেসব কথা সবাইকে বলবার বাসনা থেকে তিনি বইটি ছাপার উদ্যোগ নিলেন। তবে বাবুর মনে হলো এ ক’দিনে তার মাথায় নতুন অনেক বুদ্ধিও গজিয়েছে। এসব হেনস্থায় একবার তার ধারণা হলো তার শিক্ষকতায় ফিরে যাওয়া উচিত।

বারবার ভোল পাল্টিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা নিয়ে একখানা ভালো পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে পারবেন তিনি। বাল্য ও কিশোরকালে অ্যান এক্সপার্ট হেডমাস্টারের যে নোট বই তিনি বা তানারা পড়তেন তার এই বইও জিপিএ ফাইভ না হলেও অন্তত প্রশ্ন ফাঁস রোধের দাওয়াই হিসেবে কাজে লাগতে পারে। এই বই একজন অভিজ্ঞ হেডমাস্টারের তাজ তার মাথায় পরাতে পারে। বাবু এটাও ছবক নিলেন যে কিভাবে টাকা পয়সা নয়-ছয় করা যায়, না আঁচিয়ে কামানো যায়, সরানো যায়, বাঁচানো যায়। বসাক বাবুর দিব্যচোখ খুলে গেল। ব্যস ইতোমধ্যে চৌধুরীরা আবার সুবর্ণগ্রামের প্রভু হয়ে উঠল। তারা বসাক বাবুর প্রতি মুখ ফেরালেন। বাবুর জ্যোতি বেড়ে গেল। এবার বয়োবৃদ্ধ বাবু ক্ষমতায় থাকার সুবাদে টাকা-পয়সা সরানোর ব্যবসায় নাম লেখালেন।

গ্রামের বড় বড় ব্যবসায়ী কন্ট্রাক্টর ও সরল মানুষের টাকা নয়-ছয় করার কাজে ও লেনদেনের ব্যবসায় বাবু বেশ বিশ্বস্ত ও অ্যান এক্সপার্ট হেডমাস্টার হয়ে উঠলেন। ঘরের টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি হাতিয়ে নেয়ার কাজে তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এক দিন তিনি সবাইকে পথে বসিয়ে ছাড়লেন। স্কুলের চাকরি পাওয়ার বয়স তার আর নেই তথাপি সবাই তাকে অ্যান এক্সপার্ট হেডমাস্টার হিসেবে মান্নি গণ্যি করতে করতে গালমন্দ করতে শুরু করল। বর্ণচোরাদের বন্যায় ভেসে গেলেন তিনি।

[রম্য লেখক। উন্নয়ন গবেষক ও বিশ্লেষক।]